উচ্চ মৃত্যু ঝুঁকিতে রয়েছেন দেশের কোভিড আক্রান্ত গর্ভবতী নারীরা
২৬ বছর বয়সী ডা. দিনার জাবিন ছয় মাসের গর্ভবতী ছিলেন। গত ২৫ জুন কোভিড আক্রান্ত হয় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই চিকিৎসক মারা যান। কোভিড পজিটিভ হওয়ার দুই সপ্তাহ পর তার মৃত্যু হয়।
বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন নবনীতা সরকার (২৬) নামের আরেক গর্ভবতী নারী।
শুধু ডা. জেবিন বা নবনীতা সরকার নয় দেশে করোনা সংক্রমণের তৃতীয় ঢেউয়ে প্রতিদিনই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত গর্ভবতী নারীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, ডেল্টা ভেরিয়েন্টের কারণে এবারের ওয়েভে আগের তুলনায় নারীদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার বেড়েছে। এর মধ্যে, কোভিড পজিটিভ গর্ভবতী নারীদের মধ্যে সেরে উঠার হার খুবই কম।
সঠিক কোনও পরিসংখ্যান না থাকলেও এবার গর্ভবতী নারীদের মৃতুর হার অনেক বেড়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। গত দুই সপ্তাহে সারা দেশে অন্তত ১৫ জন গর্ভবতী নারী মারা গেছেন। অন্তঃসত্বা অবস্থায় মারা যাওয়া নারীরা ভ্যাকসিন নেননি। তাই গর্ভবতী নারীদের ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎকরা।
তারা জানান, কোভিড পজিটিভ গর্ভবতী নারীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি যেতে বলা হয়।
জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে গর্ভবতী নারীদের ভর্তি ও মৃত্যু অনেক বেড়েছে। গত সাত দিনে হাসপাতালটির আইসিইউতে করোনা আক্রান্ত ছয়জন নারী মারা গেছেন, যাদের মধ্যে চার জনই ছিলেন গর্ভবতী। এছাড়া সাত মাসের গর্ভবতী একজন চিকিৎসক ও একজন মা আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট ডা. আসাদুল মজিদ নোমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এবার আইসিইউতে গর্ভবতী রোগী অনেক বেশি। গত ওয়েভে দু'জন গর্ভবতী নারীর মৃত্যু হয়েছিলো, এবার তা অনেক বেড়েছে। এবার ডেল্টা ভেরিয়েন্টের কারণে রোগীর ফুসফুস দ্রুত আক্রান্ত হচ্ছে এবং তারা দ্রুত মারা যাচ্ছেন। আইসিইউ থেকে গর্ভবতী নারীদের সেরে উঠার হার খুব কম।"
চিকিৎসকরা বলছেন, গর্ভাবস্থায় নারীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই যেকোনো ফ্লু বা সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়া গর্ভাবস্থায় নারীদের পায়ে পানি আসা, ব্লাড সুগার বেড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয় এবং গর্ভস্থ শিশুর চাপে ফুসফুসের ফাংশনাল রেসিডুয়াল সক্ষমতা কমে যায়। এ সময় কোভিডের মত শ্বাসতন্ত্রের ইনফেকশন ফুসফুসের উপর বাড়তি চাপ প্রয়োগ করে পরিস্থিতি মারাত্মক করে তোলে।
ধাত্রীবিদ্যা বিশারদ ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ড. বিদোরা শারমিন বলেন, "অন্যান্য রোগীরদের চেয়ে গর্ভবতী নারী কোভিড আক্রান্ত হলে ঝুঁকি অনেক বেশি, তাই গর্ভবতী হওয়ার পর নারীকে আলাদা করে রাখতে হবে। জ্বর বা কোভিডের মৃদু লক্ষণ দেখা দিলেও ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে ও টেস্ট করতে হবে। আর যদি কোভিডের মাঝারি বা তীব্র সংক্রমণ হয় তাহলে আইসিইউতে রেখে ট্রিটমেন্ট করতে হবে। "
মুগদা জেনারেল হাসপ্তালাএর অ্যানেস্থেশিওলজিস্ট ড. শোমান অনিরুদ্ধ ব্বলেন, "গত তিন সপ্তাহে ২০ থেকে ২৫ জন গর্ভবতী নারী আইসিইউতে চিকিৎসা নিয়েছেন। গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাচ্চার ভালোর জন্য আমরা সব ওষুধ বা ট্রিটমেন্ট দিতে পারিনা। ৩২ সপ্তাহের বেশি হলে গর্ভবতী নারীদের অস্ত্রোপাচার করে বাচ্চা বের করে আইসিইউতে ট্রিটমেন্ট দিলে ভালো ফল পাওয়া যায়। কিন্তু ২০ থেকে ২২ সপ্তাহের গর্ভবতী নারীদের বাচ্চা পেটে রেখে ট্রিটমেন্ট দিতে অনেক সমস্যা হয়। অন্তঃসত্বা নারীদের মৃত্যুর হার বেশি। সুস্থ হলেও আইসিইউতে বেশিদিন থাকতে হচ্ছে।"
ড. অনিরুদ্ধ আরও বলেন, "গর্ভবতী নারীদের ভ্যাকসিন দেওয়া হলে হয়তো গুরুতর অবস্থা কিছুটা কমতো। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, ফাইজার, মর্ডানার ভ্যাকসিন গর্ভবতী মায়েদের দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশেও গর্ভবতী নারীদের ভ্যাকসিন দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা উচি্ত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল বলেন, "কোভিডে গর্ভবতী অবস্থায় ২৫ থেকে ৩০ বছরের নারীরা মারা যাচ্ছেন। বিষয়টি খুব দুঃখজনক। এতে দেশে মাতৃমৃত্যুও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কোভিড পজিটিভ গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসার জন্য আমরা গায়ানোকলজিস্ট, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং অ্যানেস্থেশিওলজিস্টদের সমন্বয়ে একটি সম্মিলিত পরিকল্পনা করবো।"
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ড. রোবেদ আমিন দ্য বিজনেস স্ট্যন্ডার্ডকে বলেন, "সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় গর্ভবতী মায়েরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। এখন গর্ভবতী মায়েদের পরিবার থেকেও খুব সুরক্ষিত রাখতে হবে। যেহেতু গর্ভবতী মায়েদের টিকা প্রয়োগে এখনও বড় পরিসরে কোনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল হয়নি, তাই স্বাস্থ্য অধিদফতর এখন পর্যন্ত গর্ভবতী নারীদের ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।"