ইউটিউব ভিলেজ: যেভাবে প্রত্যন্ত গ্রামটি পরিচিতি পেল সারা বিশ্বে
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার খোকসা উপজেলার প্রত্যন্ত শিমুলিয়া গ্রামটি এখন সারা বিশ্বের কাছে ইউটিউব গ্রাম নামে পরিচিত। ২০১৬ সালে লিটন আলী খান নামের এক যুবকের হাত ধরে গ্রামটি প্রথম ইউটিউবে পরিচিতি পায়।
এখন গ্রামটির প্রায় শতভাগ তরুণ তরুণীর ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। তাদের প্রতিদিনের আপলোড করা কন্টেন্ট দেখছেন সারাবিশ্বের লাখ লাখ মানুষ। চ্যানেলগুলো থেকে আয় হওয়া টাকা ব্যয় হচ্ছে গ্রামের দরিদ্র বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়নে।
এ গ্রামের বাসিন্দা, ইউটিউবার লিটন আলী খান জানান, বর্তমানে তার তত্ত্বাবাধনে তিনটি ইউটিউব চ্যানেল পরিচালিত হয়। যার মধ্যে 'অ্যারাউন্ড মি বিডি' নামের এক চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার রয়েছেন ৪৪ লাখ, 'ভিলেজ গ্রান্ডপাস কুকি' চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার রয়েছেন ১৩ লাখ ও 'ফরচুনেট গেস্ট' চ্যানেলে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার সাবস্ক্রাইবার রয়েছেন। এই তিনটি চ্যানেলে এ পর্যন্ত (১০ নভেম্বর) ভিডিও দেখা হয়েছে ১৭২ কোটি ৪৬ লাখ ৪৯ হাজার ৭৬৯ বার।
তিনি বলেন, "তিনটি চ্যানেলেই শিমুলিয়া গ্রামের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, বাজার পরিস্থিতি, মাছ ধরা, রান্নসহ বিভিন্ন ধরনের ভিডিও আপলোড করা হয়। এছাড়াও আমাদের চ্যানেলের পক্ষ থেকে নানা প্রকার আয়োজন করা হয়। সেই সব চিত্র ধারণ করে প্রকাশ করা হয় চ্যানেলে। মূলত দেশের সংস্কৃতি সারা বিশ্বে তুলে ধরতে চ্যানেলগুলো পরিচালনা করছি আমরা।"
২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর অ্যারাউন্ড মি বিডি চ্যানেলটি খোলেন লিটন আলী। "চ্যানেলে প্রথম আপলোড করা হয়েছিল মাছের বাজারের একটি ভিডিও। প্রথম ২ থেকে ৩ মাস আমার আপলোড করা ভিডিওগুলো বেশ সাড়া ফেলে," বলছিলেন তিনি।
ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিও আপলোডের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, "২০১৬ সালের শুরুতে আমি ইউটিউবে দেখতাম সারা বিশ্বের বাজার পরিস্থিতি, খাওয়া দাওয়া, সংস্কৃতি নিয়ে ইউটিউবে বেশ ভিডিও আপলোড হচ্ছে। বাংলাদেশে ওই সময়ে তেমন বেশি রান্না ও খাওয়া দাওয়া, সামাজিক অনুষ্ঠান ও হাট বাজারের ভিডিও আপলোড হত না। তখনই আমি কাজ শুরু করি।"
গ্রামের নাম পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি বলেন, "২০১৯ সালে বেস্ট এভার ফুড রিভিও শো নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলের সত্ত্বাধিকারী সানি আমেরিকা থেকে আমাদের গ্রামে আসেন। তার আগমন উপলক্ষ্যে আমরা যে অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিলাম, সেখানে রান্নার কাজে গ্রামের প্রায় সকল মানুষ স্বতস্ফুর্তভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তখন সানি মন্তব্য করেছিলেন, 'আপনাদের কাজের সাথে গ্রামের পুরো মানুষ জড়িত। তাই এটাকে ইউটিউব ভিলেজ বলা যায়।' তখন থেকেই লোকের মুখে মুখে গ্রামটি ইউটিউব ভিলেজ নামে পরিচিত লাভ করে।"
যদিও সরকারিভাবে গ্রামটি এখনো লিমুলিয়া হিসেবে পরিচিত। তবে কুষ্টিয়া জেলাতে ইউটিউব ভিলেজ না বললে এখন কেউ শিমুলিয়া গ্রাম চেনেন না।
লিটন বলেন, "এখন আমাদের চ্যানেলের তত্ত্বায়বাধনে গ্রামের দরিদ্র মানুষের ঘর নির্মাণ, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট নির্মাণসহ নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়। গ্রামের মানুষের জন্য আমাদের চ্যানেলের পক্ষ থেকে ইউটিউব ভিলেজ পার্ক নামের একটি ২৫ বিঘা আয়তনের পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে।"
এই তিনটি চ্যানেল দিয়ে লিটনের প্রতি মাসে আয় হয় প্রায় ১০ লাখ টাকার কাছাকাছি। ওই টাকা দিয়ে প্রত্যেক মাসে গ্রামের মানুষকে নানা আয়োজন করে খাওয়ানো হয়। যারা রান্নাসহ অন্যান্য কাজে সয়ায়তা করেন তাদেরকে বিশেষ ভাতা দেওয়া হয়।
লিটনের বাড়ি কুষ্টিয়া উপজেলার উত্তর শ্যামপুর গ্রামে। শিমুলিয়া গ্রামে মূলত তার নানার বাড়ি। ২০১২ সালে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করে বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে যৌথ মালিকানায় ইকরাসিস সলুশনস লিমিটেড নামের একটি সফট্যাওয়ার ফার্ম পরিচালনা করছেন তিনি। সেই কাজের সুবিধার্থে বেশিরভাগ সময় ঢাকাতে অবস্থান করেন। বর্তমানে শিমুলিয়া গ্রামে ইউটিউবের জন্য বিভিন্ন ভিডিও বানানোর কাজ পরিচালনা করেন তার মামা দেলোয়ার হোসেন।
দেলোয়ার বলেন, "এখন সপ্তাহে তিন দিন গ্রামে রান্না করা হয়। এতে সহায়তা করেন প্রায় ৫০ জন নারী পুরুষ। ওই খাবার গ্রামের সবাই মিলে বসে একত্রে খাওয়া হয়। সেই ভিডিওগুলো নিয়মিত ইউটিউবে আপলোড করা হচ্ছে। প্রতিক্ষণে আমাদের চ্যানেলগুলোর সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা বেড়েই চলছে।"
তিনি আরও বলেন, "এতে আমাদের গ্রামের অনেকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। আবার আমাদের দেখাদেখি গ্রামের প্রায় অনেকেই ইউটিউবে চ্যানেল খুলেছেন। তাদের মধ্যেও অনেকে ভালো কন্টেন্ট বানাতে সফল হয়েছেন।"
শিমুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস বলেন, "লিটনের হাত ধরে শুরু হলেও এখন গ্রামে তরুণ ও যুবকদের মাধ্যমে হাজারের বেশি চ্যানেল পরিচালিত হচ্ছে। এতে অনেকে মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে। নারীরা তাদের কাজে সহায়তা করে বাড়তি আয় করতে পারছেন। ইউটিউবারদের উপর্জিত অর্থে গ্রামের বিভিন্ন উন্নয়নও হচ্ছে।"