সাংবাদিক মুজাক্কির হত্যা: বিচারের দাবিতে পরিবারের সংবাদ সম্মেলন
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে মেয়র আবদুল কাদের মির্জা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির হত্যার সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে তার পরিবার।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় নোয়াখালী জেলা প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন নিহতের বড় ভাই নূর উদ্দিন।
তিনি বলেন, 'নিহত মুজাক্কির সাংবাদিকতা পেশার পাশাপাশি সামাজিক ও মানবিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তিনি অসুস্থ ও মুমূর্ষ রোগীদের পাশে দাঁড়াতেন। রোগীদের প্রয়োজনে এ নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত ২৬ জনকে দিয়েছেন। করোনাকালে নিজ এলাকার অসহায় ও গরিব মানুষের দ্বারে দ্বারে খাবার এবং প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিয়েছেন। ঈদে দুঃস্থ ও এতিমদের গোপনে সহযোগিতা করতেন।'
নূর উদ্দিন আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, 'গত শুক্রবার উপজেলার চাপরাশিরহাট পূর্ব বাজারে আওয়ামী লীগের দু'পক্ষের সংঘর্ষের সময় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন মুজাক্কির। এ সময় আহত মুজাক্কির বাঁচার জন্য বার বার আকুতি জানালেও উপস্থিত স্থানীয় লোকজন, জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ সদস্যরা তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি। গুলিবিদ্ধ হয়ে দীর্ঘসময় বাজারে পড়ে থাকার কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মুজাক্কির মৃত্যুবরণ করেন বলে জানিয়েছেন ঢামেকের চিকিৎসক।'
সংবাদ সম্মেলনে নিহতের পিতা মাওলানা নূরুল হুদা মো. নোয়াব আলী মাস্টার জানান, ওইদিন ঘটনাস্থলে তিনি বা তার পরিবারের কেউ উপস্থিত ছিলেন না। তাই কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তারা দেখেননি। তবে যারা এ হত্যার সাথে জড়িত, সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত খুনিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের দাবি জানান তিনি।
নিহতের মা মমতাজ বেগম কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, "আমার আদরের ছোট ছেলে মারা যাওয়ার পর আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে গতকাল (বুধবার) একটি ভিডিও দেখেছিলাম। ভিডিওতে দেখা যায়, গত কয়েক মাস আগে একজন ব্যক্তি তাকে অকথ্যভাষায় গালাগালি ও মারধর করে। ওই হামলাকারী তাকে বলে 'তোর কোন বাবা আছে?' আমি ওই হামলাকারীকে গ্রেপ্তার করার জন্য প্রশাসনকে অনুরোধ করছি।'
এ ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নিবেন বলে জানিয়েছেন নিহতের ভগ্নিপতি আবদুস সাত্তার।
আগেও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন মুজাক্কির
আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর আগেও একবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির। ২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মুজাক্কিরকে নির্যাতন করা হয়েছিল- এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন ভাইরাল। ভিডিওটি বর্তমানে সংবাদকর্মী ও প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলের কাছে সংরক্ষিত আছে।
ওই ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, হাসান ইমাম রাসেল নামে কোম্পানীগঞ্জের এক ব্যক্তি বসুরহাট বাজারের একটি ইলেট্রিক দোকানে বসিয়ে রেখে সাংবাদিক মুজাক্কিরকে মারধর করেন। এ সময় মুজাক্কিরকে মারধর করতে করতে অকথ্যভাষায় গালমন্ধ করে হাসান ইমাম রাসেল বলেন, 'বোলা কারে বোলাবি বোলা, তোর কোন বাপ আছে বোলা, বোলাছ না, কারে বোলাবি বোলা...' (আঞ্চলিক ভাষা)।
ওই নির্যাতনের সময় সাংবাদিক মুজাক্কিরকে নির্যাতনকারী রাসেলের অপর সহযোগীর 'চলে যা, চলে যা...' বলে কথার রেকর্ডও রয়েছে। এর কিছুক্ষণ পর দেখা যায় মুজাক্কিরকে ওই স্থান থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন।
মুজাক্কিরকে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের অনুসারী হিসেবে চিহ্নিত করে এ নির্যাতন করা হয় বলে আওয়ামী লীগের অনেকে দাবি করেছেন। অপরদিকে মুজাক্কির হত্যাকাণ্ডের পর মিজানুর রহমান বাদলও তাকে তার কর্মী বলে দাবি করছেন।
এ বিষয়ে জানতে হাসান ইমাম রাসেলের মোবাইলে একাধিকবার কল দিলেও তিনি লাইনটি কেটে দেন। তবে তার ব্যবহৃত ফেসবুক আইডিতে লিখেন, "মুজাক্কির আমাদের সাথে, একসাথে কাজ করত। তখন যে মাঝে মাঝে আসত। নোয়াখালীতে পড়াশোনা করত। কারও প্ররোচনায় পড়ে সে আমার ফেসবুকে ফেক আইডি থেকে বাজে কমেন্ট করত। তখন রনির দোকানে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কেন এসব করছ?' সে বলল, 'বাদল ভাইয়ের বিরোধিতা করেন, সেজন্য আমি এমন করছি।' তখন রাগ করে তাকে বকাঝকা করছি। ৫ মিনিট পরই আবার তাকে বুকে টেনে নিয়েছি।"
তিনি দাবি করেন, মুজাক্কিরের মৃত্যুর ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি মীর জাহিদুল হক রনি বলেন, 'মুজাক্কিরকে নির্যাতনের ভিডিওটি ইতোমধ্যে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। ভিডিওটিতে দেখা গেছে উপজেলার কথিত সাংবাদিক রাসেল (হাসান ইমাম রাসেল) মুজাক্কিরকে গালমন্দ ও মারধর করছে। ওই দোকানটা বসুরহাট বাজারের অন্য একজন সাংবাদিকের। ওই সাংবাদিক আমাদের জানিয়েছেন, মুজাক্কিরকে রাসেল মারধর করতে দেখে তিনি এসে বিষয়টি সমাধান করে দিয়েছিলেন। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ভিডিওটি দেখছেন। অপরাধী যেই হোক না কেন, তাকে ছাড় দেওয়া হবে না।'
শুক্রবার যা ঘটেছিল
গত শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) উপজেলার চাপরাশিরহাট পূর্ব বাজারে বসুরহাট পৌরসভার মেয়র মির্জা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বাদলের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারসেল ও শর্টগানের গুলি ছুঁড়ে। ঘটনার ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে গিয়ে ত্রিমুখী সংঘর্ষের মুখে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক মুজাক্কির'সহ ৭-৮ জন। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় মুজাক্কিরকে প্রথমে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে গত শনিবার রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে তার মৃত্যু হয়।
মুজাক্কির অনলাইন নিউজ পোর্টাল বার্তা বাজারের নোয়াখালী প্রতিনিধি ছিলেন।