‘ডোডোর প্রত্যাবর্তন’: বিজ্ঞানীরা কেন বিলুপ্ত প্রাণী ফিরিয়ে আনতে চাইছেন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে অবস্থিত কলোসাল বায়োসায়েন্সেস নামক একটি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি জানিয়েছেন, তারা বিলুপ্ত ডোডো পাখিকে আবারও পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন। ডি-এক্সটিংশন প্রক্রিয়ায় ১৬৮১ সালে বিলুপ্ত হওয়া ডোডোকে ফেরত আনতে চান তারা। বিজ্ঞানীরা কেন বিলুপ্ত প্রজাতিগুলোকে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছে দ্য উইক।
ডি-এক্সটিংশন কী? এটি কীভাবে কাজ করে?
ডি-এক্সটিংশনকে 'পুনরুত্থান জীববিজ্ঞান' (রিসারেকশন বায়োলজি) বা 'পুনরুজ্জীবন'ও (রিঅ্যানিমেশন) বলা হয়। এ প্রক্রিয়ায় বিলুপ্ত হওয়া কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের নিকট সম্পর্কিত কোনো জীবিত প্রজাতির জিনতত্ত্ব ব্যবহার করে বিলুপ্তিকে উল্টে দেওয়ার কাজ করা হয়।
কলোসাল বায়োসায়েন্সেস কোম্পানি ডোডো পাখি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। সাধারণত বিলুপ্ত প্রাণীর পুনরুজ্জীবন দেওয়ার সবচেয়ে পরিচিত পদ্ধতি হলো ক্লোনিং। এছাড়া ব্যাক-ব্রিডিং ও জিনোম সম্পাদনাও এ শ্রেণীতে পড়ে।
সিলেক্টিভ ব্যাক-ব্রিডিং প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানীরা এমন কোনো প্রজাতিকে খুঁজে বের করেন যেটি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীর কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। ক্লোনিং পদ্ধতিতে গবেষকেরা 'জিনগতভাবে সমরূপ জৈবিক জীবনের অনুরূপ' সৃষ্টি করেন।
কিন্তু ক্লোনিং পদ্ধতি কেবল বিলুপ্তির মুখে থাকা প্রজাতিগুলোর ওপর প্রয়োগ করা সম্ভব। যেসব প্রাণী বা উদ্ভিদ ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তাদেরকে ক্লোনিং পদ্ধতিতে ফেরানোর কোনো পথ নেই।
জিনোম সম্পাদনা প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞানীরা কোনো জৈবিক সত্তার 'ডিএনএ সিকোয়েন্স মুছে ফেলে, প্রতিস্থাপন করে বা প্রবেশ করিয়ে' জিনগত উপাদানে ইচ্ছামতো পরিবর্তন আনেন। এ পদ্ধতিতে ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা একটি বিলুপ্ত প্রাণী ও তার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত জীবিত কোনো প্রাণীর মধ্যে সংকর তৈরি করতে পারেন।
'ডি-এক্সটিংশন নামটা একপ্রকার ভুল প্রয়োগ,' এক প্রতিবেদনে ব্যাখ্যা করেছে বিজ্ঞানবিষয়ক ওয়েবসাইট গিজমোডো। এ প্রক্রিয়ায় কোনো বিলুপ্ত প্রাণীকে পুরোপুরি এর অতীতের রূপে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। বরং এক্ষেত্রে পুনরুজ্জীবিত করা প্রাণীটি এর পূর্বপুরুষের জিনগত, আচরণগত, ও মনস্তাত্ত্বিক গুণের সবটুকু পায় না। ফলে যেটাকে বিজ্ঞানীরা বিলুপ্তি থেকে ফিরিয়ে আনা বলছেন, সেটা আদতে ওসব বিলুপ্ত প্রাণীর ঘনিষ্ঠ প্রতিলিপি।
কলোসাল কী করছে?
ইউনিভার্সিটি অভ ক্যালিফোর্নিয়া, সান্টা ক্রুজ-এর অধ্যাপক ও কলোসাল-এর প্রধান জীবাশ্মবিদ বেথ শাপিরো জানান, তিনি ও তার গবেষকদল ইতোমধ্যে ডোডো প্রত্যাবর্তন প্রকল্পের প্রথম ধাপ সম্পন্ন করেছেন। ডেনমার্কে থাকা ডোডো পাখির অবশিষ্টাংশ থেকে সংগ্রহ করা জিনগত উপাদান ব্যবহার করে তারা পাখিটির ডিএনএ থেকে এর সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স তৈরি করেছেন।
এরপর তারা এ জিনোমকে ডোডোর সবচেয়ে কাছের আত্মীয় নিকোবর কবুতর ও আরেক বিলুপ্ত পাখি রদ্রিগেজ সলিটারির জিনোমের সঙ্গে তুলনা করে দেখবেন। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে তারা জানতে পারবেন কোন মিউটেশন প্রক্রিয়ার ফলে নতুন ডোডো পাখির জন্ম দেওয়া সম্ভব হবে।
বিলুপ্ত প্রাণীকে সঞ্জীবনের পাশাপাশি কলোসাল বিপন্নপ্রায় প্রজাতির জিনগত উপাদান ও ভ্রূণ সংরক্ষণে একটি লাইব্রেরিও তৈরি করার পরিকল্পনা করেছে। ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন বিনিয়োগকারীর কাছ থেকে ২২৫ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে মার্কিন এ কোম্পানিটি।
আর কোন প্রাণীকে পুনরুজ্জীবন দিতে চাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা
ডোডোর পাশপাশি কলোসালের ডি-এক্সটিংশন পরিকল্পনায় লোমশ ম্যামথ ও তাসামানিয়ান টাইগারও রয়েছে। টাউরোস প্রোগ্রাম নামক আরেকটি ভিন্ন প্রকল্পের অধীনে সিলেক্টিভ ব্যাক-ব্রিডিং প্রক্রিয়ায় অরোচ নামক আরেকটি বিলুপ্ত ক্যাটল প্রজাতির প্রাণীর জিনগত বৈশিষ্ট্য পুনরুত্থানের চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা।
এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় কোয়াগা প্রজেক্টের অধীনে জেব্রা ব্যবহার করে ২০০ বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া কোয়াগার জন্ম দিতে চাইছেন বিজ্ঞানীরা। ২০০৩ সালে স্পেনের বিজ্ঞানীরা সফলভাবে বিলুপ্ত স্প্যানিশ বুনো ছাগলের ক্লোন করেন। তবে ফুসফুসের সমস্যার কারণে ওই ক্লোন কেবল কয়েক মিনিট বেঁচে ছিল।
কেন এ পুনরুজ্জীবন?
পুনর্জীবনের পক্ষের লোকেরা বলছেন এটি প্রজাতি সংরক্ষণের একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জিনতত্ত্ব বিষয়ের অধ্যাপক জর্জ চার্চের মতে, 'এর লক্ষ্য হচ্ছে বৈষ্ণিক উষ্ণায়নের মতো আধুনিক কঠিন পরিবেশগত পরিবর্তনের সঙ্গে বর্তমান বাস্তুতন্ত্রকে খাপ খাইয়ে নেওয়া এবং পরিবেশের এ পরিবর্তনগুলোকে বিপরীতগতি দেওয়ার চেষ্টা করা।'
যেমন, লোমশ ম্যামথকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনলে আর্কটিক অঞ্চলকে কিছুটা ঠান্ডা রাখা যাবে। কারণ এ ম্যামথ মরা ঘাস ঘেয়ে ফেলবে, যার ফলে সূর্যালোক নতুন ঘাসে পৌঁছাতে পারবে; গাছ উপড়ে ফেলে সূর্যালোকের প্রতিফলন বাড়াতে সহায়তা করবে। এছাড়া কলোসালের দাবি, এ ধরনের প্রাণী আবার পৃথিবীতে এগুলোর নিজস্ব আবাসস্থলে বিচরণ করলে স্থানীয় অর্থনীতিতে তার ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
কোনো অসুবিধা আছে এতে?
সমালোচকেরা মনে করেন, ডি-এক্সটিংশন প্রক্রিয়ায় যে পরিমাণ অর্থ ও সময় ব্যয় করা হচ্ছে তা বিপন্ন প্রাণীদের সংরক্ষণের পেছনে আরও ভালোভাবে ব্যয় করা যেত।
আরেকদল সমালোচকের দাবি, বিলুপ্ত প্রাণীগুলোর প্রকৃত আবাসস্থল এখন আর পৃথিবীতে টিকে নেই। এছাড়া আধুনিক পরিবেশ এসব প্রাণীর জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।
ভ্যাংকুভারের ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার আদিবাসী বিষয়ক গবেষক ও প্রাণী সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদ ড্যানিয়েল হিথ জাস্টিস ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর কাছে ডি-এক্সটিংশন কীভাবে ইনুইত আদিবাসীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে সে বিষয়ে তার উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছিলেন।