সস্তার 'ওয়ান্ডার ড্রাগ' সত্যিই কি বার্ধক্য শ্লথ করে, ওজন কমায়!
২০১০ সালে ডানা বোলিং যখন মেটফরমিন নামক একটি ওষুধ খেতে শুরু করেন, তখন তার নিজের ওজন কমানোর দিকে কোনো আগ্রহই ছিল না। ২৮ বছর বয়সী ডানা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমে ভুগছিলেন, যে কারণে তার ডিম্বাণু উৎপাদন ব্যহত হচ্ছিল। কিন্তু ডানা সন্তান নিতে চেয়েছিলেন এবং সেজন্য তিনি ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। এরপর ডাক্তার তাকে কয়েক দশক ধরে ডায়াবেটিসের ওষুধ হিসেবে পরিচিত মেটফরমিন বড়ি খাওয়ার পরামর্শ দেন।
মাত্র ১০ থেকে ২০ সেন্ট মূল্যের এই মেটফরমিন বড়ি খাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে ডানার ওজন প্রায় ১০ পাউন্ড কমে যায়- এবং তার শরীরের গঠনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়।
সংবাদমাধ্যম ইনসাইডারকে ডানা বলেন, "আমার মনে হয়েছিল আমার শরীর থেকে এমনিতেই ওজন ঝরে গেছে। কিন্তু যতদূর মনে পড়ে, আমি আমার ডায়েটে কোনো পরিবর্তন আনিনি তখন।"
যারা মেটফরমিন ওষুধ খান, তাদের গড়ে ৫ থেকে ১০ পাউন্ড ওজন কমতে পারে; কারণ এই ওষুধটি শরীরে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণের ধরনে পরিবর্তন আনে, ফলে ওই ব্যক্তির ক্ষুধা কমে যায়। অন্যভাবে বললে, অটোফেজি (যে প্রক্রিয়ায় দেহের ক্ষয়িষ্ণু এবং অপ্রয়োজনীয় কোষাণুগুলো ধ্বংস ও পরিচ্ছন্ন হয়) নামক শরীরের একটি প্রধান সেলুলার ক্লিনআপ ও রিনিউয়াল প্রক্রিয়াকে উদ্দীপিত করা এবং শরীরের মেটাবলিজমে (বিপাক) পরিবর্তন আনার মাধ্যমে এটি অনেকটা উপবাস থাকার বিষয়টিরই অনুকরণ করে। মেটাফরমিন ওষুধের অন্যতম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো পাকস্থলীর সমস্যা।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মেটাফরমিনকে (যা একবেলা খাওয়ার নিয়ম) একটি 'ক্রিটিক্যাল পাবলিক-হেলথ টুল' হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মূলত টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে কাজ করা এই ওষুধটিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। সংস্থাটির মতে, যেকোনো আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় এ ওষুধটি সহজলভ্য হওয়া উচিত।
এছাড়াও, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, একশো বছর আগে 'ফ্রেঞ্চ লাইলাক' নামক ভেষজ উদ্ভিদে পাওয়া যেত এমন একটি যৌগ থেকে উদ্ভূত এই মেটফরমিন ওজন কমাতে এবং ব্লাড সুগার কমাতে সাহায্য করে। তাদের ধারণা, এটি বার্ধক্যকে শ্লথ করে।
মেটাবলিজম, কোষ এবং শরীরের ভাইরাস প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর মেটফরমিনের যে প্রভাব রয়েছে তা বায়োহ্যাকার, শিক্ষাবিদ এবং চিকিৎসকদের আগ্রহের কারণ হয়ে উঠেছে; কেউ কেউ আবার এটিকে 'বিস্ময়কর ওষুধ' বলেও অভিহিত করেছেন। তাদের বিশ্বাস, এ ওষুধটি হয়তো বার্ধক্যকে শ্লথ করতে এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে শরীরে ক্যান্সারের আক্রমণ, স্মৃতিশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের প্রক্রিয়াকে শ্লথ করতে সাহায্য করবে।
সম্প্রতি ব্রায়ান জনসন নামক এক বিত্তশালী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তার ব্যাপক অ্যান্টি-এজিং রুটিনের জন্য গণমাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়েছেন। বার্ধক্য ঠেকাতে হেন কাজ নেই যা তিনি করছেন না। সেই ব্রায়ান জনসন বলেছেন, তিনি তার কোলন ও মলদ্বারে প্রিক্যান্সারাস বাওয়েল পলিপ হওয়া ঠেকাতে মেটফরমিন ওষুধ গ্রহণ করেন।(কোনো কোনো গবেষণায় বলা হয়েছে, যেসব ডায়াবেটিস রোগী মেটফরমিন ওষুধ খান, তাদের কোলনিক পলিপ হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে; আবার কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে, এই ওষুধটি কোলোরেক্টাল ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করতে পারে)।
বার্ধক্য নিয়ে কাজ করা খ্যাতনামা গবেষক ও জীববিজ্ঞানী ডেভিড সিনক্লেয়ার তার বই 'লাইফস্প্যান'-এ লিখেছেন, তিনি প্রতিদিন সকালে দইয়ের সাথে এক গ্রাম মেটফরমিন খান। তিনি আশা করেন, এটি তার মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণে রাখবে এবং তার দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে সুস্থ-সবল ও তারুণ্যপূর্ণ রাখতে সাহায্য করবে।
এছাড়াও, দীর্ঘ কোভিড এবং গুরুতর কোভিডের ক্ষেত্রেও মেটফরমিন এক ধরনের রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে বলে সম্ভাবনা দেখা গেছে। ২০২২ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৬০ জনেরও বেশি ওভারওয়েট (বাড়তি ওজনের) ব্যক্তি যারা কোভিড প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে মেটফরমিন খেয়েছিলেন, তাদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থতা ও দীর্ঘ কোভিডের লক্ষণ তুলনামূলক কম দেখা গেছে। শুধু কোভিডের ক্ষেত্রেই নয়, এ ওষুধটির ভাইরাস-প্রতিরোধী গুণ অন্যান্য রোগ প্রতিরোধেও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ভেটেরানদের নিয়ে করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এদের মধ্যে যারা মেটফরমিন খেয়েছেন তাদের রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ঝুঁকি কম।
বার্ধক্যকে শ্লথ করতে এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে মেটফরমিন ঠিক কিভাবে কাজ করে তা এখনই বলতে পারছেন না গবেষকরা; তবে এটি যে কিছু না কিছু চমক দেখাচ্ছে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
মেটফরমিন মূলত ওজন কমানোর মাধ্যমে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হলেও, অ্যান্টি-এজিং নিয়ে কাজ করা গবেষকরা বলছেন, এই ওষুধের আরও অনেক কার্যকারিতা রয়েছে।
বর্তমানে মেটফরমিন নিয়ে গবেষণা করছেন মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েট-ম্যানেজমেন্ট ক্লিনিকে কর্মরত গবেষক ক্যারোলিন ব্রামান্ট। তিনি বলেন, ডায়াবেটিস, প্রিডায়াবেটিস এবং ওজন সংক্রান্ত সমস্যায় তিনি 'প্রায়ই' রোগীদের মেটফরমিন ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। তিনি বলেন, "যারা ওজন কমাতে চায় তাদের সবার ক্ষেত্রেই যে এ ওষুধ কাজ করবে এমনটা নয়, তবে কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে ১০ শতাংশ পর্যন্ত বা তারও বেশি বাড়তি ওজন ঝরে গেছে।"
আট বছর আগে নির বারজিলাইও ঠিক এভাবেই মেটফরমিনের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। সেসময় তাকে প্রিডায়াবেটিস ও বাড়তি ওজন কমাতে এ ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছিলেন চিকিৎসকরা। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত মেটফরমিন খেয়ে যাচ্ছেন বারজিলাই- এবং এখন তিনি আগের চেয়ে অনেক হালকা-পাতলা। ৬৭ বছর বয়সী বারজিলাই মনে করেন, এই ওষুধটি এক ধরনের 'বার্ধক্য-প্রতিরোধক' এবং এটি মানুষের দেহকে সুস্থ-সবল রাখতে সাহায্য করে।
"এখন আর আমার প্রিডায়াবেটিসের সমস্যা নেই, আমি আর স্থূলকায় নই; কিন্তু তবুও আমি মেটফরমিন খাওয়া ছাড়িনি," বলেন বারজিলাই।
২০২০ সালে সেল মেটাবলিজম নামক একটি জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণার সহ-লেখক ছিলেন বারজিলাই। সেখানে তিনি জানিয়েছেন কিভাবে মেটফরমিন দেহকোষের ওপর প্রভাব ফেলে এবং বার্ধক্যকে মন্থর করে। গবেষণায় বলা হয়েছে, মেটফরমিন স্টেম-সেল এজিং প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে এবং অটোফেজি প্রক্রিয়া সংঘটনে আরও সাহায্য করে। এই সবগুলোই বার্ধক্যকের প্রভাবকে উল্টো রোধ করে। গবেষণায় আরও প্রমাণ দেওয়া হয়েছে যে, মেটফরমিন অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের মতো রোগ থেকে শরীরকে সুরক্ষিত রাখতেও সাহায্য করতে পারে।
এই সকল কারণেই মেটফরমিন শুধুমাত্র সিলিকন ভ্যালির বায়োহ্যাকারদের মধ্যেই জনপ্রিয় নয়, বরং বিত্তশালী অনেক চিকিৎসকেরাও এখন এই ওষুধ খাওয়া শুরু করেছেন।
ওজন সংক্রান্ত সমস্যায় মেটফরমিনের ভূমিকা
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডেভিড বুলওয়ারও যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায় ব্রামান্টের সাথে মেটফরমিন নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি জানান, ছয় মাস আগে তিনি অনিয়মিতভাবে এই ওষুধটি খাওয়া শুরু করেন। তিনি কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তার নিজস্ব টিমের গবেষণার বরাতে তিনি জানতেন যে মেটফরমিনের মধ্যে ভাইরাস-প্রতিরোধী গুণ থাকতে পারে।
এরপরে তিনি নিজেই এটি নিয়ে আরও কিছু গবেষণা করেন এবং ওজন সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে মেটফরমিনের ওপরেই নির্ভর করার সিদ্ধান্ত নেন। এযাবত তিনি দশ পাউন্ড ওজন কমিয়েছেন বলে জানান বুলওয়ার। তার আরও দশ পাউন্ড কমানোর ইচ্ছা আছে।
তবে মেটফরমিন মানুষকে স্বাস্থ্যকর-দীর্ঘ জীবন লাভে সাহায্য করতে পারে এমন ধারণার পেছনে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ রয়েছে বলে মনে করেন না ডেভিড বুলওয়ার। এযাবত বার্ধক্য সংক্রান্ত সমস্যা-যেমন, দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা বা ক্যান্সার'র সঙ্গে মেটফরমিনের যোগসূত্র নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে, তাতে গবেষকরা জানিয়েছেন যে মেটফরমিনে হয়তোবা পরিমিত পরিমাণে বার্ধক্য-প্রতিরোধী উপাদান থাকতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে গবেষকরা এও জানিয়েছেন যে, এ ব্যাপারে চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি বা বিষয়টি অমীমাংসিত; কিংবা এ নিয়ে আরও গবেষণার দরকার রয়েছে।
উল্লেখ্য যে গোলকৃমি, ইঁদুর ও মাছির ওপর মেটফরমিনের অ্যান্টি-এজিং প্রভাব রয়েছে বলে দেখা গেছে; কিন্তু তাই বলে মানুষের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য কিনা সে বিষয়ে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এযাবত মেটফরমিনের যেসব উপকারিতা প্রমাণিত হয়েছে, তা মূলত টাইপ-২ ডায়াবেটিসের রোগীদের ক্ষেত্রেই ছিল; ব্লাড সুগারের মাত্রা যাদের স্বাভাবিক তাদের ক্ষেত্রে নয়।
কিন্তু পরিশেষে, ডেভিড বুলওয়ার মনে করেন, শরীরের সঠিক ওজন বজায় রাখাও বার্ধক্যকে মন্থর করার জন্য ভালো উপায়- আর মেটফরমিন এক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করতে পারে।
তরুণদের ক্ষেত্রে ঝুঁকি
তরুণদের ক্ষেত্রে বার্ধক্য প্রতিরোধে মেটফরমিন গ্রহণের ঝুঁকিও রয়েছে। যতদিন না পর্যন্ত এই ওষুধটির কার্যকারিতা সম্পর্কে স্পষ্ট বৈজ্ঞানিক প্রমাণ না পাওয়া যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত এটি গ্রহণে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত বলে মনে করেন রুবেডো লাইফ সায়েন্সেস-এর সিইও কোয়ার্টা। তার ভাষ্যে, "এটা কোনো জাদুকরী ওষুধ না।"
কারো কারো ক্ষেত্রে মেটফরমিন গ্রহণের পর অনেক ওজন কমেছে, আবার কারো কারো ক্ষেত্রে এটি কোনো প্রভাবই ফেলেনি। তাই অসাবধানী হয়ে মেটফরমিন গ্রহণ করলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং রক্তপ্রবাহের মধ্যে ল্যাক্টিক এসিড তৈরি হওয়ার মতো বিরল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও রয়েছে। এছাড়া, কোনো কোনো গবেষণায় দেখা গেছে, এটি টেস্টোস্টেরন (পুরুষের প্রধান যৌন হরমোন) কমিয়ে দেয় এবং পেশীর বৃদ্ধিতে বাধা দেয়।
আর এসব কারণেই কোয়ার্টা সাধারণ মানুষকে এই ওষুধ ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন। তরুণদের এই ওষুধ ব্যবহারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নির বারজিলাইও। তবে কিছু নির্দিষ্ট বয়সের মানুষের ক্ষেত্রে তার মতামত ভিন্ন; তিনি তার বৃদ্ধ বন্ধুবান্ধবদের পরামর্শ দেন, তারা যেন চিকিৎসকের কাছে গিয়ে মেটফরমিন সম্পর্কে জেনে আসে।
সূত্র: (ইনসাইডার-এর প্রতিবেদন থেকে ঈষৎ সংক্ষেপে অনূদিত)