ইলিউশিন আইএল-৮০: রাশিয়ার মহাপ্রলয়ের বিমান সম্পর্কে বিশ্ব যা জানে
পরমাণু যুদ্ধের পরিণতি ভয়াবহ। এমন যুদ্ধের কালে ধবংসস্তূপে পরিণত হতে পারে বিশ্বের অধিকাংশ জনপদ। তেজস্ক্রিয় বিকিরণে হাজারো বছর প্রাণহীন হয়ে পড়বে পৃথিবীর বিপুল অংশ। বিজ্ঞানীদের এমন সতর্কবাণী সত্ত্বেও দিনে দিনে বাড়ছে সে মহাপ্রলয়ের ঝুঁকি।
এমন মহাসমরের কালে নিজস্ব রাষ্ট্রপ্রধান, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী-সচিবসহ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সুরক্ষিত স্থানে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা পৃথিবীর মাত্র দুটি দেশ: আমেরিকা ও রাশিয়ার হাতে আছে। তারা তৈরি করেছে পরমাণু বোমার আঘাত থেকেও সুরক্ষিত থাকা যাবে এমন বাঙ্কার বা ভূগর্ভস্থ স্থাপনা। ফলে পদস্থ কর্মকর্তারা সুরক্ষিত থেকে যুদ্ধ পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারবেন।
কিন্তু, শক্তিশালী বাঙ্কার থাকাই তো যথেষ্ট নয়। চাই সময় থাকতে, মুহূর্তের নোটিশে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সরিয়ে নেওয়ার বাহন। এক্ষেত্রে উড়োজাহাজই সেরা উপায়। এজন্য রাশিয়ার আছে ইলিউশিন আইএল-৮০ ও আমেরিকার বোয়িং বি-৪ বিশেষ বিমান।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বিশ্ব পরিস্থিতি যখন ঘোলাটে, ন্যাটো দেশগুলো যখন কিয়েভকে অস্ত্র সহযোগিতা ও কূটনীতিক সমর্থন দিয়ে চলেছে, তখন রাশিয়াও হয়তো নিশ্চুপ থাকবে না।
ইউক্রেনে আগ্রাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়েই পশ্চিমা দেশগুলোকে এই সংঘাতে নাক গলালে চরম পরিণতির হুমকি দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পরমাণু অস্ত্র নিক্ষেপক- রাশিয়ার স্ট্র্যাটেজিক ফোর্সেস কম্যান্ডকে রাখেন সর্বোচ্চ সতর্কতায়। অর্থাৎ, তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতই থাকবে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার এই মহাপ্রলয়ের বাহন বিমানটি সম্পর্কে এবার কিছুটা জেনে নেওয়াও দরকার:
নকশা:
সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙ্গে যায়নি- সেই ১৯৮৫ সালেই প্রথম উড্ডয়ন করে ইলিউশিন আইএল-৮০। মূল কাঠামোয় বেশকিছু উন্নয়ন ও পরিবর্তনের পর, ১৯৮৭ সাল থেকে বিমানটির ডেলিভারি শুরু হয়। ১৯৯২ সালে প্রথম বিশেষ বিমানটির উড্ডয়ন প্রত্যক্ষ করে পশ্চিমা গণমাধ্যম। তখন ধারণা করা হয়েছিল- এটি সার্ভিস থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। অবশ্য ধারণাটি সঠিক ছিল না।
ইলিউশিন আইএল-৮৬ বিমানকে মডেল হিসেবে নিয়ে তার আরো উন্নয়ন ও সংযোজন করে তৈরি হয় আইএল-৮০। দেখতে এটি বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী বিমান থেকে অনেকটাই আলাদা। সামরিক বাহিনীতে বিমানটির পোশাকি নাম দেওয়া হয় 'ম্যাক্সডোম', তবে অনেকে বিশেষজ্ঞ একে 'ক্যাম্বার' বলেও ডাকেন।
বাণিজ্যিক বিমানের সামনে যেভাবে পাইলটের কেবিন বা ককপিটের সম্মুখভাগ যেমন ম্যাক্সডোমে তার থেকে বেশ আলাদা। ককপিটের জানালা আছে ঠিকই, কিন্তু তা এক ধরনের পুরু বিশেষ কাঁচের আচ্ছাদনে ঢাকা। পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ থেকে বিমান চালককে সুরক্ষিত রাখতেই এ ব্যবস্থা। বিমানের ওপরের সাড়ির ডেকের দরজার সংখ্যাও কমানো হয়েছে, রয়েছে মাত্র একটি 'এয়ারস্টেয়ার' বা বিমানে ওঠানামার সিঁড়ি।
ফিউজিলাজ বা মূল কাঠামোর ওপরে বসানো আছে একটি স্যাটকম সিস্টেম। স্যাটকম কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে যোগাযোগের সুবিধা দেয়। ফিউজিলাজে আরো দেখা যায় কয়েকটি লম্বা অ্যান্টেনা।
এছাড়া, উড়ন্ত অবস্থায় মোতায়েনের জন্য বিমানের পিছন দিকে রয়েছে আরেকটি অত্যন্ত নিম্ন বেতার তরঙ্গ ব্যবস্থায় কাজ করতে সক্ষম একটি ভিএলএফ বা 'ভেরি লো ফ্রিকোয়েন্সি'র অ্যান্টেনা।
বিমানের উচ্চতা ও ভারসাম্য রক্ষায় ডানায় থাকে হরিজন্টাল স্ট্যাবিলাইজার। আইএল-৮০'র অন্যান্য অংশের মতো স্ট্যাবিলাইজারও সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করে তৈরি। এতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সর্বাধুনিক সেন্সর ও যোগাযোগ অ্যান্টেনার জন্য বাড়তি জায়গা।
বিমানের মোট ৪টি ইঞ্জিনের প্রতিটির ভিতরদিকে বসানো আছে দুটি করে বৈদ্যুতিক জেনারেটর। জরুরি মুহূর্তে ইঞ্জিনকে বাড়তি শক্তি দিতে বা দ্রুত চালু করতেই এ ব্যবস্থা। ককপিটের নিচে আছে গুটিয়ে নেওয়া যায় এমন একটি ফুয়েলিং প্রোব বা আকাশপথে বিমানে জ্বালানি ভরার নল।
আমেরিকান প্রতিযোগী বোয়িং বি-৪-এর সাথে তুলনা:
ম্যাক্সডোম বা আইএল-৮০'র মতো মার্কিনীদের আছে নাইটওয়াচ নামক বিশেষ বাহন। এটি বোয়িং ৭৪৭ বাণিজ্যিক বিমানের মডেলকে উন্নয়ন ও পরিবর্তন করে নির্মিত হয়েছে। ম্যাক্সডোম পরীক্ষামূলকভাবে ওড়ার প্রায় এক দশক আগেই এটির উৎপাদন শুরু করে আমেরিকা।
বোয়িং বি-৪ এর ককপিটের জানালা থাকলেও, তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ (ইএমপি) থেকে বিমানের যন্ত্রাংশ ও ওয়্যারিং রক্ষার জন্য আছে বিকিরণরোধী ঢাল। ইএমপির প্রভাবে নষ্ট হতে পারে ডিজিটাল পরিচালন ব্যবস্থা, এজন্য প্যানেলে এনালগ পদ্ধতির যন্ত্রপাতিও রয়েছে।
তিন ডেক বা তলার এ বিমানে আরও রয়েছে ইলেকট্রিক প্যানেল, স্টেপ ডাউন ট্রান্সফর্মার, স্যাটকম ও ভিলএলএফ যন্ত্র। রয়েছে গুটিয়ে রাখা যায় এমন একটি তারের অ্যান্টেনা। উড়ন্ত অবস্থায় যা খুলে দেওয়া হলে পাঁচ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। রয়েছে আরও ১৩টি বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ লিঙ্ক।
আকাশপথে অন্য বিমানে জ্বালানি সরবরাহের কাজ করে আমেরিকার বিশেষ ট্যাঙ্কার বিমান কেসি-১৩৫। নাইটওয়াচে জ্বালানি ভরতে চাই কানায় কানায় পূর্ণ দুটি কেসি-১৩৫ বিমানের জ্বালানি। আর এতে টানা ৩৫ ঘণ্টা উড়তে পারবে। আর যথেষ্ট জ্বালানি সরবরাহ থাকলে নাইটওয়াচ টানা ৭ দিন ধরেও উড়তে পারে।
আমেরিকা ও রাশিয়ার শীর্ষ কর্মকর্তাদের চরম বিপদের মুহূর্তে বহনকারী বিমান দুটির প্রথম প্রজন্মের সংস্করণ আর নেই। এখন সার্ভিসে আছে দুটি বিমানেরই দ্বিতীয় প্রজন্ম।
আন্তর্জাতিক কিছু গণমাধ্যমের সংবাদে প্রকাশ, রাশিয়া খুব শিগগিরই সার্ভিসে আনতে চলেছে আইএল-৮০'র তৃতীয় প্রজন্মের সংস্করণ। তবে পরে এবিষয়ে কোনো অগ্রগতির কথা আর জানা যায়নি।
- সূত্র: ইন্টারেস্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং