ব্রয়লার মুরগি, ডিমের মূল্যবৃদ্ধি: লাভ উৎপাদকদের, ভুগছে ভোক্তারা
খাদ্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যেই আমিষের তুলনামূলক সস্তা উৎস হিসেবে পরিচিত ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের চড়া দাম ভোক্তার ঘাড়ে নতুন চাপ তৈরি করেছে।
তবে প্রান্তিক পোলট্রি খামারিরা ডিমে লোকসান গুনলেও, দাম বাড়ায় ব্রয়লার মুরগির মাংস উৎপাদন করে লাভ করছে বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএ)।
সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিপিএ নেতারা এসব কথা বলেন। এসময় লিখিত বক্তব্য প্রদান করেন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার।
তিনি বলেন, "প্রায় সপ্তাহখানেক ধরেই হঠাৎ করে বাড়তে শুরু করে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম, এসব খাদ্যপণ্য সীমিত আয়ের মানুষের প্রোটিনের চাহিদা মেটানোর প্রধান উৎস।"
তিনি উল্লেখ করেন, প্রতি ডজন ডিমের দাম ১৩০-১৩৫ টাকা থেকে বেড়ে এখন ১৪৫-১৫০ টাকা এবং প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ১৫৫-১৬০ টাকা থেকে বেড়ে ২০০-২১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-র তথ্যমতে, এক মাসের ব্যবধানে ডিমের দাম ২৩ শতাংশ এবং ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়েছে ২৮ শতাংশ।
রাজধানীর রামপুরা বাজারে মুরগি কিনতে আসা মো. ওয়াসিম টিবিএসকে বলেন, "খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কম বেতনের চাকরিজীবীরা এমনিতেই চাপে রয়েছে। এতদিন তারা ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের ওপর নির্ভর করতেন, এখন এসব পণ্যেরও দাম বেড়ে গেছে।"
এদিকে খামারিরা বলছেন, গত এক বছর আগেও এক বস্তা (৫০ কেজি) পোলট্রি ফিড কিনতে খরচ হতো ২২০০-২৩০০ টাকা; এখন এর দাম ৩,৫০০ টাকা।
তাছাড়া, এক মাস আগেও একদিনের মুরগির বাচ্চার দাম ছিল ৯ টাকা, যেটা এখন ৫৬ টাকা, এর উৎপাদন খরচও এখন ২৫ টাকার মতো।
অর্থনৈতিক এই নাজুক দশার মধ্যে গত এক বছর ধরেই ন্যায্যমূল্যে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে পারেননি বলে জানান খামারিরা।
এক কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ এখন ১৪৮ টাকা, খামারিরা বিক্রি করছেন ১৬০ টাকায়। অথচ দিনকয়েক আগেও বিক্রি করেছেন ১১৮-১২০ টাকায়।
ব্রয়লার মুরগিতে লাভ করলেও, তারা লোকসান দিচ্ছেন ডিম বিক্রিতে। বর্তমানে প্রতিটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১১.১১ টাকা হলেও এখনো বিক্রি করতে হচ্ছে ১০ টাকায়।
বিপিএ সভাপতি সুমন হাওলাদার জানান, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এ বাজারের ১০-২০ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে, যার মধ্যে তাদের নিজস্ব উৎপাদন ও চুক্তি-ভিত্তিক খামারের মাধ্যমে উৎপাদন যুক্ত।
একেকটা কোম্পানি লাখ লাখ পিস মুরগি বাজারজাত করে, যেখানে প্রান্তিক বড় খামারিরাও ৫ থেকে ১০ হাজারের বেশি সরবরাহ করতে পারেন না।
"এই অবস্থায় বাজারে মুরগি ও ডিমের দাম ঠিক হয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্ধারিত দামে," বলেন তিনি।
"কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব মুরগির বাচ্চা উৎপাদন ব্যবস্থা, নিজস্ব ফিড মিল, মেডিসিন রয়েছে। যেখানে খামারিরা তাদের থেকে বাড়তি দাম দিয়ে কেনে,
"যেমন এক বস্তা ব্রয়লার মুরগির ফিড প্রান্তিক খামারি কিনছেন ৩,৫০০ টাকায়, এটাই আবার কোম্পানির চুক্তি-ভিত্তিক খামারি কিনছেন ২,৫০০ টাকায়। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না, যে এ কারণে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ অনেক কমে আসে, যেটা সাধারণ খামারিদের ক্ষেত্রে হয় না," ব্যাখ্যা করেন বিপিএ সভাপতি।
অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দাবি করেন, গত এক বছর ধরেই খামারিরা দেড়শ টাকার মত উৎপাদন খরচ দিয়ে মুরগি উৎপাদন করে বিক্রি করেছে সর্বোচ্চ ১২০ টাকায়। অর্থাৎ, প্রতি কেজিতে লোকসান হয়েছে সর্বোচ্চ ২৫-৩০ টাকা।
এ কারণে এক বছরে উৎপাদনকারী খামারির সংখ্যা এক লাখ ৬০ হাজার থেকে কমতে কমতে এখন ৬০ হাজারে এসে ঠেকেছে।
এসব কারণে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের ডিম ও মুরগির উৎপাদন বন্ধের দাবি জানায় বিপিএ।
যদি এখনই এটা না করা হয়, তাহলে ব্রয়লার মুরগির মাংসের দাম একটা সময় গিয়ে ৪০০ টাকায় ওঠার শঙ্কা প্রকাশ করেন বিপিএ নেতারা।
একইসঙ্গে পোলট্রি ফিড তৈরির উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে এর যৌক্তিক দাম কত হওয়া উচিত তা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রকাশ করার আহ্বান জানান তারা।
খামারিরা আরও বলেন, বর্তমানে মুরগি ও ডিমের বাজারের অস্থিরতার পেছনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উদাসীনতা রয়েছে বলে তারা মনে করেন।
অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস খন্দকার বলেন, "একদিনের মুরগির বাচ্চার দাম ৫৬ টাকা হওয়াটা স্বাভাবিক না। একটা যৌক্তিক দামে যাতে মুরগির বাচ্চা বিক্রি হয়- সেজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে,
"আমরা সরকারকে এসব বলার পরও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না, এটা উদ্বেগের।"
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- এর সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, "রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে যে হারে ফিডের উপকরণের দাম বাড়ছে, তার সঙ্গে সমন্বয় করতে না পেরে অনেক কোম্পানিই এখন উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। শুধু খামারি না, লাভ করতে পারায় ফিড কোম্পানিগুলোও সমাধানের উপায় খুঁজছে।"