বিজয় এসেছে, এবার ভোরের প্রতীক্ষা; নতুন সুবোধ গ্রাফিতি
সুবোধের বয়স এখন সাত। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আগারগাঁওয়ের এক দেওয়ালে প্রথম সুবোধের দেখা পায় নগরবাসী। তার লম্বা চুল এলোমেলো, মুখে বহুদিনের না কামানো দাড়ি, উদোম গা। বাঁ পা বাড়িয়ে ডান দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে দর্শকের দিকে। হাতে তার একটি খাঁচা, তার ভেতরে বন্দি সূর্য। পাশে লেখা: 'সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই।'
মাসখানেক পরে একই দেওয়ালে আরেকবার সুবোধের দেখা মেলে। তাতে সূর্যবন্দি খাঁচাটা পাশে রেখে সুবোধ ডান হাতে কপাল চাপড়াচ্ছে। আগের কথাগুলো এখানেও লেখা: সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই। নিচে শিল্পীর স্বাক্ষরমতো করে লেখা 'হবেকি?'
এর দিনকয়েক পরেই আবার সুবোধ উপস্থিত। এবারে বলা হচ্ছে, 'সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না।' বাড়তি আরেকটি কথা যোগ করা হয়েছে: 'মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে।' দু-তিনদিনের ফারাকে আবার সুবোধ হাজির হলো গরাদের শিক ধরে দাঁড়িয়ে। শিল্পী 'হবেকি?' এখানে বলছেন, 'সুবোধ এখন জেলে। পাপবোধ নিশ্চিন্তে করছে বাস মানুষের হৃদয়ে।'
এবার কিন্তু মানুষের নড়েচড়ে বসতে হলো। তাকাতে হলো নিজের ভেতরে, হৃদয়ের অভ্যন্তরে, যেখানে কালিমা জমা পড়েছে। তার ফলে সুবোধ বিতাড়িত, বন্দি হয়ে গুমড়ে মরছে জেলখানার ভেতরে।
কে এই সুবোধ? হঠাৎ কেন দিলো হানা? যানজট ঠেলে, দ্রব্যমূল্যের ঘা খেয়ে, সিন্ডিকেটের ডান্ডায় ঠান্ডা বাঁধিয়ে চলেই তো যাচ্ছিল — তবে আর কেন সুবোধ বা শুভবুদ্ধির ধোঁয়া দেওয়া! আর সুবোধ ব্যাটা দেখতেই বা এমন হতচ্ছাড়া কেন?
এর উত্তর অবশ্য সুবোধ নিজেই দিচ্ছে। সুবোধ বা শুভবুদ্ধির আবাসস্থল হলো মানুষের হৃদয়। ভালোবাসা, প্রীতি, শুভেচ্ছা তাকে পুষ্ট করে। এগুলো না থাকলে সে হয়ে ওঠে জীর্ণ-শীর্ণ। পাপবোধ যখন শুভবোধের জায়গা দখল করে নেয়, তখন সুবোধ পালানোর পথ খুঁজতে থাকে। পরের ছবিগুলোতে আমরা তারই প্রকাশ দেখব।
সুবোধ একটি চরিত্র, গ্রাফিতি চরিত্র। গ্রাফিতি হলো দেয়ালচিত্র। এর আরেক নাম হচ্ছে আউট-ল আর্ট। সমসাময়িক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সংকটের কথা বলা হয় এতে। সুবোধের সঙ্গে সঙ্গে এর শিল্পীকে নিয়েও তুমুল আগ্রহ তৈরি হয় সাধারণ মানুষের মধ্যে। তখন 'হবেকি?' গ্রাফিতি ফ্যানস পেইজে জানানো হলো, 'অনুগ্রহ করে আমাকে খুঁজবেন না। আমি নই, আমার শিল্প গুরুত্বপূর্ণ। রাস্তার দেওয়ালে আমার ছবিকে খুঁজুন। বোঝবার চেষ্টা করুন।'
যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত স্ট্রিট পেইন্টার ব্যাঙ্কসির সঙ্গেও অনেকে 'হবেকি?'-এর মিল খুঁজেছেন। ব্যাঙ্কসি নামটিও ছদ্ম। গ্রাফিতি বা স্ট্রিট আর্টের ব্যাপারে রাষ্ট্রের আপত্তি থাকে বলে নাম লুকোলে শিল্পীর কাজের সুবিধা হয়। সুবোধ সিরিজ দেখলে মনে হওয়া স্বাভাবিক, 'হবেকি?' ব্যবস্থার পরিবর্তন চান। যে ব্যবস্থা অত্যাচারীকে প্রশ্রয় দেয়, দুর্নীতিবাজদের আগলে রাখে, পাচারকারীদের নিরাপত্তা দেয়, সে ব্যবস্থার পরিবর্তন চান তিনি। তার জন্য সুবোধ তার আশ্রয়। কিন্তু নিপীড়িত, হতচ্ছাড়া সুবোধ কি পারবে শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে?
সুবোধের কাছে অবশ্য একটা বড় অস্ত্র আছে। সেটা হলো সূর্য। 'হবেকি?' বলতে চান, শুভবোধ আলোর জন্ম দেয়, পাপবোধ অন্ধকার তৈরি করে। কিন্তু অন্ধকার আলো কেড়ে নিতে পারে না, বরং আলো অন্ধকার দূর করতে পারে। তাই সুবোধের কাছে থাকা সূর্য বিরাট এক হাতিয়ার।
তাহলে শিল্পী কেন পালাতে বলছেন সুবোধকে? কারণ অন্ধকার অত্যন্ত গভীর আর সুদূর অবধি বিস্তৃত। তাই ভোর না গড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা করা জরুরি। একটি ছবিতে খাঁচাবন্দি সূর্য নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াতেও দেখা যায় সুবোধকে।
শিল্প পরিচর্যাকারী প্রতিষ্ঠান আর্টকনের প্রধান নির্বাহী এআরকে রীপন বলেন, "সুবোধ একটি ধারাবাহিক প্রকল্প, একটি সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য রেখে শিল্পী কাজ করে চলেছেন। ২০১৭ সালে যখন অনেক আলোচনার জন্ম দিলো সুবোধ, তারপরে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শিল্পীকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়িয়েছে।
"সুবোধ গ্রাফিতিতে মোরগের (যার ডাকে ভোর আসে) মতো প্রতীকও আছে, তাই সরকারের চিন্তিত হওয়ার কারণ ছিল। আর তখনকার কর্তৃত্ববাদী সরকার স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে ছিল। তাই প্রায় দুই বছর আমরা 'হবেকি?'-এর কোনো গ্রাফিতি দেখিনি।"
পরে সুবোধকে দেখা যায় একটু বিশ্রাম নিতে। একটি বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে সে তখন সুখ-দুঃখের আলাপে ব্যস্ত। মেয়েটা সুবোধকে জিজ্ঞেস করছে, সুবোধ কবে ভোর হবে?
"এ সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সুবোধ এ প্রথম একজন সঙ্গী পেল। মেয়েটির প্রশ্ন সুবোধকে আরও প্রত্যয়ী করে তোলে। মেয়েটি তাকে স্থিতি দেয়, সুবোধ নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, ভোর আনতেই হবে। তাই পরের গ্রাফিতিতে লেখা থাকতে দেখি, 'তবুও সুবোধ রাখিস সূর্য ধরে,'" বলেন রীপন।
রীপন আরও বলেন, 'সুবোধ যতই আলুথালু হোক, আত্মবিশ্বাসে দৃঢ়। পাগলাটে হলেও সচেতন। তার যাত্রা দেশকালের গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যেখানে আলো দরকার সেখানে সে ঠিকই পৌঁছে যাবে। সে জানে অন্ধকার যতই গভীর হোক তা দূর হবে।'
গরাদ ভাঙার পর থেকে সুবোধের মহাকাব্যিক যাত্রা শুরু হয়। সে যাত্রা পালিয়ে বেড়ানোর, আলো আগলে রাখার। সুবোধ চলচ্চিত্রের চরিত্র নয় বরং ঘটনা তাকে জন্ম দেয়, ঘটনার প্রেক্ষিতে সে কথা বলে ওঠে, ঘটনার দিকে মানুষের নজর ফেরায়। হাতে আলো থাকার কারণে সে সুপারম্যান, আলোপ্রত্যাশী সবাই তাই তার মিছিলে শামিল হয়। আবার আলো-আকাঙ্ক্ষী বলে সে সবার মতো একজন সাধারণ মানুষও।
সুবোধ যেমন দুঃখী, তেমনই আবার রোমান্টিক। পালিয়ে যাওয়া তার নিয়তি নয় বরং কৌশল। সে কথা বলে উল্টোদিক থেকে। মানুষ ভালোবাসতে ভুলে গেছে অর্থ হলো ভালোবাসা মানবিক গুণ কিংবা সময় পক্ষে নেই।
দেয়ালচিত্র বা গ্রাফিতির মালিক কেউ হয় না, তাই সুবোধকেও দেখা যায় না গ্যালারির চারদেওয়ালের ভেতরে। তাকে পাওয়া যায় পথের ধারে। সে হাজির হয় যাত্রাপালার বিবেকের মতো। বলে, সময়কে পক্ষে আনো। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ও প্ল্যাকার্ডে লেখা দেখা গেছে: 'সুবোধ এখন রাস্তায়!'
গেল ৬ আগস্ট, শেখ হাসিনার পতনের পরের দিন, সুবোধ গ্রাফিতি আবার দেখা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির মেট্রোস্টেশনের দেওয়ালে। খুব রাগী এবারের সুবোধ। তাণ্ডব চালাচ্ছে যেন কালভৈরব। এমন সুবোধ আগে কখনো দেখা যায়নি। লাথি মেরে উলটে দিচ্ছে শাসকের চেয়ার বা গদি। সাত বছরের মাথায় এসে সুবোধ বুঝি করণীয় খুঁজে পেয়েছে, সহস্র প্রাণে জ্বেলে দিয়েছে আলো। সে আলোয় দূর হয়েছে অন্ধকার। এ সুবোধের মাথায় মুকুটও দেখা যাচ্ছে। সুবোধ কি তবে শাসক হয়ে উঠল?
রীপন বলেন, 'শাসক তো সুবোধেরই হওয়ার কথা। নির্বোধ শাসক হলে দুর্দশার অন্ত থাকে না। 'হবেকি?' বলতে চাইছেন, শাসকের চেয়ারে বসতে হলে তোমাকে সুবোধই হতে হবে, নইলে অনর্থ ঘটে যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে বিজয় আর ভোর এক কথা নয়। বিজয় এসেছে, কিন্তু ভোর আনতে আরও পথ পাড়ি দিতে হতে পারে।'
ছবি: হবেকি গ্রাফিতি ফ্যানস/ফেসবুক