লকডাউনেও করোনার নমুনা সংগ্রহে হাসপাতালগুলোতে দীর্ঘ সারি
গতকাল (১৫ এপ্রিল) ছিল সারাদেশে কঠোর লকডাউনের দ্বিতীয় দিন। তবু জীবন বাঁচানোর আশায় লকডাউন উপেক্ষা করেই করোনার স্যাম্পল বা নমুনা সংগ্রহ করতে হাসপাতালে ভিড় করেন বহু মানুষ।
সকাল সাড়ে ১০টায় মুগদা জেনারেল হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে করোনার নমুনা সংগ্রহের দীর্ঘ সারি চোখে পড়ে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর ভিড় আরো কিছুটা বেড়ে যায়।
ভোর থেকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ফটকের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন রামপুরার সাথী আক্তার। তিনি টিবিএসকে বলেন, "আমার বৃদ্ধা মা শিল্পী বেগমের (৬২) ৫-৭ দিন যাবত জ্বর- সর্দি। গত রাত থেকে তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হলে সকালে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসি। কিন্তু হাসপাতাল থেকে বলছে, আগে স্যাম্পল কালেকশন করতে হবে। তারপর চিকিৎসা দিবে। সকল ৭টায় এসেছি, তিন ঘন্টা হয়ে গেছে এখনো স্যাম্পল কালেক্ট করতে পারিনি"।
সাথী আক্তারের মতই লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন কাপড়ের দোকানী জোবায়ের আহমেদ। কেরানীগঞ্জ থেকে অসুস্থ মা জোবায়েদা খাতুন (৬৫) কে তিনি নিয়ে আসেন মুগদা জেনারেল হাসপাতালে।
তিনি জানান, "অসুস্থ মা গত পাচঁদিন ধরে জ্বর, সর্দি এবং তীব্র শ্বাসকষ্টে ভুগছে। আজকে সকাল থেকে প্রায় অচেতন, হাঁটারও শক্তি নেই। সকাল সাতটা থেকে প্রায় ২ ঘন্টা রাস্তায় একটা গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম, উপায় না পেয়ে কিছু পথ রিকশা এবং বাকিটা সিএনজি করে এখানে এসেছি"।
কান্নাজড়িত কন্ঠে ছেলে জোবায়ের রহমান টিবিএসকে বলেন, "আমার মাকে এখনো হাসপাতালে ভর্তি করাতে পারি নাই, হাসপাতাল থেকে বলছে আগে করোনা পরীক্ষা করাতে হবে, তারপর সিট ফাঁকা থাকলে ভর্তি করাবে। কিন্তু আমি লাইনে দাঁড়িয়ে স্যাম্পল কালেকশনই শেষ করতে পারি নাই"।
"অথচ অক্সিজেনের অভাবে আমার মা দম নিতে পারছে না, অক্সিজেন না দিতে পারলে মনে হয় আমার মাকে বাঁচাতে পারবো না। আমি ১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। এখন যদি চিকিৎসার অভাবে মাকে হারাই তাহলে এই দুনিয়ায় আমার আর আপন কেউ থাকবে না"।
নূরজাহান বেগম (৪০) নামে আরেকজনকে বসে থাকতে দেখা যায় হাসপাতালটির ভিতরের সিঁড়িতে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, "গত কয়েকদিন ধরে গায়ে জ্বর। কখনো বাড়ে, কখনো কমে। ওষুধ খেয়েও সুস্থ হইনি। ৫ দিন ধরে গলাব্যথা আর কাশি। সকালে গাড়ি না পেয়ে পরে ছেলের মোটরবাইকে চড়ে করোনা টেস্ট করাতে হাসপাতালে এসেছি। নমুনা দেয়ার জন্য লাইনে কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন হাত পা কাঁপছে। আজ নমুনা দিতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে।"।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিত্রও প্রায় একই। তবে দুপুরের পর এখানে নমুনা সংগ্রহের ভিড় কিছুটা কম দেখা গেছে।
উম্মে হাবিবা নামের একজন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সকালে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল থেকে ঢাকা মেডিকেলে এসেছি বাবাকে নিয়ে। কিন্তু এখানেও একই ভোগান্তি। তিন ঘন্টা হলো এম্বুলেন্সেই আছি। হাসপাতাল থেকে এখন বলছে আগে করোনার টেস্ট করানোর জন্য। কিন্ত এখানে এসে এখনো টেস্ট করানোর রিপোর্ট পাইনি"।
"হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে আজকে আর আর রিপোর্ট দেয়া সম্ভব না। আগামীকাল ভোর সকালে রিপোর্ট পাব। কিন্তু রিপোর্ট না হলে রোগীকে আইসিইউ বেড দিবে না"।
এদিকে লকডাউনে নমুনা পরীক্ষা করাতে এসে যানবাহন সংকটের ভোগান্তিতে পড়েছেন রোগী ও রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনেরা।
তারপরও গতকাল মুগদা হাসপাতালে শত শত রোগী আসা-যাওয়া করেছে। অনেকে দীর্ঘ সময় এম্বুলেন্সেই অপেক্ষা করেছেন হাসপাতালে একটি সিটের আশায়। আবার বেড না পেয়ে আশাহত হয়ে অনেককে বাড়ির পথও ধরতে দেখা গেছে।
এ ব্যাপারে মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাগ বলেন, "হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা করতে আসা সব বয়সী রোগীর উপস্থিতিই বেড়েছে। আমরা দৈনিক ১৮৮টি নমুনা পরীক্ষা করতে পারি, কিন্তু রোগীর চাপ কয়েকগুণ বেশি। তাই কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে।"
তবে তিনি অভিযোগ করে বলেন, "কিছু রোগী নির্দিষ্ট সময়ে না এসে সকালেই এসে হাসপাতালের সামনে ভিড় করছেন। আমরা সবাইকে একই সময় আসতে শিডিউল দেইনি। খুব সকালে যাদের আসার কথা তাদের কেউ কেউ দুপুরে এসে ভিড় করছেন। আবার যাদের দুপুরের পরে আসার কথা তাদেরও অনেকে আগে থেকেই খুব সকালে এসে থাকছেন"।
তিনি আরও বলেন, "এখানে যারা ভর্তি হচ্ছেন, আমরা চেষ্টা করছি তাদের পর্যাপ্ত অক্সিজেন সেবা দেয়ার জন্য। কারণ এখন প্রায় ৫২% রোগীরই অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে"।
ডা. অসীম কুমার নাগ আরও বলেন, "আমাদের অনুরোধ, যাদেরই করোনার লক্ষণ দেখা দিবে তারা যেন দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেয়। সবাইকে যে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে এমনটা নয়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী বাসা থেকেও সেবা নেওয়া উচিত"।