কখনো গোস্ট, কখনো প্রফেসর- কসপ্লেয়ার, কালেক্টর অনির্বাণের ডেরায় একবেলা
অনির্বাণ অর্ঘ্যের বাড়ির সামনে যখন রিকশা থেকে নামলাম, তখন দুপুরে খেয়ে একটু গড়িয়ে নেওয়ার বেলা। ভদ্রলোক নিজে নেমে এসে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। অভীষ্ঠ তলায় লিফট থামার পর বেরোতেই চোখে পড়ল দেওয়ালে ঝোলানো ক্যামেরায় তোলা কতগুলো ছবি। চাবি দিয়ে দরজা খুললেন অনির্বাণ।
সদর দরজা খুলেই হলঘর ধরে সোজা সামনে গিয়ে বাঁয়ে তার ঘর। বাসাটা সুনসান, বোধহয় একটু বেশিই অবেলায় এসে পড়েছি। অনির্বাণের নিজের কামরার দরজা খুলে ভেতরে ঢোকার পর মনে হলো এ এক অন্য দুনিয়ায় প্রবেশ করেছি।
সবার আগে চোখ আটকে গেল সামনের দেয়ালে। সারি সারি সাজানো অত্যাধুনিক সব 'মারণাস্ত্র'। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, কারণ এগুলো সব খেলনা বন্দুক। কিন্তু দেখতে পুরোদস্তুর আসল বন্দুকের মতো। বেশিরভাগই পশ্চিমা বিভিন্ন মডেল, মাঝেমধ্যে দু-একটা রাশিয়ান রাইফেল অপাংক্তেয় হওয়ার মতো করে উঁকি দিচ্ছে। বলা বাহুল্য এসবের মাঝে কিংবদন্তিতুল্য সোভিয়েত অ্যাসল্ট রাইফেল অটোমেটিক কালাশনিকভ-৪৭-ও ছিল।
শুধু দেয়ালে নয়, নিচে মেঝেতেও স্ট্যান্ডের মধ্যে সাজানো নানা অস্ত্রের রেপ্লিকা। এর বাইরে রয়েছে বিভিন্ন জাতের গ্রেনেড, ভেস্ট, মুখোশ, স্নাইপার রাইফেল, সামরিক ছুরি, গ্যাস মাস্ক, নাইট ভিশন গগলস ইত্যাদি। ঘরের ঠিক মাঝখানে বিছানা। মাথার দিকে তিন মাপের তিনটি কাটানা ঝোলানো। ডানদিকের দেওয়াল লাগোয়া কাজের ডেস্ক। সেখানে দুটো মনিটর, তার ওপরে একটা স্মার্ট টেলিভিশন। তার পাশেই একটা ক্লোজেটে অনির্বাণের আরেকটি মহার্ঘ্য সংগ্রহ। পুরো ক্লোজেট জুড়ে বিভিন্ন অ্যাকশন ফিগার দাঁড়িয়ে আছে। কী নেই সেখানে; গেইমিং কারেক্টার থেকে শুরু করে হলিউডের মারদাঙ্গা চরিত্র! ঘরের অন্যদিকের দেওয়ালে আরেকটি ক্লোজেটেও এরকম অনেকগুলো অ্যাকশন ফিগার দেখা যাচ্ছে।
'আপনি কি অনেকটা শেলডন ক্যুপারের মতো নাকি?' বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলাম তাকে। হেসে উত্তর দিলেন, 'বলতে পারেন। অনেকে নিজেকে শেলডন হিসেবে স্বীকার করতে লজ্জা পায়। কিন্তু আমার ভালোই লাগে নিজেকে নার্ড ভাবতে।' আমাদের আড্ডা শুরু হলো।
শখের শুরু ছোটবেলাতেই
অনির্বাণ অর্ঘ্য একজন কসপ্লেয়ার, সংগ্রাহক। তার সংগ্রহের তালিকায় আছে পপ কালচারের বিভিন্ন উপাদান, অ্যাকশন ফিগার, খেলনা বন্দুক, মিলিটারি গিয়ার, মিলিটারি প্রপস ইত্যাদি। অনেক বছর ধরে এসব সংগ্রহ ও কসপ্লে করে যাচ্ছেন তিনি।
অনির্বাণের জন্ম ১৯৯২ সালে। চিকিৎসক বাবার চাকরিসূত্রে ছোটবেলা কেটেছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। এ শতকের শুরুতে ঢাকায় থিতু হয় পরিবার। পড়াশোনা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগে। ২০১৭ সাল থেকে ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ও থ্রিডি আর্টিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। এছাড়া যুক্ত আছেন বুয়েট-এর এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই)-এর সাথেও।
নিজের দ্বিতীয় জন্মদিনে বাবা'র কাছ থেকে একটি খেলনা বন্দুক উপহার পান। সেটাই কি আজকের এ অনির্বাণের পেছনের প্রথম উৎসাহ? 'অস্বীকার করার জো নেই, তবে ছোটবেলায় এ জাতীয় আরও উপহার পেয়েছিলাম। তখনো স্কুলে পড়িনা, সুনামগঞ্জে থাকার সময় আরেকটা বন্দুক উপহার পেয়েছিলাম। সেটা বোধহয় পরের দিনই ভেঙে ফেলি। বলতে পারেন, ও সময়ই বন্দুক, অস্ত্র এসব নিয়ে আমার ভালোলাগা তৈরি হয়।'
সংগ্রহের ইচ্ছে সেই শুরু থেকেই ছিল অনির্বাণের। কিন্তু একটা বয়স পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। ২০১৫-তে এসে তিনি বুঝতে পারলেন, নিজের এ 'ভিন্নধর্মী' শখ পূরণের জন্য মা-বাবা'র পয়সা ওড়ানোর কোনো মানে হয়না।
বুয়েটে পড়ার সময় টুইশনের টাকা জমিয়ে মাঝেমধ্যে নিজের শখ পূরণ করতে শুরু করেন। তবে তখন বেশি দামি টয় গান কেনা সম্ভব হতো না। চতুর্থ বর্ষে ওঠার পর একটা ইন্টেরিয়র ফার্মে কাজ শুরু করেন। এরপর থেকেই মোটামুটি পুরোদস্তুর কালেক্টর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন অনির্বাণ।
প্রথম প্রথম চকবাজার-নিউমার্কেটের খেলনা দোকান থেকে শখের বন্দুক সংগ্রহ করতেন তিনি। সেগুলো দেখতে পুরোপুরি আসল বন্দুকের মতো ছিল না। ডিজাইনের মাপজোখের দিক থেকেও সমস্যা ছিল। তখন তিনি বুঝতে পারলেন, এসব বন্দুক কিনে নিজের আসল শখ পূরণ করা যাবে না। তার চাই এয়ারসফট বা জেল ব্লাস্টারের মতো খেলনা বন্দুকগুলো, যেগুলো দেখতে এবং কিছু মেকানিজমের ক্ষেত্রে পুরোপুরি আসল বন্দুকের মতো কাজ করে।
চকবাজারে যেসব খেলনা বন্দুক পাওয়া যেত ওগুলোর দাম পড়ত ৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। ওই খেলনাগুলোর থেকে ছররার মতো ছোট ছোট প্লাস্টিকের বুলেট ছোঁড়া যেত। কিন্তু মানের দিক থেকে ভালো ছিল না ওগুলো, কয়েকবার খেলার (পড়ুন গুলি ছোঁড়ার) পর ভেতরের স্প্রিং-এর স্থিতিস্থাপকতা কমে যাওয়া বা ট্রিগার নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিত।
তা-তে অবশ্য দমে যাননি অনির্বাণ। সেসময় এ ধরনের প্লাস্টিকের খেলনা বন্দুকেরও অনেক বড় সংগ্রহ ছিল তার। কিন্তু অসন্তুষ্ট অনির্বাণ আরও কড়া কিছু খেলনার জন্য মুখিয়ে ছিলেন। একসময় সফলও হন, ২০১৯-'২০ সালে রেপ্লিকা ওয়েপন সংগ্রহের নতুন যাত্রা শুরু হয় তার।
কিন্তু মিলিটারি অস্ত্রশস্ত্র, গিয়ার, প্রপস এসব সংগ্রহের পেছনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছিল তার কসপ্লের নেশা। কসপ্লের জন্যই এসবের দরকার পড়তো। সে গল্প বলতে শুরু করলেন তিনি।
কসপ্লে যখন 'সিরিয়াস' শখ
'খুব সহজে বললে, কসপ্লে হচ্ছে পপ কালচারের কোনো চরিত্রের মতো করে সাজা, পোশাক পরা,' বলেন অনির্বাণ। কোনো সিনেমা, বই, কমিক, ভিডিও গেইম ইত্যাদি থেকে নিজের পছন্দের কোনো চরিত্রের মতো সাজাটাকেই কসপ্লে বলে। বহির্বিশ্বে বর্তমানে কসপ্লে ভীষণ জনপ্রিয়, বাংলাদেশেও এখন অনেকে নিজের মতো করে কসপ্লে করে থাকেন। অনির্বাণের তথ্যমতে, বাংলাদেশে কসপ্লের চর্চা শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে।
'২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো গুলশানে একটা কসপ্লে ইভেন্টে অংশগ্রহণ করি। আমার তখনও কসপ্লে করার মতো রিসোর্স ছিল না, বাজেট ছিল না। ওখানে গিয়েছিলাম স্রেফ দেখার জন্য, আর ছবি তোলার জন্য। আমার একটা সময়ে ছবি তোলারও শখ ছিল, স্ট্রিট ফটোগ্রাফিই বেশি...'
সেবারের প্রোগ্রামের পর তিনি প্রথমবারের মতো অন্য কসপ্লেয়ারদের সান্নিধ্যে আসেন। অবশ্য তখনো কসপ্লে নিয়ে সিরিয়াস কিছু করার সুযোগ ছিল না তার। আর্থিক সীমাবদ্ধতা ছাড়াও বাসায় কসপ্লের জিনিসপত্র কোথায় রাখবেন, বাসার লোকেরা কীভাবে দেখবে বিষয়টাকে; সেসব নিয়েও ভাবতে হয়েছিল তাকে।
২০১৫ সালে প্রথম কোনো কসপ্লে করেন অনির্বাণ। 'আমার মনে আছে, নিউমার্কেট থেকে ৮০০ টাকায় আমি একটা মুখোশ, একটা কালো গেঞ্জি, কিছু স্ট্র্যাপ কিনে প্রথমবারের মতো কসপ্লে করি।' কিসের কসপ্লে ছিল সেটা, আগ্রহভরে তার কাছে জানতে চাইলাম। 'ওটা তেমন কিছুই না, স্রেফ একজনের যোদ্ধার কসপ্লে করতে চেয়েছিলাম আমি। এরপর থেকে এভাবে নিউমার্কেট থেকে খেলনা বন্দুক কিনে নিয়মিত কসপ্লে করা শুরু করি। কিন্তু একটা সময় আমার মনে হতে থাকলো, এগুলো একটু খেলো হয়ে যাচ্ছে, আমাকে আরও ভালো কিছু করতে হবে।'
'এরপর আমি কসপ্লে করার বিভিন্ন জিনিসপত্র বাইরে থেকে আনা শুরু করি। ২০১৭ সালে আলি এক্সপ্রেস-এর মাধ্যমে আনতাম। কিন্তু দাম অনেক বেশি পড়ে যেত। এরপর ২০১৮ সাল থেকে বন্ধুদের সুবাদে আমি সরাসরি চীন থেকে জিনিসপত্র আনতে শুরু করি।'
অনির্বাণের কসপ্লে'র মূল ফোকাস মিলিটারি কারেক্টারগুলো। এখন পর্যন্ত ১৬-১৭টি কসপ্লে করেছেন। তার বেশিরভাগই বিভিন্ন মিলিটারি গেইমের চরিত্র। স্কুলের বন্ধুদেরও আগ্রহের জায়গা একই ছিল। তখন ইন্টারনেট ছিল না, তাই মিলিটারিসংশ্লিষ্ট জ্ঞান বন্ধুদের সুবাদেই জানা হতো। এছাড়া মিলিটারি গেইমগুলো খেলার কল্যাণেও এসব নিয়ে জানতে পারতেন তিনি। এর বাইরে হলিউডি সিনেমাতো ছিল।
নিজের কসপ্লে নিয়ে বড্ড খুঁতখুঁতে অনির্বাণ। যে চরিত্রের কসপ্লে করবেন, তার সবগুলো অংশই নিখুঁত হতে হয়, নাহলে কসপ্লে করেও নিজের মধ্যে সন্তুষ্টি পান না তিনি। কসপ্লে করার জন্য কোনো চরিত্র পছন্দ করার পর সেটার আনুষঙ্গিক বন্তুগুলো সংগ্রহ করার মিশনে নামতে হয়। সব সংগ্রহ হলে তারপর সেগুলো গায়ে চড়িয়ে নিজেকে ওই চরিত্রের রূপ দেন তিনি। এজন্য কখনো কখনো বাড়তি দাঁড়ি রাখতে হয়, গায়ে ট্যাটু আঁকতে হয়। ওসবেও তার কোনো আপত্তি নেই।
গত ১৭ জুন কল অভ ডিউটি: মডার্ন ওয়ারফেয়ার (২০১৯) গেইমের প্রোটাগনিস্ট চরিত্র সাইমন 'ঘোস্ট' রাইলির কসপ্লে করেছেন অনির্বাণ। এ কসপ্লে করার জন্য তার যেসব জিনিসের প্রয়োজন হয়েছে সেগুলো একটি তালিকা শোনালেন তিনি। 'ম্যাগাজিন রাখার ভেস্ট, মুখোশ, আর্মার প্লেট ক্যারিয়ার, ট্যাকটিক্যাল শার্ট আর প্যান্ট, রেডিও, অস্ত্র বহনের হোলস্টার, স্লিং এগুলো লাগবে,' জানান তিনি। কী কী অস্ত্র লেগেছে এ কসপ্লে'র জন্য, জানতে চাই তার কাছে।
এবার বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্রের নতুন একটি তালিকা আওড়াতে শুরু করলেন তিনি, 'সিগ-এর ৫৫২ কমান্ডো মডেলের কার্বাইন, সিগ সাওয়ার পি৩২০ মডেলের পিস্তল, কমব্যাট ছুরি, ফ্ল্যাশব্যাং, ফ্র্যাগ গ্রেনেড, ইনসিন্ডিয়ারি গ্রেনেড।' এসব নামগুলো সাধারণ মানুষের কাছে পুরোপুরি অচেনা ঠেকলেও অনির্বাণের মতো মিলিটারি কসপ্লেয়ার বা মিলিটারি ওয়েপন ও গিয়ার নিয়ে আগ্রহ আছে এমন মানুষের কাছে এগুলো খু্বই পরিচিত ও প্রিয় নাম।
সিগ সাওয়ার পি৩২০ মডেলের পিস্তল অনির্বাণের কাছে ছিল না। তিনি চাইলে তার সংগ্রহের অন্য কোনো হ্যান্ডগান দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে পারতেন। 'গেইমে যেরকমটা আছে, সেরকম মডেল, রং, ডিজাইনটাই লাগবে আমার,' কম্পিউটারে একটি সিগ পি৩২০-এর মডেল-এর থ্রিডি নকশা দেখাতে দেখাতে বলেছিলেন তিনি।
এত কিছু সংগ্রহে করে কসপ্লেটি সফলভাবে করার জন্য পাক্কা দুই বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে অনির্বাণকে। ২০২০ সালে প্রথম এটি করার পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। এরপর প্রতিটি প্রপ-এর ব্যবস্থা, বাজেটের ব্যবস্থা, থ্রিডি প্রিন্টিং ইত্যাদি করে উঠতে তার এতদিন লেগে যায়। এছাড়া মাঝখানে করোনাভাইরাসের জন্যও সবকিছু থমকে গেছিল। অবশেষে আরাধ্য এ কসপ্লেটি করতে পেরে কেমন লাগছে জানতে চাইলে অনির্বাণ জানান, এটা সফল হয়েছে। আমি অনেক সন্তুষ্ট।
অনির্বাণের পরিশ্রম, ও ধৈর্য বৃথা যায়নি। মডার্ন ওয়ারফেয়ার গেইমের ঘোস্ট চরিত্রে কণ্ঠ দেওয়া শিল্পী জেফ লিচ টুইটার ও ফেইসবুকে তার কসপ্লে দেখে প্রশংসা করেছেন, ধন্যবাদ জানিয়েছেন। অনির্বাণের অনুভূতি কেমন? 'অন্য রকম একটা ভালো লাগা কাজ করছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করতে পারাটা আমার জন্য একটি বিশেষ অর্জন।'
'সাইড-গিগ' ফটোগ্রাফি
অনির্বাণ একজন ভালো ফটোগ্রাফারও। ২০১২ সাল থেকে ছবি তোলা শুরু করেন তিনি। মূলত স্ট্রিট আর পোর্ট্রেট ছবি তোলেন তিনি। ২০১৪ সালে তার একটা ছবি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর 'ফটো অভ দ্য ডে' হয়েছিল। তার কিছু ছবি বিভিন্ন প্রদর্শনীতেও স্থান পেয়েছে। দৃক-এর 'বাংলাদেশ সিন ফ্রম উইদিন' শীর্ষক গ্রন্থে অনির্বাণের একটি ছবি নির্বাচিত হয়েছিল।
একসময় ছবির জন্য পুরো ঢাকা শহরে চষে বেড়াতেন তিনি। বুয়েটে পড়ায় পুরান ঢাকাতেও অনেক ঘোরা হয়েছে তার। 'এমনও দিন গেছে স্রেফ একটা টিশার্ট গায়ে জড়িয়ে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে গেছি। তখন ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতাম ছবি আর প্রপের জন্য,' জানান অনির্বাণ।
বর্তমানে অ্যাকশন ফিগারগুলো চীন বা অন্য দেশ থেকে আমদানি করলেও একসময় ঢাকা থেকেই এগুলো সংগ্রহ করতেন তিনি। কারও সুবাদে যদি জানতে পারতেন যে অমুক জায়গায় ওই কারেক্টারের ফিগার দেখা গেছে, ব্যাস তাকে আর পায় কে। ও জিনিস নিজের সংগ্রহে না আনা অব্দি তার শান্তি হতো না।
ছবির প্রসঙ্গে ফিরলাম আবার। ডেস্কের ডাবল মনিটররে কল অভ ডিউটি: মডার্ন ওয়ারফেয়ার-এর পোস্টার জ্বলজ্বল করেছে। জোড়া মনিটরের দুপাশে দুটো কন্ট্রোলার দেখা যাচ্ছে। টিভির পর্দায় একের পর এক নিজের তোলা ছবি দেখাতে শুরু করলেন অনির্বাণ। বেশিরভাগ ছবিতেই মূল বিষয়বস্তু মানুষ।
'আমি যেহেতু আর্কিটেক্ট, আমার কাজটাই মানুষের সাথে। মানুষের জন্য যেহেতু স্থাপনা বানাতে হয় আমাকে, তাই মানুষকে বোঝা, মানুষ কী চায় সেটা অনুধাবন করতে পারা আমার জন্য জরুরি। এ ব্যাপারটা আমি ছবির ক্ষেত্রেও কাজে লাগাই। আমি গিয়েই হুট করে ছবি তুলে ফেলিনা। আগে ওই মানুষটার সাথে একটু কথা বলি। তার সাথে 'আইস-ব্রেক' করার পরই আমি তার ছবি তুলি,' কথা বলতে বলতে পর্দায় ছবি পাল্টাতে থাকেন অনির্বাণ।
নিজের কিছু থ্রিডি ডিজাইন দেখালেন তিনি। এরকম একটা ডিজাইন করতে কতক্ষণ সময় লাগে? বললেন সেটা নির্ভর করে অনেককিছুর ওপর। 'কনসেপ্ট মাথায় থাকলে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে হয়ে যায়। আবার রেন্ডারে একটু সময় দিতে হয়। অনেকসময় ক্লায়েন্টের কাছ থেকে বিভিন্ন ফিডব্যাক আসে, সে অনুযায়ী ডিজাইনে পরিবর্তন আনতে হয়,' বলেন তিনি।
পছন্দের সব অ্যাকশন ফিগার
ভিডিও গেইম, সিনেমা, কমিকবুক এসবের চরিত্রগুলোর ছোট ছোট পুতুলগুলোকেই অ্যাকশন ফিগার বলা হয়। এগুলোর সাইজ অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন হয়। অনির্বাণের সংগ্রহে থাকা ফিগারগুলো কোনোটি খুবই ছোট, আবার কোনোটির উচ্চতা একেবারে এক ফুট। বেশিরভাগ অ্যাকশন ফিগার বিভিন্ন ভিডিও গেইম, কমিকবুক চরিত্রের। এগুলোর এক একটির দাম ২০০০ টাকা থেকে শুরু। বেছে বেছে নিজের পছন্দের অ্যাকশন ফিগারগুলোই সংগ্রহ করেন তিনি। এ পর্যন্ত ১১৫টির বেশি ফিগার নিজের সংগ্রহে যুক্ত করেছেন তিনি।
চীন থেকে আমদানি করা হয় বেশিরভাগ ফিগার। এছাড়া ঢাকায় কিছু দোকানে মাঝেমধ্যে পছন্দের অ্যাকশন ফিগার পাওয়া যায়। আর আমেরিকা-ইউরোপ থেকে বন্ধু বা পরিচিতদের দিয়ে মাঝেমধ্যে পছন্দের ফিগারের ব্যবস্থা করেন তিনি। তার সংগ্রহে থাকা অনেকগুলো ফিগারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো পিটার ভেঙ্কম্যান (ঘোস্টাবাস্টার্স); দ্য উইচার; লারা ক্রফট (টুম রেইডার); আয়া (অ্যাসাসিন'স ক্রিড); মাস্টারচিফ (হালো ইনফিনিটি); স্যাম ফিশার (স্প্লিন্টার সেল); ডেডপুল, পানিশারসহ মার্ভেলের বিভিন্ন হিরো; ঘোস্ট (কল অভ ডিউটি); জন উইক ইত্যাদি।
অনির্বাণের 'অস্ত্রাগার'
প্রথমদিকে ঢাকার বিভিন্ন বাজার থেকেই খেলনা বন্দুক সংগ্রহ করতেন তিনি। বুয়েটে পড়ার সময় নিউমার্কেটে একটা এম-১৬ মডেলের খেলনা বন্দুক পছন্দ হয়েছিল অনির্বাণের। কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় কিনতে পারেননি। তা-ই বলে তিনি হালও ছেড়ে দেননি। পাক্কা দু'বছর তক্কে তক্কে ছিলেন কখন বন্দুকটির দাম কমবে। এরপর যেই না সুযোগ এল, কিনতে গিয়ে দেখেন আরেক বিপত্তি। প্যাকেটের ভেতরে বন্দুকের একটা অংশ ভাঙা। শেষে সুপারগ্লু লাগিয়ে তা জোড়া দিয়ে তারপর বাসায় নিয়ে এলেন আরাধ্য সেই জিনিসকে।
তার হালের সংগ্রহগুলো চীন থেকে আনা সব। নিজের কিছু পরিচিত মানুষজন আছে যাদের মাধ্যমে আনানো হয় এগুলো। তাদের সাথে চুক্তি করেন তিনি, সে চুক্তি অনুযায়ী তাকে পণ্য পাঠিয়ে দেন ডিলারেরা। এভাবেই গড়ে তুলেছেন নিজের কসপ্লে'র উপকরণ, অ্যাকশন ফিগার, মিলিটারি গিয়ার, মিলিটারি প্রপস, মিলিটারি ওয়েপনের সংগ্রহশালা।
দেওয়ালের একপাশে ঝোলানো নানা ধাঁচের কমান্ডো ছুরি। 'এগুলো কি স্টিলের?' জানতে চাই তার কাছে। 'না, এগুলো একটিও আসল নয়। ছুরিগুলো রাবারের তৈরি, এগুলো ব্যবহার করা হয় সামরিক প্রশিক্ষণ বা সিনেমায় প্রপ হিসেবে।' স্মোক গ্রেনেডগুলোর ভেতরে কী? গ্রেনেডগুলোও কি জেল বল নিক্ষেপ করে? 'স্মোক গ্রেনেডগুলো খালি ক্যানিস্টার, সিনেমার প্রপের জন্য। ফ্ল্যাশব্যাং যে দুটো দেখছেন, এগুলো স্রেফ গ্যাসলাইটার।' একইরকম ব্যাপার ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত গ্রেনেড আর আধুনিক এম৬৭ ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেডের ক্ষেত্রেও।
কথা বলতে বলতে ঘরময় পায়চারি করে বিভিন্ন অস্ত্র হাতে নিয়ে দেখালেন তিনি। ঘরের একপাশে আরেকটা আলমারি খুলে আবারও চমক দিলেন অনির্বাণ। সেটার ভেতরে ঠেসে রাখা হয়েছে রাজ্যের খেলনা পিস্তল আর রিভলভার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের লুগার পিস্তলের রেপ্লিকা থেকে শুরু করে গ্লক-এর চতুর্থ প্রজন্মের জি১৭ মডেলের অত্যাধুনিক পিস্তল; সবই আছে তার 'আর্মারি'তে।
নিজের সামরিক সংগ্রহকে সিনেমার কাজেও ব্যবহার করছেন তিনি। সম্প্রতি তিনি নতুন একটি সিনেমার প্রোডাকশনের কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ সিনেমাটির সামনে মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে। অনির্বাণের কাজ ছিল সিনেমার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রের যোগান দেওয়া। ১৯৭১ সালে ব্যবহৃত বিভিন্ন মডেলের অস্ত্র পরিচালককে সংগ্রহ করে দিতে হয়েছে অনির্বাণকে। মুক্তিযুদ্ধে বহুল ব্যবহৃত অস্ত্র স্টেনগানের রেপ্লিকা কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে নিজের পরিচিত এক ছোটভাইকে দিয়ে ফোম, লোহার রড, কাঠ ইত্যাদি ব্যবহার করে একটি স্টেনগানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি।
জেল ব্লাস্টার
অনির্বাণের সংগ্রহে থাকা বন্দুকগুলো হচ্ছে জেল ব্লাস্টার টয়। এ বন্দুকগুলো ব্যাটারিতে চলে। আসল বন্দুকের সাদৃশ্যে ও সমান মাপে তৈরি করা হয় এগুলোকে। এছাড়া এগুলোর কোনো কোনোটির ভর আসল বন্দুকের ভরের কাছাকাছি হয়। সাধারণত জেল ব্লাস্টার বন্দুকগুলো প্লাস্টিকের হলেও কখনো কখনো ধাতু দিয়ে এগুলোর কিছু অংশ তৈরি করা হয়। এ বন্দুকগুলো থেকে জেল দিয়ে তৈরি একধরনের নরম গুটি ছোঁড়া যায়।
নিজের সংগ্রহের কিছু খেলনা কীভাবে কাজ করে তা নেড়েচেড়ে দেখালেন তিনি। বোল্ট টেনে ম্যাগাজিন থেকে চেম্বারে জেলবল প্রবেশ করানো, সেফটি মেকানিজম, ম্যাগাজিন প্রবেশ-খোলা; এগুলো সবই আসল বন্দুকের মতোই জেল ব্লাস্টারগুলোতেও। একই ধরনের আরেকটি খেলনা বন্দুক হলো এয়ারসফট গান। তবে সেগুলোতে জেলের বদলে প্লাস্টিকের ছোটছোট গুটি (প্যালেট) ব্যবহার করা হয়।
এ খেলনা বন্দুকগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বর্তমানে নিষিদ্ধ। বিশেষত নাইন-ইলেভেনের পর থেকে এসব বাস্তবধর্মী খেলনাবন্দুক বিষয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার কিছুটা সংবেদনশীল বলে জানান অনির্বাণ। তবে বাংলাদেশে এগুলো নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। অনির্বাণ এ খেলনাগুলো কখনো প্রকাশ্যে প্রদর্শন করেন না, স্রেফ নিজের শখ পূরণে তিনি এগুলো সংগ্রহ করেছেন। কোনো কসপ্লে অনুষ্ঠানে, ব্যক্তিগত কসপ্লে ইত্যাদি কাজে রেপ্লিকা এ বন্দুকগুলো ব্যবহার করা হয় তার।
এ শখের 'দাম' কত?
প্রতিটি রেপ্লিকা বন্দুকের পেছনে গড়ে বাংলাদেশি টাকায় আট থেকে ২০ হাজার টাকা ব্যয় করতে হয়। বন্দুকের আকার, মেকানিজম, মান ইত্যাদির ওপর দাম নির্ভর করে। আবার চীনের বিক্রেতাদের মর্জির ওপরও নির্ভর করতে হয়। তারা যে দামে বিক্রি করেন, সে দামেই কিনতে হয়।
'এখন পর্যন্ত কত টাকা খরচ করেছেন নিজের এ শখের পেছনে?' জানতে চাই তার কাছে। 'হিসেব তো রাখা হয়নি, তবে সাত-আট লাখ টাকা তো হবেই। এখন আর হিসেব করি না, লজ্জা লাগে ভাবলে যে এসবের পেছনে এত পয়সা খরচা করেছি,' হাসতে হাসতে বলেন অনির্বাণ।
ছোটবোনের উৎসাহ
প্রথমদিকে এসব সংগ্রহ নিয়ে অনির্বাণের মা-বাবা খুব একটা খুশি ছিলেন না। তবে তার এ শখ পূরণে ছোটবোনের উৎসাহ ছিল অনেকটা। তার ছোটবোন অর্পিতা নিজেও একজন চিত্রশিল্পী, আছে নিজের ইউটিউব চ্যানেলও। উৎসাহের পাশাপাশি ভাইয়ের শখকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তাও করতেন তিনি। 'একবার একটা কসপ্লের জন্য আমার পুরো হাতে ট্যাটু করতে হয়েছিল। ও মার্কার দিয়ে সাড়ে তিনঘণ্টা ধরে আমার হাতে ওই ট্যাটুটা এঁকে দিয়েছিল।' কস্টিউমের মেকাপ, কসপ্লে করার পর সেগুলোর ছবি তুলে দেওয়া- এসবে অনির্বাণের সবসময়কার সারথি অর্পিতা।
অবশ্য পরে পরিবারের সবাই মেনে নিয়েছেন অনির্বাণের ভিন্নধর্মী এ শখ। পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে এখন অনির্বাণ চাচ্ছেন, বাইরের মানুষও এসব মেনে নিক। ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কার করলেন তিনি।
কসপ্লে, কালেকশন স্বাভাবিক হোক
বাংলাদেশের মানুষ এখনো কসপ্লেতে অভ্যস্ত নন বলে জানান অনির্বাণ। 'আপনি দেখবেন ফেইসবুক গ্রুপগুলোতে কেউ যখন কসপ্লে করে, তখন মানুষ সেগুলো নিয়ে হাসাহাসি করে। উৎসাহ দেওয়ার বদলে এখানে 'ঘৃণা ছড়াছড়িই' বেশি হয়। আমি চাই এর পরিবর্তন হোক,' বলেন অনির্বাণ।
নিজের সামরিক সংগ্রহগুলো কেন অন্যদের থেকে গোপন রাখার চেষ্টা করেন, এমন প্রশ্নের জবাবে অনির্বাণ বলেন, 'আমার আশঙ্কা হচ্ছে এগুলো ভুল লোকের হাতে পড়লে তা-তে অন্যের ক্ষতি হবে। এসব খেলনা বন্দুক দিয়ে অনেক অপরাধ ঘটানোর নজির আছে দেশে।'
'এসব কথা ভেবে অন্যরা যারা অল্পস্বল্প এ ধরনের টয় গান সংগ্রহ করেছেন, তারাও সেগুলোর বিষয়ে চুপ থাকতেই পছন্দ করেন। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতেও তাদের এসব সংগ্রহ বিশেষ প্রকাশ করেন না। আমি চাই এ ধরনের শখ, সংগ্রহগুলো স্বাভাবিক হোক। মানুষের মধ্যে এগুলো নিয়ে ভুল ধারণার অবসান ঘটুক,' বলেন তিনি।
দেশে এখন অনেকেই কসপ্লে করেন। তবে এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সংগঠন নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদেই কসপ্লেয়ারেরা একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে এসবের আয়োজন করেন। অনির্বাণ চাচ্ছেন দেশের সব কসপ্লেয়ারকে এক ছাতার নিচে আনতে। 'সবাই নিজের মতো করে কসপ্লে করছে এখনো। দু-একটা ইভেন্ট হচ্ছে বটে, কিন্তু তার কোনো নির্দিষ্ট সংস্থা বা সংগঠন নেই। আমার ইচ্ছে কসপ্লেয়ারদের নিয়ে একটা অফিসিয়াল গ্রুপ তৈরি করার।' এর জন্য ভবিষ্যতে কোনো ইভেন্টের আয়োজন করার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।