চাহিদার তুলনায় সংকট দেখা দিতে পারে কোরবানির গরুর
আসন্ন ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে দেশে চাহিদা অনুযায়ী সংকট দেখা দিতে পারে গরুর। বিগত কয়েক বছরের কোরবানিযোগ্য ও কোরবানিকৃত পশুর পরিসংখ্যান ঘেঁটে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, এবার পর্যাপ্ত কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে, কোন সংকট হবে না।
বিগত বছরগুলোর গরুর সংখ্যার হিসাব করলে দেখা যায়, দেশে জবাইযোগ্য গরুর থেকেও প্রতি বছর ৩ থেকে ১০ লাখ গরু বেশি জবাই হতো। যেগুলোর অধিকাংশই আসতো ভারত থেকে। এবার করোনার কারণে ভারত থেকে গরু আসা সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ায় গরুর সংকট হতে পারে।
তবে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম মনে করেন, গরুর সংকট হলে ক্রেতারা ছাগল বা ভেড়া কিনবেন। এর ফলে গরু ,মহিষ, ছাগল, খাসি, ভেড়া মিলিয়ে কোরবানির জন্য জবাইযোগ্য গবাদি পশুর যে ১ কোটি ১৯ লাখ রয়েছে তা দিয়ে চাহিদা মিটে যাবে। তার ধারণা এবার কোরবানিতে এক কোটির বেশি পশুর চাহিদা থাকবে না।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছরের কোরবানির জন্য জবাইযোগ্য গবাদি পশুর সংখ্যা মোট ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। এর মধ্যে হৃষ্টপুষ্টকৃত গরু-মহিষের সংখ্যা মাত্র ৩৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮০০টি। গৃহপালিত গরু-মহিষের সংখ্যা ৬ লাখ ৮৮ হাজার ২০০টি- এগুলো সাধারণত অনুৎপাদনশীল বলদ, বকনা, বয়স্ক গাভী। হৃষ্টপুষ্ট গরু ও মহিষ মিলে মোট ৪৫ লাখ ৪৭ হাজারটি।
কিন্তু গত বছর শুধু গরু-মহিষই কোরবানি হয়েছে ৫০ লাখ ৫১ হাজার ৯৬৮ টি। যদি গত বছরের সাথেও তুলনা করা হয় সেক্ষেত্রেও গরু-মহিষের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ কম। গতবছর কোরবানির সময় করোনার প্রকোপ বেশি থাকায় পশু কোরবানি কম হয়েছে বলে উল্লেখ করেন অধিদপ্তর।
এ বছর কোরবানির সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'করোনার কারণে গতবার কোরবানি দেয়া কম হয়েছিল। কারণ অনেকে হাটে গিয়ে গরু কিনতে পারে নি। আবার দেখা গেছে একটি গরু দুই জনে মিলে ভাগ করে কোরবানি দিয়েছে। মানুষের আয়ও কম ছিল এর জন্য কিনতে পারে নি। এবার সেটা হবে না, এবার মানুষ কিনবে'।
২০১৯ সালে কোরবানিতে মোট গবাদিপশু জবাই হয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ ১৪ হাজার ২৪১ টি যার মধ্যে গরু ৫৬ লাখ ৫৯ হাজার ৫৯০টি। আর মহিষ ছিল ৫১ হাজার ৮৪৪টি। কিন্তু প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে ২০১৯ এ দেশে জবাইযোগ্য গবাদিপশুর মধ্যে গরু-মহিষ ছিল ৪৫ লাখ ৮২ হাজার। তার মানে সে বছর ১১ লাখ ২৯ হাজার ৪৩৪টি পশু দেশের বাইরে থেকে আনা হয়েছে।
প্রতি বছর দেশের কোরবানির চাহিদার প্রায় ২০ শতাংশ গরু দেশের বাহির থেকে আসে। যেগুলো ভারত থেকে বৈধ কিংবা অবৈধ পথে বাংলাদেশে আসে।
ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, 'আমাদের অনেক গরু কিন্তু বর্ডার দিক থেকে আসে। চোরাচালানের মাধ্যমে গরু আসে এটা বাস্তব সত্য কথা। চোরাচালানে গরু আসলে যারা গরু নিয়ে আসবে তাদের মাধ্যমে করোনার ভারতীয় ভ্যরিয়েন্ট ছড়ানোর শঙ্কা আছে। এটাকে পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। সাথে সাথে দেশি খামারিরাও লাভবান হবে'।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম টিবিএসকে বলেন, 'দেশে প্রতি বছর ৫০ থেকে ৫৫ লাখ গরু কোরবানি হয়। কখনও কখনও গরু মহিষ মিলে এটা ৬০ লাখও হয়। গত দুই বছর ধরে আমাদের আমদানির উপর নির্ভরতা খুবই কম। এক লাখও গরু আসে না। আগে যেখানে ১০ থেকে ১৫ লাখ গরু আসতো এখন সেটা এক লাখেরও নিচে নেমে গেছে। আমাদের দেশে উৎপাদিত গরুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষের আয় কমে গেছে ফলে কয়েকজন মিলেও একটি গরু কোরবানি দিচ্ছে। মানুষের টাকা নেই হাতে সেই কারণে গতবার কম কোরবানি হয়েছে। এবারও গরু-মহিষ- ছাগল , ভেড়া মিলে এক কোটির বেশি কোরবানি হবে না, যেটা পুরোপুরি আমাদের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মেটানো সম্ভব'।
চাহিদার তুলনায় গরুর সংখ্যা কমের বিষয়ে ড. জাহাঙ্গীর বলেন, 'কোরবানিতে গরুর চাহিদা থাকে বেশি। কিন্তু যখন সরবরাহ কম থাকে তখন মানুষ বিকল্প হিসেবে ছাগল, খাসি কিংবা ভেড়া কিনে। ছাগল, খাসির আমাদের প্রচুর উৎপাদন আছে যা এ চাহিদা মেটাতে সক্ষম'।
অন্যান্য বছর অল্প হলেও বৈধ ও অবৈধ উপায়ে ভারত থেকে কোরবানির সময় গরু আসত। কিন্তু এ বছর সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কোনোভাবেই ভারত থেকে গরু আসতে পারবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
খামারিদের অবস্থা
দেশে কোরবানি পশুর চাহিদা অনুযায়ী ছোট-ছোট খামার গড়ে উঠেছে যার মূল লক্ষ্য থাকে কোরবানির পশুর হাট। গ্রামাঞ্চলে বহু পরিবার শুধু কোরবানির ঈদে বিক্রির জন্য ছোট পরিসরে গরু-ছাগল লালন পালন করে।
রাজধানীর গাবতলী, বেড়িবাঁধসহ বেশ কয়েকটি স্থানের গরু ও ছাগলের খামার ঘুরে দেখা যায়, সবগুলো খামারেই চলছে গরু ও ছাগলের শেষ মুহুর্তের পরিচর্যা। খামারিরা ব্যস্ত তাদের খামাদের পশুদের মোটাতাজাকরণ এবং ক্রেতাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার নানা পরিচর্যায়।
খামারিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা এক বছর আগ থেকে গরুর পরিচর্যা করে আসছেন। এক বছর আগে প্রতিটি গরুর বাচ্চা ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় কিনে খামারে লালনপালন করছেন। প্রতিটি গরুর পেছনে তাদের মাসে প্রায় ৯ হাজার টাকা খরচ হয়। এগুলো কোরবানির সময় দেড় লাখ টাকা থেকে শুরু করে ৩ লাখ টাকায় বিক্রি করা হবে। কিছু কিছু গরু বেশি দামে কেনা হয়।
এক বছর লালনপালনের পরে গরু বিক্রি করলে লাভ বেশি হয় বলেও জানান তারা।
গাবতলীর এক খামারী শফিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, '৬০ হাজার টাকার গরুর বাচ্চাকে এক বছর লালনপালন করার পরে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকায় বিক্রি করা যায়। প্রত্যেক গরুতে ১৫/২০ হাজার টাকা লাভ হলেই বিক্রি করে ফেলি। এছাড়া বড় গরুগুলোতে লাভ বেশি হয়'।
ময়মনসিংহের এক খামারি মো. আবুল খান টিবিএসকে বলেন, 'গতবছর আমার খামারে প্রায় ১২০টি ষাড় গরু ছিল। সেগুলোর মধ্যে ৭০টির মতো বিক্রি হয়েছিল। কোনো কোনো গরুতে ১০/১৫ হাজার টাকা লসও হয়েছিল। তাই এ বছর আগের গরুগুলোর সাথে অল্প কিছু গরু রেখেছি যেগুলো কোরবানির জন্য বিক্রি করবো। এ বছর হাতে মূলধন আছে কিন্তু গরু কম'। ২০২০ সালের কোরবানিতে তিনি প্রায় ২ কোটি টাকার গরু বিক্রি করেন বলে জানান।
বিক্রমপুর এগ্রো'র এক কর্মচারী টিবিএসকে জানান, তার খামারে ৭৩টি ষাড় এক বছর ধরে লালনপালন করছেন যেগুলো বাজারে বিক্রি করা হবে। যদি ভারতীয় গরু না আসে তাহলে তাদের প্রায় সবগুলো গরুই বিক্রি হবে বলেও জানান তিনি।
২০১৪ সালে ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের গোরক্ষা নীতির ধারাবাহিকতায় দেশটি থেকে গরু আমদানি কমিয়ে দেয় বাংলাদেশ। তখন থেকে দেশীয়ভাবে গরুর খামার গড়ে তুলতে জোর দেয় সরকার।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (খামার) জিনাত সুলতানা টিবিএসকে বলেন, 'গত চার বছর থেকে আমাদের যে পরিমাণ কোরবানির পশুর চাহিদা সে চাহিদা দেশের পশুই মেটাচ্ছে। এবারও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাই আমাদের সংকট হবে না'।
এ বছর গরু ও মহিষ আছে ৪৫ লাখ ৪৭ হাজারটি, ছাগল ও ভেড়া আছে ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার। আর বিদেশ থেকে আনা দুম্বা বা এই ধরনের প্রাণী আছে আরও চার হাজার ৭৬৫টি। মোট এক কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে খামারির সংখ্যা ছয় লাখ ৯৮ হাজার ১১৫টি। খামারে কোরবানির পশুর পালন হচ্ছে সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রাম বিভাগে। এ বিভাগে পালন হচ্ছে ১৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩১৫টি পশু।
বাংলাদেশে খামারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে উল্লেখ করে জিনাত সুলতানা বলেন, 'স্বাস্থ্যসম্মতভাবে গবাদি পশু পালনের ক্ষেত্রে আমরা খামারিদের পরামর্শ দেই। এ করোনার মধ্যেও আমাদের কর্যক্রম এক দিনও বন্ধ ছিল না'।
বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং সাদিক এগ্রো ফার্মের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইমরান হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'গত বছর ভালো দাম পাওয়ায় এ বছর খামারিরা গরু পালন বেশি করেছে। আমরা আশাবাদী আমাদের পালন করা পশু দিয়ে এবার ঠিকভাবেই কোরবানির চাহিদা মেটাতে পারবো। এবার কোথায় কেমন চাহিদা সেটা আগে জানিয়ে দিলে সে অনুপাতে সরবরাহ করতে পারবে খামারিরা'।
অনলাইনে গরু বিক্রির বিষয়ে ইমরান হোসেন বলেন, 'গবাদি পশু বিক্রি করার জন্য ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন 'ডিজিটাল হাট' কয়েক দিনের মধ্যেই চালু করবে। আমরা ইতোমধ্যেই আমাদের খামার থেকে অনলাইনে গরু বিক্রি করার ব্যবস্থা রাখছি। কেউ চাইলে আমাদের এখানে গরু কিনে রেখে দিতে পারবেন যা কোরবানির দিন কোরবানি করে মাংস নিয়ে যেতে পারবেন'।