জাহাজকে পথ দেখিয়ে তিন বাতিঘরের আয় ৭৪ কোটি টাকা
উত্তাল সাগরে অবস্থান জানতে কিংবা বিদেশ থেকে আসা নাবিকদের বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান জানাতে সাহায্য করে বাতিঘর। বাতিঘরের সিগন্যাল দেখে অবস্থান নিশ্চিত করে নাবিক। আবার কোনো কারণে সাগরে গতিপথ হারিয়ে ফেললে দিক নির্দশনের জন্য সহায়তা করে এ বাতিঘরগুলো। দেশের তিনটি বাতিঘরের এ আলোর বিচ্ছুরণ থেকে সাহায্য নেওয়ার জন্য জাহাজ মালিকদের গুণতে হয় টাকাও। সরকার গত চার বছরে এ খাত থেকে আয় করেছে প্রায় ৭৪ কোটি টাকা। এছাড়াও বাতিঘর সম্প্রসারণের জন্যও নেওয়া হয়েছে আরও একটি প্রকল্প।
দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সিংহভাগ হয়ে থাকে নৌপথ দিয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পণ্য নিয়ে সাগর ও মহাসাগর দিয়ে জাহাজ আসে চট্টগ্রামে। বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশের পর মার্চেন্ট শিপগুলো প্রথমে অবস্থান নেয় চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গর কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়। তারপর আসে চট্টগ্রাম বন্দরে।
কুতুবদিয়া বাতিঘরের বাতিগুলো ১০ সেকেন্ডে তিন বার জ্বলে বা ফ্লাশ করে। সেন্টমার্টিন বাতিঘর ২০ সেকেন্ডে দুই বার জ্বলে। কক্সবাজারের বাতিঘর ১৫ সেকেন্ডে একবার জ্বলে ওঠে। এ সিগন্যাল ব্যবহার করে দূর থেকে আসা জাহাজগুলো বঙ্গোপসাগরে তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে।
তিনটি বাতিঘরের আলো বিক্রি করে ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫ মাসে দেশের আয় হয়েছে ৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা, ১৮-১৯ অর্থ বছরে ২২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা আয় করেছে নৌ-বাণিজ্য দফতর।
সংস্থাটির প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমদ বলেন, সমুদ্রগামী দেশি-বিদেশি জাহাজ এবং উপকূলীয় এলাকায় চলাচলকারী জাহাজ মালিকদের এ টাকা পরিশোধ করতে হয়। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের লাইট হাউস অর্ডিনেন্স অনুযায়ী নেট রেজিস্ট্রার টন (এনআরটি) হিসেবে প্রতি টন পণ্যের জন্য ৫ টাকা করে নেওয়া হয়। জাহাজের অবস্থানের উপর নির্ভর করে নেয়া হয় এ টাকা।
কক্সবাজার বাতিঘর দেশের মূল ভূখণ্ডে হওয়ায় পিডিবির বিদ্যুৎ সরবরাহের কারণে সচল রাখার কাজটা সহজ। কিন্তু কুতুবদিয়া ও সেন্টমার্টিনের বাতিঘর সচল রাখতে হয় জেনারেটর ও সৌরবিদ্যুতের সাহায্যে।
নৌবাণিজ্য দফতর সূত্রে জানা যায়, সমুদ্রগামী জাহাজের ক্ষেত্রে মাসে টনপ্রতি পাঁচ টাকা বাতিঘর ফি নেওয়া হয়। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ অন্যান্য চার্জের সঙ্গে ওই টাকা সংগ্রহ করে নৌবাণিজ্য দফতরকে বুঝিয়ে দেয়। এ ছাড়া ১০ টনের ওপরের ফিশিং ট্রলার ও অন্যান্য দেশি জাহাজের ক্ষেত্রে বার্ষিক টনপ্রতি দুই টাকা হারে বাতিঘর চার্জ নেওয়া হয়। শুধুমাত্র শুভেচ্ছা সফরে আসা বিদেশি জাহাজের ক্ষেত্রে বাতিঘর চার্জ নেওয়া হয় না।
কুতুবদিয়ায় ১৮৪৬ সালে প্রথম বাতিঘর চালু হয়। ইটের সুউচ্চ গাঁথুনির ওপর বিশেষ কৌশলে নির্মিত মূল বাতিঘরটি সাগরে বিলীন হওয়ার পর কিছুটা দূরে লোহার এঙ্গেল দিয়ে বর্তমান বাতিঘরটি তৈরি করা হয়। বর্তমানে এটি ১২০ ফুট উচু। ৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে আড়াইশ’ ফুট উঁচু করা হবে বাতিঘরটি। প্রতি ১০ সেকেন্ড তিনটি সাদা আলোর ঝলকানি দেয় এ লাইট হাউস।
১৯৭৬ সালে কক্সবাজার বাতিঘরটি স্থাপন করা হয়। ফোকাল প্লেন ৫৪ মিটার (১৭৭ ফুট); প্রতি ১৫ এস সাদা ফ্ল্যাশ। প্রায় ১০ মিটার (৩৩ ফুট) কাঠামো, একটি ২ বর্গক্ষেত্রের কংক্রিটের ভবনের ছাদকে কেন্দ্র করে লণ্ঠন এবং গ্যালারীসহ একটি ছোট বর্গাকার কঙ্কাল টাওয়ার।
সেন্টমার্টিন দ্বীপেও ১৯৭৬ সালে বাতিঘর নির্মাণ করা হয়। ফোকাল প্লেন ৩৯ মিটার (১২৮ ফুট); প্রতি ৩০ সেকেন্ডে দুটি সাদা ফ্ল্যাশ। লণ্ঠন এবং গ্যালারীসহ ৩৫ মিটার (১১৫ ফুট) বর্গাকার পিরামিডাল কঙ্কালের টাওয়ার।
এ প্রসঙ্গে নৌবাণিজ্য দফতরের ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার বাহারুল ইসলাম বলেন, তিনটি বাতিঘরের তিন ধরণের বৈশিষ্ট্য। কুতুবদিয়া সেন্টমার্টিনে বাতিঘর দুইটি উপকূল থেকে ১৯ দশমিক ৮ ন্যটিক্যাল মাইল কাভার করে। আর কক্সবাজারের বাতিঘরটি ২৪ দশমিক ৫ ন্যটিক্যাল মাইল দূর থেকে দেখা যায়। নতুন চারটি বাতিঘরের উচ্চতা ও রেঞ্জ আরো বেশি হবে।
৩৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘এস্টাবলিশমেন্ট অব জিএমডি এসএস অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম’ প্রকল্পের আওতায় নিঝুমদ্বীপ, ঢালচর, দুবলারচর, কুয়াকাটায় চারটি নতুন বাতিঘর ও দেশের সাতটি উপকূলীয় এলাকায় সিগন্যাল রেডিও স্টেশন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া বাতিঘর আধুনিকায়নও করা হবে।
এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উপকূলে নৌ-নিরাপত্তা ব্যবস্থা, নেভিগেশনাল সহায়তা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন ও পরিচালনা সহজতর হবে। ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের (আইএমও) আন্তর্জাতিক কনভেনশনের চাহিদা পূরণ, আধুনিক নেভিগেশনাল সহায়তা, ভ্যাসেল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।