ফিরে দেখা ২০২১: কেমন ছিল এ-বছরের চলচ্চিত্র?
চলে যাওয়ার পথে ২০২১। দোরগোড়ায় এসে হাজির ২০২২। নতুন বছরটিকে বরণ করে নেওয়ার আগে, আমাদের পেছনে ফিরে তাকানো জরুরি। এখানে কথা হবে সেরকম একটি ক্ষেত্র নিয়েই। ২০২০ এর শুরুতে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে শুধু স্বাস্থ্য-ব্যবসা-বাণিজ্যের নানান ক্ষেত্রই নয়, বরং শিল্পকলার বিভিন্ন অঙ্গনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সিনেমার ক্ষেত্রে সমস্যাটি খুব প্রকটভাবে দেখা দিয়েছিল। একে একে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে থাকা সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, ফিল্ম ফেস্টিভালগুলোর দিনক্ষণ পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। গ্লোবাল বক্স অফিসে কয়েকশ বিলিয়ন ডলারের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেসময়। কিন্তু ২০২১ এ এসে প্যান্ডেমিকের সেই ক্ষয়ক্ষতিকে অনেকটাই পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিগুলো।
চলচ্চিত্রের জন্য ২০২১ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং উর্বর একটি সময়। চলতি বছরে বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে আমরা পেয়েছি অসংখ্য ভালো ফিল্ম। পাশাপাশি বিকল্পধারার চলচ্চিত্রের জন্যও নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে গেছে। লেখাটিতে ২০২১ এর বহুল প্রত্যাশিত, আলোচিত এবং প্রতীক্ষিত কিছু চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলা হবে। আমাদের মনে রাখা জরুরি যে কোনো তালিকাই সম্পূর্ণ নয়। স্বাভাবিকভাবেই প্রতিনিয়ত সেখানে নতুন কিছু যোগ হবে, পুরোনো কিছু বাদ যাবে। তবে সামগ্রিক একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তালিকাটি তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে।
১. দ্য পাওয়ার অভ দ্য ডগ: থমাস স্যাভেজের ১৯৬৭ সালের বইয়ের ওপর নির্মিত এ অ্যান্টি-ওয়েস্টার্নটি এবছরের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র। ১৯২০-র দশকে যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানায় দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্বকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে এর ঘটনাপ্রবাহ। মূল ভূমিকায় থাকা বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ এখন পর্যন্ত তার ক্যারিয়ারের সেরা পারফর্মেন্সটি দিয়েছেন। পাশাপাশি কোডি স্মিট-ম্যাকফি, কারস্টেন ডানস্ট, জেসি প্লেমন্সকেও দেখতে পাওয়া যাবে এখানে। ওয়েস্টার্ন ঘরানার চলচ্চিত্রের অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক: পুরুষের মাচো পারসোনালিটি কিংবা পৌরুষ; সেটিকেই যেন ভাঙবার প্রয়াসে এগিয়েছেন ছবিটির নির্মাতা জেন ক্যাম্পিয়ন।
২. ড্রাইভ মাই কার: জাপানিজ এই ফিল্মটি প্রখ্যাত সাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির ছোটগল্প সংকলন 'ম্যান উইদাউট উইম্যান' (২০১৪) -র একই নামের ছোটগল্পের ওপর নির্মিত। বিপত্নীক এক ব্যক্তি এবং তার গাড়ির চালক ২৩ বছর বয়সী তরুণীর কথোপকথনের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে এর গল্প। শুরুতে তাদের দু'জনের বনিবনা না হলেও দ্রুতই তা পাল্টাতে থাকে। রিয়োসুকে হামাগুচি'র প্রায় তিন ঘণ্টার এই ড্রামা ফিল্ম কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যসহ জিতে নিয়েছিল তিনটি পুরস্কার। ডিসেম্বরে অস্কারের বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগের সংক্ষিপ্ত তালিকায়ও জায়গা করে নিয়েছে এটি। নিঃসন্দেহে এটি এবছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের একটি।
৩. স্পাইডার-ম্যান: নো ওয়ে হোম: মার্ভেল সুপারহিরো স্পাইডার-ম্যানের সাথে দর্শককে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়া অনেকটা নিষ্প্রয়োজন। স্পাইডার-ম্যানের আসল পরিচয় জনসমক্ষে এসে পড়ায় সে ডক্টর স্ট্রেঞ্জের কাছে সাহায্য চায়। জন ওয়াটস নির্মিত স্পাইডার ম্যানের তারকাবহুল এ নতুন কিস্তিতে টম হল্যান্ড, জেন্ডেয়া, বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ, উইলেম ডেফো, আল্ফ্রেড মোলিনা, জেমি ফক্স, মারিসা টোমেই, টোবি ম্যাগিয়ের, অ্যান্ড্রু গারফিল্ডদের দেখা মিলেছে। স্পাইডারম্যান মাল্টিভার্সের একটি নমুনা এতে খুঁজে পাবেন দর্শক। শৈশবের স্মৃতিকাতরতায় পরিপূর্ণ এ মুভি ভক্তকূলকে মোটেও নিরাশ করেনি। ইতোমধ্যেই বক্স অফিসে বাজেটের প্রায় চার গুণ বেশি আয় করে এবছর সর্বাধিক আয় করা ৩য় মুভি হিসেবে নাম লিখিয়ে নিয়েছে এটি।
৪. ড্যুন: ফ্র্যাংক হারবার্টের 'ড্যুন' (১৯৬৫)-র ওপর ভিত্তি করে নির্মিত মার্কিন এই এপিক এবছরের সবচেয়ে প্রত্যাশিত ফিল্মের একটি ছিল। শক্তিশালী পরিবারের সন্তান পল আট্রেইডিস নিজেও অত্যন্ত প্রতিভাধর। নিজের পরিবার ও মানুষদের জন্য তাকে অত্যন্ত দুর্গম এক পথ অতিক্রম করতে হবে। নিজের ভয়কে জয় করতে পারাই সেই পথ পাড়ি দেওয়ার পূর্বশর্ত। এটিই ড্যুন পার্ট ১ এর ঘটনাপ্রবাহ। এটি পরিচালনা করেছেন ডেনি ভিলনেভ। অভিনয়ে আছেন টিমোথি শ্যালামে, রেবেকা ফার্গুসন, স্টেলান স্কার্সগার্ড, অস্কার আইজ্যাক, জেন্ডেয়া, হাভিয়ের বারদেম। ২০২৩ সালে এর সিক্যুয়েল আসবে তা-ও ইতোমধ্যে নিশ্চিত হয়ে গেছে।
৫. লিকোরিস পিজ্জা: চলতি বছরের চলচ্চিত্রগুলোর প্রতিটি তালিকাতেই শীর্ষস্থানে থাকছে পল থমাস অ্যান্ডারসনের এই কমেডি ড্রামা ফিল্মটি। প্রেক্ষাপট হিসেবে এখানে ব্যবহার করা হয়েছে ১৯৭০'র দশকের ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ফার্নান্দোকে। আলানা কেইন এবং গেরি ভ্যালেন্টাইন নামক দু'জন চরিত্রকে কেন্দ্র করে এর গল্প এগিয়ে গেছে। অ্যান্ডারসন সেসময়ের ক্যালিফোর্নিয়ার যে চিত্রটি এঁকেছেন তা সমসাময়িক অন্যান্য চলচ্চিত্রের চেয়ে আরো অনেক বাস্তবসম্মত। মূল ভূমিকায় অভিনয় করা গায়িকা আলানা হাইম এবং কুপার হফম্যান দু'জনের এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে অভিষেক ঘটলেও তাদের অভিনয়ের দক্ষতা দেখে তা বুঝবার উপায় নেই। পর্দায় তাদের রসায়নটা খুবই সাবলীল। পার্শ্বচরিত্রে আছেন ব্র্যাডলি কুপার।
৬. দ্য হ্যান্ড অভ গড: এই নেটফ্লিক্স অরিজিনালটি পরিচালনা করেছেন পাওলো সোরেন্টিনো। প্রেক্ষাপট ১৯৮০-র দশকের ইতালির নাপোলি; সেখানে ১৭ বছর বয়সী এক অন্তর্মুখী কিশোরকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে এর গল্প। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় পূর্ণ মর্মস্পর্শী এ ইতালীয় ড্রামা ফিল্মটি ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে জিতে নিয়েছিল গ্র্যান্ড জুরি পুরস্কার। পর্দায় নিজের কৈশোরকেই তুলে ধরেছেন সোরেন্টিনো।
৭. ফ্লি: অ্যানিমেশনের আদলে একটি সত্যিকার ঘটনার চিত্রায়ণ করা হয়েছে এতে। আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত এ ডকুমেন্টারিটি এবছরের শীর্ষস্থানীয় সিনেমার একটি। আমিন নাওয়াবি নামের একজন ব্যক্তি নিজ দেশ আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে ডেনমার্কে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি ফিচারটিতে প্রথমবারের মতো তার অতীতের কথা বলছেন। চলচ্চিত্র উৎসব এবং সমালোচকদের কাছ থেকে বিষয়বস্তু, অ্যানিমেশন এবং গল্পের জন্য প্রশংসা কুড়িয়ে নেওয়া এ মুভিটি পরিচালনা করেছেন ইয়োনাস পোহের রাসমুসেন।
৮. দ্য ওর্স্ট পারসন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড: নরওয়েজিয়ান ডার্ক রোমান্টিক কমেডি-ড্রামা ফিল্মটি ইয়োকিম ট্রিয়েরের 'অসলো ট্রিলজি'-র শেষ কিস্তি। জুলি নামের এক তরুণী ব্যক্তি ও কর্মজীবন একসাথে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন; তার নিজেকে চেনার একটি গল্প এটি। জুলি চরিত্রে অভিনয় করে রেনাটে রাইন্সভে কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন।
৯. দ্য গ্রিন নাইট: বড়দিনে কিং আর্থারের বৈঠকে এসে হাজির হয় প্রকাণ্ড এক সবুজরঙা আগন্তুক। সে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় আর্থারের সভাসদের ওপর। সেটি গ্রহণ করে দুঃসাহসিক এক অভিযানে পাড়ি দেন কিং আর্থারের গোলটেবিলের সদস্য এবং তার ভ্রাতৃজ স্যার গাওয়াউইন। পথিমধ্যে তিনি দৈত্য-দানবসহ নানা বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হন। মধ্যযুগীয় সেই গল্পকেই পর্দায় নতুনভাবে বলার চেষ্টা করেছেন ডেভিড লাওয়ারি। কিং আর্থারের কিংবদন্তির ওপর নির্মিত ফিল্মটির মূল ভূমিকায় আছেন দেব প্যাটেল। পার্শ্বচরিত্রগুলোতে দেখা গেছে অ্যালিসিয়া ভিকান্দার, শন হ্যারিস, জোয়েল এজারটন, সারিতা চৌধুরীদের। বোদ্ধাদের প্রশংসা পেলেও ফ্যান্টাসিধর্মী চলচ্চিত্রটি এর বিষয়বস্তুর জন্য দর্শককে অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত করে দিয়েছে।
১০. টিটানে: জুলিয়া দুকর্নো নির্মিত ফরাসি এ হরর ফিল্ম ইতোমধ্যেই ভক্ত এবং সমালোচকদের মাঝে সাড়া জাগিয়েছে৷ চলতি বছরে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এককভাবে নারী পরিচালক হিসেবে দুকর্নো পাম দ'র জয় করে নেন এর জন্য। ছবির শুরুতেই অ্যালেক্সিয়া নামক একজন নারীকে দেখা যায়। শৈশবে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হওয়ার কারণে তার মাথায় টাইটেনিয়ামের প্লেট স্থাপন করা হয়েছিল৷ সেখান থেকেই ছবির নাম টিটানে। এতে অ্যালেক্সিয়া চরিত্রে অভিনয় করেছেন নবাগত শিল্পী আগাথ রুসেল। এছাড়াও আছেন ভিন্সেন্ট লিন্ডন, গ্যারেন্স মারিলিয়েঁ প্রমুখ।
১১. নো টাইম টু ডাই: শান্তিতে বন্ড তার পরিবারের সাথে বসবাস করছিলেন জ্যামাইকায়। কিন্তু পুরোনো গোয়েন্দা বন্ধুর আগমনে তা আর স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পায়নি, অপহৃত বিজ্ঞানীকে উদ্ধারের নতুন মিশনে নামেন বন্ড। ২৫ তম এ বন্ড মুভিটি পরিচালনা করেছেন ক্যারি জোজি ফুকুনাগা। জেমস বন্ড হিসেবে ড্যানিয়েল ক্রেইগের শেষ মুভি ছিল এটি। ক্রেইগ ছাড়াও এতে আছেন লেয়া সেড্যুঁ, র্যামি মালেক, আনা ডি আরমাস, জেফ্রি রাইট প্রমুখ।
১২. পেটিট মামান: সেলিন সিয়ামার ফরাসি এ ফ্যান্টাসিধর্মী ফিল্ম দু'জন শিশুকে নিয়ে। আট বছরের শিশু নেলি তার প্রিয় নানীর মৃত্যুর পর কীভাবে সেটির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে, সেটিরই এক হৃদয়-নিংড়ানো গল্প দেখিয়েছেন সিয়ামা। বনের মধ্যেই আরেকজন শিশুর সাথে পরিচয় হয় তার। শিশুশিল্পী গ্যাব্রিয়েল এবং জোসেফিন সাঞ্জের নজরকাড়া অভিনয় সমালোচক এবং ভক্তদের মন জয় করে নিয়েছে।
১৩. আনেট: লিওস কারাক্সের এ মিউজিক্যালের ঘটনাপ্রবাহ আবর্তিত হয়েছে এক দম্পতিকে ঘিরে। প্রথম শিশুর আগমনের পর তাদের বৈবাহিক জীবন কীভাবে আমূলে পাল্টে গেল সে-ই গল্পই এখানে বলা হয়েছে ছন্দ কিংবা গানের মাধ্যমে। এতে অভিনয় করেছেন অ্যাডাম ড্রাইভার, মারিয়ন কোটিয়াঁ, সাইমন হেলবার্গ প্রমুখ।
১৪. স্পেন্সার: প্রিন্সেস ডায়ানা এবং প্রিন্স চার্লসের বৈবাহিক জীবনের শেষদিক, ইতোমধ্যেই চারপাশে তাদের ভাঙনের গুঞ্জন ওঠেছে। কিন্তু বড়দিনের ছুটিতে পারিবারিক মহলে তারা সবকিছু স্বাভাবিক এমনটাই বোঝানোর চেষ্টা করছেন। সেই উত্তাল সময়েরই একটি কাল্পনিক চিত্রায়ণ দেখতে পাওয়া যায় এখানে। পাবলো লারাইনের এ হিস্ট্রিকাল সাইকোলজিক্যাল ড্রামায় লেডি ডিয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ক্রিস্টেন স্টুয়ার্ট। ডায়ানার অন্তঃদ্বন্দ্ব ও তার বহিঃপ্রকাশকে পর্দায় অত্যন্ত সুচারুরূপে তুলে ধরার জন্য সমালোচকদের প্রশংসাও পেয়েছেন তিনি।
১৫. দ্য লাস্ট ড্যুয়েল: রিডলি স্কটের চিন্তা উদ্রেককারী এ চলচ্চিত্র হতাশাজনকভাবেই বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রতিশোধের এ গল্পটি আরেকটি ক্লাসিক চলচ্চিত্র, আকিরা কুরোসাওয়ার রাশোমনের, কথা দর্শককে স্মরণ করিয়ে দেবে। তিনজন ব্যক্তির তিনটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তিনটি নির্দিষ্ট ভাগে দেখানো হয়েছে এখানে যার প্রত্যেকটিই আরেকটির চেয়ে ভিন্ন কিংবা কখনো সাংঘর্ষিকও৷ এপিক হিস্ট্রিকাল এ ড্রামাতে অভিনয় করেছেন ম্যাট ডেমন, জোডি কোমার এবং অ্যাডাম ড্রাইভার।
১৬. বেলফাস্ট: পরিচালক কেনেথ ব্রানাহ'র নিজের শৈশবের ওপর নির্মিত এ সেমি-অটোবায়োগ্রাফিকাল ফিল্মে দেখতে পাওয়া যায় ষাটের দশকের আয়ারল্যান্ডের বেলফাস্টকে। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের এ নগরীতে উত্তপ্ত একটি সময় কেটেছে তখন। এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল প্রায় ত্রিশ বছর৷ সংকটকালে বাডি নামের একটি ছেলে তার পরিবার এবং পরিপার্শ্বের আবর্তে কীভাবে দিনযাপন করছে, তা-ই এর মুখ্য বিষয়। বাডি চরিত্রে পর্দায় অভিষেক ঘটেছে শিশুশিল্পী জুড হিলের, এছাড়াও এতে অভিনয় করেছেন ক্যাট্রিনা ব্যাল্ফ, জেইমি ডোরনান, কিয়ারান হাইন্ডস, জুডি ডেঞ্চ প্রমুখ।
১৭. পিগ: পোর্টল্যান্ডে একসময় শেফ ছিলেন রব ফেল্ড। দীর্ঘদিন বনে নির্জন একটি কেবিনে থাকার পর তিনি আবার ফিরে এসেছেন, কে তার পোষা শিকারি প্রাণীকে চুরি করেছে, তাকে খুঁজে বের করতে। এটিই 'পিগ' মুভির সারসংক্ষেপ। মাইকেল সারনোস্কি'র পরিচালক হিসেবে অভিষেক ঘটেছে এ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। মার্কিন এ ড্রামায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে বেশ প্রশংসা পেয়েছেন নিকোলাস কেজ।
১৮. নিট্রাম: জীবনীভিত্তিক এই অস্ট্রেলিয়ান ড্রামায় 'নিট্রাম' নামের এক বিকৃত তরুণের জীবনের বিভিন্ন বাঁককে দেখানো হয়েছে। মুভিটি মার্টিন ব্রায়ান্টের জীবনের ওপর নির্মিত। ১৯৯৬ সালে ব্রায়ান্ট অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়ায় ৩৫ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছিলেন, ইতিহাসে এটি 'পোর্ট আর্থার ম্যাসাকার' নামে পরিচিত। নিট্রাম চরিত্রের একাকিত্ব, হতাশা এবং বিকৃত মনমানসিকতা পর্দায় নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলার কারণে ক্যালেব ল্যান্ড্রি জোনস এবছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন। সাইকোলজিক্যাল মুভিটি পরিচালনা করেছেন জাস্টিন কারজেল।
১৯. দ্য ফ্রেঞ্চ ডিসপ্যাচ: সিনেমায় নিজের বিশেষ ভিন্নধর্মী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য মার্কিন মুলুকে ওয়েস অ্যান্ডারসন 'অট্যুর' নামে পরিচিত। তার এ চলচ্চিত্রেও তিনি সেটির স্বাক্ষরই রেখেছেন। বিংশ শতাব্দীর কাল্পনিক এক ফরাসি শহরকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে এ চলচ্চিত্রটির গল্প। দ্য ফ্রেঞ্চ ডিসপ্যাচ নামক পত্রিকার শেষ ইস্যুটি বের হতে যাচ্ছে। সেটিকেই পর্দায় দেখিয়েছেন অ্যান্ডারসন। বিখ্যাত মার্কিন ম্যাগাজিন 'নিউ ইয়র্কার'-র ইতিহাস এবং এর প্রখ্যাত সাংবাদিকদের ঘটনাপ্রবাহের ওপর নির্মিত ফিল্মটিতে অভিনয় করেছেন বিল ম্যুরে, টিলডা সুইনটন, বেনিসিও দেল তোরো, ফ্রান্সেস ম্যাকডরম্যান্ড, টিমোথি শ্যালামের মতো তারকারা।
২০. লাস্ট নাইট ইন সোহো: এডগার রাইটের নতুন এ মুভিটিতে দেখা মিলবে গত শতাব্দীর ষাটের দশকের জাঁকজমকপূর্ণ লন্ডনের। তবে একইসাথে উঠে এসেছে সেসময়ের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটিও। ব্রিটিশ সাইকোলজিক্যাল হরর এ চলচ্চিত্রের গল্প এগিয়েছে লন্ডনে ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়তে আসা এক তরুণীকে ঘিরে। এতে অভিনয় করেছেন থমাসিন ম্যাকেঞ্জি, আনিয়া টেলর-জয়, ম্যাট স্মিথ, ডায়ান রিগ প্রমুখ।
২১. জুডাস অ্যান্ড দ্য ব্ল্যাক মেসিয়াহ: মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ জাতীয়তাবাদী গেরিলা সংগঠন ব্ল্যাক প্যান্থারের সদস্য ছিলেন তরুণ বিপ্লবী ফ্রেড হ্যাম্পটন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তাকে র্যাডিকাল থ্রেট হিসেবে চিহ্নিত করেছিল এবং মাত্র ২১ বছর বয়সে তাকে হত্যা করা হয়। সেই বাস্তব ঘটনার ওপরই নির্মিত হয়েছে শাকা কিংয়ের এ বায়োগ্রাফিক্যাল চলচ্চিত্র। এতে উঠে এসেছে ফ্রেড হ্যাম্পটন এবং বিল ও'নিলের গল্প। বর্তমান সময়েও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়-নির্ভর এ মুভিতে অভিনয় করেছেন ড্যানিয়েল কালুইয়া, লাকিথ স্টানফিল্ড প্রমুখ।
২২. প্যারালাল মাদার্স: পেদ্রো আল্মোদোভারের স্প্যানিশ এ চলচ্চিত্রটি দু'জন সন্তানসম্ভবা ব্যক্তিকে নিয়ে। হাসপাতালের একটি কক্ষেই তাদের পরিচয় হয়েছে। একজন মধ্যবয়স্কা নারী, কিন্তু আরেকজন কিশোরী এবং ভীতসন্ত্রস্ত। মাতৃত্বের স্বাদ পেতে গিয়ে তাদের দু'জনের মধ্যে গড়ে ওঠে এক অদ্ভুত সুন্দর এবং শক্তিশালী সম্পর্ক। এ ড্রামা ফিল্মটিতে অভিনয় করেছেন পেনেলোপি ক্রুজ, মিলেনা স্মিট প্রমুখ।
২৩. আ হিরো: ধার নেওয়া টাকা পরিশোধ করতে না পারার কারণে কারাগারে বন্দী রহিম৷ এভাবেই শুরু হয়েছে আসগর ফরহাদির নতুন ইরানি ড্রামা থ্রিলারটি। কান চলচ্চিত্র উৎসবে এটি জিতে নিয়েছিল গ্রাঁ প্রিঁ। এতে অভিনয় করেছেন আমির জাদিদি, মোহসেন তানাবান্দেহ, আলিরেযা জাহান্দিদেহ।
২৪. সর্দার উধম: বিপ্লবী উধম সিংহ ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের নিভৃতচারী একজন সৈনিক। তাঁর জীবনকেই পর্দায় জীবন্ত করে তুলেছেন পরিচালক সুজিত সরকার। দু'ঘণ্টা ৪০ মিনিটের এ ভারতীয় ছবিটির গল্প নন-লিনিয়ার ভঙ্গিতে এগিয়ে গেছে - কখনো বর্তমান থেকে অতীতে, আবার অতীত থেকে বর্তমানে। কিন্তু বলিউডের অন্য অনেক চলচ্চিত্রের মতো এটি কোনোকিছুকে বাড়াবাড়ি রকমের গ্লোরিফাই করার চেষ্টা করেনি। বরং সাধারণ একজন মানুষ হয়েও উধম সিংহ কেন অসাধারণ তা-ই বাস্তবসম্মত উপায়ে দেখানোর চেষ্টা করেছে। বিপ্লবী এ চরিত্রটিকে পূঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্দায় তুলে এনেছেন ভিকি কৌশল।
২৫. রেহানা মরিয়ম নূর: বেসরকারি একটি মেডিকেল কলেজের একজন সহকারী অধ্যাপক রেহানা মরিয়ম নূর। পরিবার এবং কর্মস্থল একসাথে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় এ ছবিটি বাংলাদেশের হয়ে ইতিহাস রচনা করেছে। চলচ্চিত্রপ্রেমী পাঠক নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন, প্রথমবারের মতো বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে কান চলচ্চিত্র উৎসবের অফিসিয়াল সিলেকশন বিভাগ 'আঁ সার্তে রিগা'-তে স্থান পায় সিনেমাটি। এর নাম ভূমিকায় অভিনয় করে এশিয়া প্যাসিফিক স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ডসে সেরা অভিনেত্রী নির্বাচিত হয়েছেন আজমেরী হক বাঁধন। শিশুশিল্পী আফিয়া জাহিন জাইমার অভিনয়ও দর্শকদের করেছে মুগ্ধ। এ চলচ্চিত্র দিয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের পরিচিতি যেভাবে বৃদ্ধি পেল, তা থেকে আশা করা যায়, সামনে আমাদের দেশ থেকে আরো ভালো মানের চলচ্চিত্র বেরিয়ে আসবে।
উল্লেখ্য, আলোচ্য তালিকায় নাইটমেয়ার অ্যালি, দ্য ট্রাজেডি অভ ম্যাকবেথ-র মতো মুভিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। কারণ এগুলোর কোনোটিই এখনো বড়ো পরিসরে থিয়েটারে বা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পায়নি। এছাড়া ডোন্ট লুক আপ, কাম'ন কাম'ন, বার্গম্যান আইল্যান্ড, অ্যাবাউট এন্ডলেসনেস, মেমোরিয়া, হোয়াট ডু উই সি হোয়েন উই লুক অ্যাট দ্য স্কাই, ওয়েস্ট সাইড স্টোরি, কিং রিচার্ড, দ্য লস্ট ডটার, সামার অভ সোওল, ল্যাম্ব ইত্যাদির মতো সিনেমা প্রায় সারাবছরই আলোচনায় ছিল।
হলগুলোতে সুপারহিরোভিত্তিক মুভি যেমন: স্পাইডার-ম্যান: নো ওয়ে হোম, শাং চি, ভেনোম: লেট দেয়ার বি কার্নেজ ইত্যাদির প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ এবং জয়জয়কার নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত ছিল চলতি বছরেও। অন্যদিকে, বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে লাস্ট নাইট ইন সোহো, ওয়েস্ট সাইড স্টোরি কিংবা দ্য লাস্ট ড্যুয়েল-র মতো অনেক ফিল্ম। একইসাথে হলে মানুষের আনাগোনা আরো আগে থেকেই কমতে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষ ঝুঁকে পড়ছেন নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম, হইচই-র মতো বিভিন্ন স্ট্রিমিং সার্ভিসের দিকে। সিনেমায় ওটিটি প্ল্যাটফর্মের এই বর্ধিষ্ণু প্রভাব-প্রতিপত্তির ওপর প্রশ্ন তুলছেন অনেক চলচ্চিত্রবোদ্ধাই। তবে এই প্ল্যাটফর্মগুলোর হাত ধরে অনেক ভালো সিনেমা উঠে এসেছে যেটি অবশ্যই সিনেমার জন্য একটি ইতিবাচক দিক।