‘বঙ্গোপসাগরে ভারতের দাবি ভিত্তিহীন’
দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমায় ভারতের দাবির কোনো আইনি ভিত্তি নেই। একইসঙ্গে, আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন অনুসারেও এই দাবি সমর্থনযোগ্য নয় বলে জানিয়েছেন সমুদ্র বিশেষজ্ঞ রিয়ার এডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্সের সচিব খুরশেদ আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আপনি কোনো বিরোধ নিয়ে আপত্তি জানাতে পারেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালতের রায় ঘোষণার পর আপনি জাতিসংঘের মতো উচ্চপর্যায়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার পর্যালোচনার তদবির করতে পারেন না। "
২০১৪ সালে নিষ্পত্তি হওয়ার পরেও সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধের অবসান না ঘটায় ১৩ সেপ্টেম্বর ভারতের দাবির বিরুদ্ধে জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে দেওয়া এক চিঠিতে আনুষ্ঠানিক আপত্তি জানায় বাংলাদেশ।
বঙ্গোপসাগরে ভারতের ব্যবহার করে আসা বেসলাইন বা ভিত্তিরেখা এবং মহীসোপান বা কন্টিনেন্টাল শেলফ নিয়েই এই আপত্তি। ভারত নিজেদের সমুদ্রসীমা হিসেবে যে অংশ নির্ধারণ করেছে তা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার অন্তর্ভুক্ত।
দীর্ঘ সাত বছর দ্বিপাক্ষিয়ভাবে বিরোধ নিরসনে ব্যর্থ হয়ে ঢাকা ভারতের অবস্থান জানিয়ে বিষয়টি জাতিসংঘের কাছে উপস্থাপন করে।
খুরশেদ আলম বলেন, "আমরা জাতিসংগকে জানিয়েছি যে, যেহেতু এই বিরোধের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, সুতরাং ভারতের আপত্তি তোলার কোনো সুযোগই নেই।"
জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে পাঠানো পৃথক এক চিঠিতে ঢাকা ভারতের দাবি নিয়েও আপত্তি জানিয়েছে।
"২০০৯ সালে ভারতের নির্ধারিত ভিত্তিরেখা আন্তর্জাতিক আইন সমর্থন করে না, কেননা শেষ তিন সমুদ্রমুখী বেস পয়েন্ট ভূখণ্ডে নয় বরং সমুদ্রে অবস্থিত। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের ৮৭ নাম্বার বেস পয়েন্ট সমুদ্রতীর থেকে প্রায় ১০ দশমিক ৫ নটিক্যাল মাইল দূরে পুরোপুরি সমুদ্রের মাঝে অবস্থিত। একইসঙ্গে, দেশটির ৮৯ নাম্বার বেস পয়েন্টটি বাংলাদেশের জলসীমার ২ দশমিক ৩ মাইল ভেতরে অবস্থিত," বলেন তিনি।
জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি (ইউএনসিএলওএস) অনুসারে, ভিত্তিরেখা নির্ধারণকারী বেস পয়েন্ট কোনোভাবেই সমুদ্রে পড়বে না।
খুরশেদ আলম জানান, ২০১৪ সালে সমুদ্রসীমানা নির্ধারিত হওয়ায় ভারতকে অবশ্যই ৮৯ নাম্বার বেস পয়েন্টে সংশোধন আনতে হবে।
বেসলাইন হলো উপকূল বরাবর একটি রেখা যা থেকে একটি দেশের আঞ্চলিক সমুদ্রসীমাসহ একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের মতো অধিকারভুক্ত অন্যান্য সমুদ্র অঞ্চল পরিমাপ করা হয়।
ইউএনসিএলওএস অনুসারে, কোনো দেশের বেসলাইন থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত অঞ্চলে ওই দেশের বিশেষ অধিকার থাকে। ওই অঞ্চলে বায়ু ও জল থেকে জ্বালানি উৎপাদন এবং সমুদ্র থেকে খনিজ সম্পদ উত্তলন ও অনুসন্ধানে দেশটির একচেটিয়া অধিকার থাকে।
ঢাকার বেসলাইন সীমা নির্ধারণকারী বাংলাদেশের বেস পয়েন্ট খুলনার পুটনী দ্বীপে পড়ে।
ভারতের মহীসোপানের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ একটি সিসেমিক জরিপের মাধ্যমে দেশের মহীসোপানের সীমা নির্ধারণ করা একটি প্রতিবেদন জাতিসংঘের কাছে জমা দেয় বলে জানান খুরশেদ আলম।
"পরবর্তীতে, আন্তর্জাতিক একটি আদালত ভারত এবং বাংলাদেশের মহীসোপানের সীমা নির্ধারণ করে। রায় অনুসারে আমরা আমাদের সীমা ঠিক করে গতবছর জাতিসংঘের কাছে জমা দিই। কিন্তু, ভারত সেটিরও বিরোধিতা করে ভেটো প্রদান করে। তারা জাতিসংঘকে আমাদের প্রতিবেদন গ্রহণ না করার অনুরোধ করে," বলেন খুরশেদ আলম।
কন্টিনেন্টাল সেলফের বিষয়ে জাতিসংঘের একটি কমিটি আছে। কমিশন অন দ্য লিমিটস অব দ্য কন্টিনেন্টাল শেলফ (সিএলসিএস) কমিটিতে সমুদ্র বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা দাবি-দাওয়া যাচাই করে থাকেন।
পুরো বিষয়টি কমিটি যাচাই করার পরই ঢাকা সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ।
দিল্লির দাবি অনুসারে ভারত নিজেদের মতো করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে কি না এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "না, ভারত তা পারে না।"
"আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কোন দেশের দাবি সমর্থনযোগ্য তা আদালত বিচার করবে। আমাদের জমা দেওয়া তথ্য সঠিক কি না, তা যাচাই করবে তারা," বলেন তিনি।
খুরশেদ আলম আরও জানান, ঢাকা দিল্লির সঙ্গে দ্বিপাক্ষীয় আলোচনাতেও অংশ নিচ্ছে। সমঝোতার মাধ্যমে প্রতিবেশি দুই দেশ সমাধানে আসার চেষ্টা করছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।