স্বাস্থ্য ও কৃষি খাত ছাড়া এডিপিতে নতুন প্রকল্প নয়
জরুরি স্বাস্থ্য সেবা এবং কৃষিখাতের প্রকল্প ছাড়া এবং আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) নতুন কোনো প্রকল্প অনুমোদন দেবে না সরকার। করোনাভাইরাসে কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি এবং আসন্ন বিশ্বমন্দার প্রেক্ষিতে সরকারি ব্যয়ের চাপ কমাতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছ্ সরকার।
এছাড়া চলমান প্রকল্পের ক্ষেত্রেও নতুন এডিপিতে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের প্রকল্প সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে জানান পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা।
পরিকল্পনা বিভাগ সচিব নূরুল আমিন দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, আগামী অর্থসবছরের এডিপিতে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের জরুরি প্রকল্প ছাড়া অন্য কোনো খাতের অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। তবে এমন কোনো প্রকল্প যদি আসে যা অনুমোদন না দিলেই নয়, সে ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতসহ চলমান অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করাসহ এবং করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এদিকে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, অন্যান্য খাতে চলমান প্রকল্পে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। একদিকে এডিপির বরাদ্দ কমানো অন্যদিকে অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার বিষয়টি বিবেচনা নিয়ে চলমান প্রকল্পে বরাদ্দ বন্টন করা হবে। সরকারি বিনিয়োগকে বাড়ালে তা বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়বে। এ বিবেচনায় চলমান মেগা প্রকল্পগুলোও প্রয়োনীয় বরাদ্দ দিয়ে চালু রাখতে হবে। তা না হলে আবার কর্মসংস্থানের ওপর প্রভাব পড়তে পারে।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী জানান, চলমান কিছু প্রকল্প এখনই থামিয়ে দেওয়া উচিত। তার আগে যে সব প্রকল্প এখনই বাস্তবায়ন না করলে সমস্যা হবে না সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। প্রকল্প চিহ্নিত করতে একটি কমিটি গঠন করা হতে পারে। পরে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।
তিনি আরও জানান, আগামী অর্থবছরে চলমান প্রকল্পে বরাদ্দ এবং নতুন প্রকল্পে অনুমোদনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাবে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাত।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তা জানান, আগামী অর্থবছরের এডিপি প্রণয়নের কাজ চলেছে। গত ২৩ মার্চ এডিপি প্রণয়ন সংক্রান্ত নির্দেশনা পরিকল্পনা কমিশন থেকে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে করোনা পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হওয়ায় নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আনা আনা হয়েছে। মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে এ বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তারা সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিচ্ছে, যাতে লকডাউন শেষ হলেই দ্রুত এডিপি অনুমোদন চূড়ান্ত করা যায়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাত সব সময়ে অবহেলিত । জিডিপি হিসাব অনুযায়ী স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ১ শতাংশের কম। এ খাতে এত কম বরাদ্দ, যা করোনা প্রাদুর্ভাবের সময়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে ভোগান্তির আরেকটি কারণ হলো অব্যবস্থাপনা। দেখা যায় হাসপাতাল আছে, ডাক্তার পাওয়া যায় না, ওষুধ পাওয়া যায় না, যন্ত্রপাতিতো পাওয়াই যায় না। গরিব মানুষ কোথাও কোনো সেবা পায় না- শহরে না আসলে। গ্রামের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে অব্যবস্থাপনা তদারকি জোরদার করতে হবে । তা না হলে বরাদ্দ দিলেও সে টাকা নষ্ট হবে।
তিনি আরও বলেন, কৃষি খাতেও একই কথা, এখন আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। করোনা কারণে আমাদের কৃষি উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা কমে যেতে পারে । আবার কৃষক যদি দাম না পায় তাহলে কৃষক পরবর্তী বছরে উৎপাদনে আগ্রহী হবে না। এই যে আমাদের এখন বোরো ধান হবে। দাম না পেলে কৃষক আগামী বছরে উৎপাদনে যাবে না। এ জন্য কৃষকদের পর্যাপ্ত প্রণোদনা দেওয়া দরকার।
করোনা পরিস্থিতিতে অনেককেই খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। চাহিদা বাড়বে। আমদানি করতে চাইলেও তা করা যাবে না। কারণ করোনভাইরাসে বিশ্বের প্রতিটি দেশই ক্ষতিগ্রস্ত। ২০০৮ সালের বিশ্ব মন্দার সময় দেখা গেছে, কোনো দেশ থেকেই চাল আমদানি করতে পারছিলাম না। ফলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
এসব কারণে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতের প্রকল্পে বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং নতুন প্রকল্পে অনুমোদনে এ দুই খাতের প্রকল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিবছর সরকার নতুন নতুন প্রকল্প অনুমোদন দিচ্ছে। এতে এডিপিতে নতুন প্রকল্পের সংখ্যা ক্রমগত বাড়ছে অন্যদিকে সব প্রকল্পের বরাদ্দও কমে যাচ্ছে। অনেক প্রকল্পকে প্রতিবছর নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হচ্ছে। বছরের পর বছর প্রয়োজনীয় বরাদ্দের অভাবে বাস্তবায়নকাজে গতি না থাকায় এসব প্রকল্পের ব্যয় কয়েকগুণে বেড়ে যায়। এতে সরকারি অর্থের অপচয় বাড়ছে।
গত কয়েক বছরে ধরে নানা ধরণের উদ্যোগ নিয়েও অগুরুত্বপূর্ণ নতুন প্রকল্পের চাপ ঠেকাতে পারছে না পরিকল্পনা কমিশন। রাজনৈতিক বিবেচনা প্রভাবশালী আমলততন্ত্রের চাপে প্রতি বছরে অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অনুমোদন পাচ্ছে। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পও পর্যাপ্ত বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে চলতি অর্থবছরেরর শুরুর দিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নতুন প্রকল্প বাঁছাই করতে পরিকল্পনা কমিশন একটি পরিপত্রও জারি করে।
চলতি অর্থবছরের এডিপিতে ১৪৭৫টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে সারা বছরজুড়ে আরও ২৪৪টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে সংশোধিত এডিপিতে চলামান প্রকল্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭৮৩ টি। এছাড়া স্বায়ত্বশাসিত বিভিন্ন সংখ্যার প্রকল্প রয়েছে ১০৩টি। ফলে সংশোধিত এডিপি প্রকল্প সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮৪৬টি ।
অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে ৭৭১টি এবং বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির ভিত্তিতে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে আরও ১৯০টি প্রকল্প।
সংশোধিত এডিপিতে মোট বরাদ্দ রয়েছে এক লাখ ৯২ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। স্বায়ত্বশাসিত বিভিন্ন সংখ্যার প্রকল্পে বরাদ্দসহ সংশোধিত এডিপির আকার দুই লাখ এক হাজার ১৯৮ কোটি টাকা।
করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা দিয়েছেন।
কৃষক, স্বাস্থ্য কর্মী, দিনমজুরসহ আয়শূন্য হয়ে যাওয়া মানুষকে এসব প্রণোদনা দেওয়া হবে। এছাড়া স্বল্প-আয়ের মানুষদের বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করা এবং শহরাঞ্চলে বসবাসরত নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ওএমএস-এর আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাউল বিক্রয় কার্যক্রম চালু করা হয়েছে।
আর্থিক সহায়তার প্যাকেজের আওতায় শিল্পখাতে যেসব আর্থিক প্যাকেজ গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে: ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের , অতি-ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের সরবরাহ , রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য বিশেষ তহবিল গঠন এবং কৃষিখাতে চলতি মূলধন সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
করোনা মহামারিতে সরকার জীবন রক্ষার ওপর আগে গুরুত্ব দিচ্ছে। একারণে দরিদ্র মানুষকে বাঁচিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস এবং বৈদেশিক সহায়তার অর্থসহায়তা প্রয়োজন হবে।
এদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই থেকে জানুয়ারি) রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ৩৯ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা। জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ঘাটতি ছিল ৩১ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অর্থবছরের ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে সরকার।
এ অবস্থায় করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবিলায় অর্থ সংগ্রহ সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছে অর্থনীতিবিদরা। সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্থার কাছে উদ্বৃত্ত অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে। একই সঙ্গে এডিপির বরাদ্দ অর্থ করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।