ঘরের ভিতর সমুদ্র গড়ায় দক্ষ তিনি, শখ থেকে এখন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী
বিখ্যাত অ্যানিমেশন মুভি 'ফাইন্ডিং নিমো'তে নামভূমিকায় যে মাছটি ছিল তার নাম ক্লাউন ফিশ। ডরি নামের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্রে ছিল ব্লু ট্যাং নামের মাছ। সমুদ্রের যে মাছগুলো অ্যাকুরিয়ামে বসবাস করতে পারে সেগুলোর মধ্যে আরো আছে লিপস্টিক ট্যাং, পার্পল ট্যাং, ইয়েলো ট্যাং, ফক্সফেস, গ্রুপার প্যানথার, লায়ন, অ্যাঞ্জেল ফিশ, হক ফিশ, টেট্রা, স্টার ফিশ, ফায়ার ফিশ, সিক্স লাইন র্যাস ইত্যাদি। এগুলোর নামকরণ হয়েছে মূলত রং ও গড়ন ধরে। যেমন অ্যাঞ্জেল ফিশ বড় এবং বামন দুই রকমেরই আছে। লিপস্টিক ট্যাংয়ের ঠোঁট পুরু হয় এবং আলাদা একটি রং থাকে। ফক্সফেসের মুখটা শিয়ালের মতো হয় দেখতে। স্বাদুপানির বা ফ্রেশ ওয়াটার ট্যাংক ফিশ যেমন জোড়ায় জোড়ায় বিক্রি হয়, সামুদ্রিক মাছ বিক্রি হয় পিস হিসাবে। ৫০০ টাকার কমে সামুদ্রিক মাছ পাওয়া ভার। অনেকগুলোর দাম কয়েক হাজার টাকা হয়। যেমন লায়ন ফিশের দাম ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। বেশিরভাগ মাছই ৩-৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের হয়। কোনোটি ১০-১১ ইঞ্চিও হয়। মেরিন অ্যাকুয়ারিয়াম ফিশের কিছু আছে মাংসভোজী, কিছু হয় নিরামিষভোজী। যেগুলো নিরামিষভোজী সেগুলোকে আমিষ খাওয়ালে ঘণ্টা দুই-তিন পরে মারা যেতে পারে। এরা শ্যাওলা বা শৈবাল খায়। মাংসভোজীগুলোকে সাধারণত চিংড়ি খাওয়ানো হয়। একটা চিংড়ি খেয়েই এরা সপ্তাহ পার করতে পারে। গুটিকয় মেরিন ট্যাংক ফিশের কৃত্রিম প্রজনন সফল হয়েছে, যেমন কমন ক্লাউনফিশ, নিয়ন গোবি, ইয়েলো ডেভিলফিশ ইত্যাদি।
তালহা তখন 'ও' লেভেল শেষ করেছেন
২০০৯ সালে ধানমন্ডির ফিশকিপারসবিডি শপের মালিক মো. তালহা যখন মেরিন ট্যাংক নিয়ে ভাবনা চিন্তা করছিলেন তখনো ঢাকায় তেমনভাবে এ শখের প্রসার ছিল না। তখন ফ্রেশ ওয়াটার ট্যাংকের কথাই জানত বেশি লোকে। স্বাদু পানির মাছ পালন সহজ এবং দামও নাগালের মধ্যে। তালহা যখন 'ও' লেভেলে পড়ছিলেন তখন থেকেই মাছ ফোটাতে পারতেন। প্রথম যে মাছের প্রজনন ঘটাতে সফল হয়েছিলেন সেটির নাম মলি। এটি স্বাদু পানিতে যেমন লবণ পানিতেও স্বচ্ছন্দ। তালহা জানিয়েছেন, মলি হচ্ছে লাইভবিয়ারারস। এরা সরাসরি বাচ্চা দেয়, ডিম থেকে এদের বাচ্চা ফোটে না। তাই এ মাছের প্রজনন সহজ। তালহা ছাত্র থাকাকালেই মাছের প্রজনন ঘটিয়ে কাঁটাবনে নিয়ে বিক্রি করতেন। তাতে তার পকেট খরচ উঠে যেত। একসময় এ কাজে তিনি এতোই দক্ষ হয়ে ওঠেন যে মাছের দোকানগুলোয় তিনি পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। মাছের পোনা বিক্রি করেই তিনি তার 'এ' লেভেলে পড়ার খরচ যুগিয়েছেন। পুরান ঢাকার ইসলামপুরে তাদের ১৪ কাঠা জমির ওপর দাঁড়ানো পেল্লায় বাড়ির ছাদে তিনি ৯০টি ফ্রেশ ওয়াটার ট্যাংক গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু তার মা মাছের সঙ্গে ছেলের সময় কাটানোর ব্যাপারটি একদমই পছন্দ করতেন না। তিনি চাইতেন ছেলে সমাজস্বীকৃত প্রচলিত ধারার কোনো পেশা গ্রহণ করুক। তালহা ব্যাপারটায় অরাজি ছিলেন তা নয় তবে মাছও ছাড়তে চাইছিলেন না।
দুঃখ পেয়েছিলেন, জেদও তৈরি হয়েছিল
একদিন মা আর সইতে না পেরে ৭০টি ট্যাংক ভেঙে ফেলেন। এতে তালহা খুব দুঃখ পান। সেসঙ্গে তার জেদও চেপে যায়। তখন তিনি ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোডে অবস্থিত একাডেমিয়ায় পড়ছিলেন। সে এলাকাতেই তিনি একটি বাড়িতে 'টু-লেট' ঝোলানো দেখতে পেলেন। তারপর একজন সহকারীকে নিয়ে গেলেন বাড়ি দেখতে। তিনি হিসাব করে দেখলেন, প্রয়োজনীয় সময় দিলে যতটুকু জায়গা পাচ্ছেন সেখানে ৪০ হাজার টাকা মূল্যমানের বাচ্চা ফোটানো সম্ভব। বাবার কাছ থেকে তিনি ২ লাখ টাকা নিলেন আর আরলা ফুডসের পরিচালকদের একজন তাকে ১ লাখ টাকা দিল। আরলা ফুডসের ওই পরিচালকের সঙ্গে তার চেনাজানা হয়েছিল আগেই। তারা পরস্পর ভাবনা বিনিময় করতেন। পরিচালক তাকে মেরিন ফিশে অভিজ্ঞ হওয়ার পরামর্শ দিতেন এবং নিজের বাড়িতে একটি ট্যাংক বসানোর কথা ভাবছিলেন। তিনি তালহাকে নিজের ট্যাংকটি গড়ে তোলার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তালহা বলছিলেন, 'যে কাজে আনন্দ পান সেটা করাই ভালো। আমি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে চিনি, যিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন, তিনি ফ্রিল্যান্সিং করে যত টাকা আয় করেন তার প্রায় সবটাই বিনিয়োগ করেন তার ফিশ ট্যাংকের দোকানে। ভালোবেসে করলে সে কাজে সাফল্যও ধরা দেয়।'
১৫ হাজার টাকা নিয়ে কাঁটাবন
সবমিলিয়ে ৩ লাখ টাকা পাওয়ার পর তালহা ২ লাখ টাকা বাসা ভাড়ার অ্যাডভান্স দিলেন। বাকি ১ লাখ টাকার মধ্যে ৮৫ হাজার টাকা গেল সাজসজ্জায়। শেষ ১৫ হাজার টাকা নিয়ে তিনি কাঁটাবন গেলেন। সেখানকার পরিচিত মিঠু ভাই তাকে ত্রিশ হাজার টাকার মাছ দিলেন। সে থেকে সম্পূর্ণ নিজের মতো পথচলা শুরু হলো তালহার। ২০০৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন 'ফিশকিপারসবিডি'।
এরমধ্যে আরলা ফুডসের পরিচালকের বাড়িতে ট্যাংক বানানোর কাজও এগিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু তখন সবকিছু সিঙ্গাপুর থেকে হাতে করে নিয়ে আসতে হতো বলে অল্প অল্প করে মাছ, প্রবাল, খাবার ইত্যাদি আনতে হতো। পুরো অ্যাকুরিয়ামটি সম্পূর্ণ করতে দুই বছর লেগে গিয়েছিল।
তালহা মেরিন ফিশ, স্যান্ড, প্ল্যান্ট, রক, কোরাল সম্পর্কে জেনেছেন 'অ্যাকুয়ারিয়াম হবিয়িস্টস বাংলাদেশ' গ্রুপের মাধ্যমে। এ গ্রুপ থেকে প্রচুর পরামর্শ তিনি পেয়েছেন। ভারতের কিছু বন্ধুও তাকে সাহায্য করেছেন। মেরিন ট্যাংক গড়া ও যত্ন নিতে পড়াশোনা যেমন লাগে আবার অভিজ্ঞও হতে হয়। তালহা বলছিলেন, 'মেরিন ট্যাংকের পানির দিকে খেয়াল রাখাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ট্যাংকের সঙ্গে পানি পরিশোধন ব্যবস্থা থাকে, সেসঙ্গে সপ্তাহে ১০-২০ ভাগ পানি পরিবর্তনও জরুরী। ট্যাংকে ওয়েভ মেকার (ঢেউ তৈরিকারক) লাগানোরও প্রয়োজন পড়ে। তারপরই আসে আলো বা লাইটের বিষয়টি। মনে রাখা দরকার যে সমুদ্র একটা বিশাল ব্যাপার সেটাকে আপনি রেপ্লিকেট (ক্ষুদ্র সংস্করণ) করছেন। তাই তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, ক্ষারত্ব ইত্যাদি রক্ষা ও ধারাবাহিক করার ব্যাপারে দক্ষতা লাগবে। দোকান থেকে একটি ট্যাংক ও মাছ কিনে নিয়ে গেলেই হবে না যদি না আপনার এর প্রতি ভালোবাসা না থাকে। একবারের ঘটনা বলি, একটা গ্রুপ অব কোম্পানিজের মালিক আমাকে একটি ট্যাংক বানানোর দায়িত্ব দিল। তারা নামী এক ব্র্যান্ডের ১৩০০ লিটার পানিও সরবরাহ করল। কিন্তু সে পানির কারণেই ৩ লক্ষ টাকার মাছ মারা গিয়েছিল। কারণ ওই পানির কার্বনেট কঠোরতা বা কেএইচ ছিল আদর্শমানের তুলনায় অনেক বেশি। এছাড়া পানির তাপমাত্রা ধারাবাহিক না থাকলেও মাছের কষ্ট হয়। দোকানে মাছ ছিল ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, আপনি নিয়ে গিয়ে রাখলেন ২৭ ডিগ্রিতে। এটা বেশি সময় ধরে ঘটলে মাছের গায়ে সাদা ফুটকি দেখা দিবে, মাছ খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিবে এবং একটা পর্যায়ে মাছ মারা যাবে।'
মেরিন ট্যাংক পূর্ণ করা যায় সাধারণ কলের পানি দিয়েও কিন্তু পরে যে লবণ মেশাতে হয় তার অনুপাত জানা থাকা দরকার। ট্যাংকের উপযুক্ত লবণ আনতে হয় বিদেশ থেকে আর এটা সাধারণ খাবার লবণ থেকে আলাদা। বাংলাদেশে লবণ আমদানির অনুমতি আছে কেবল গার্মেন্টস সেক্টরে আর ওষুধ শিল্পে। সরকারি নিয়ম-নীতি নেই প্রবালের ক্ষেত্রেও। ট্যাংকে রাখা প্রবালগুলো জীবন্ত হয়। এদের জন্যও ক্যানড ফুড পাওয়া যায়। আলো হলো মেরিন ট্যাংকের মেরুদণ্ড। তালহা তার শপে এলইডি লাইট দিয়ে নীল আবহ তৈরি করেছেন। কিছু মাছ আলোক স্তম্ভ থেকে নিজের খাবার নিজেই তৈরি করে নেয়, অনেকটা গাছের মতো ব্যাপার। সব মাছ আবার একসঙ্গে একই ট্যাংকে রাখা যায় না কারণ কিছু আছে শিকারী মাছ, কিছু শান্ত আর চুপচাপ। তালহা বললেন, 'সেল্ফ কন্ট্রোলিং হলো মেরিন ট্যাংক রক্ষা করার পূর্বশর্ত। ৪ ফুটের একটা ট্যাংকে কতগুলো মাছ ধরবে তার যেমন ধারণা থাকা দরকার, কত রকমের থাকবে তার ব্যাপারেও সতর্কতা রক্ষা জরুরী। এগুলো সবই অর্নামেন্টাল ফিশ। মাছভেদে রং আলাদা হয়, পাখনায়ও থাকে বৈচিত্র্য, গড়নে তো আলাদা বটেই। তাই মেরিন ট্যাংক মানে একটা রঙিন দুনিয়া। তাই বলে যত ইচ্ছে মাছ একসঙ্গে এক ট্যাংকে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।'
অস্থায়ী কর্মীও নিয়োগ দিতে হয়
মেরিন ট্যাংকের ফিশ ও কোরাল উভয়ই বেশি আমদানি করা হয় ইন্দোনেশিয়া থেকে। কিছু করা হয় সিঙ্গাপুর থেকে। তালহা আইনি বিধি মেনেই মাছ, প্রবাল, খাবার, ট্যাংক আমদানি করে থাকেন। তবে এ ব্যাপারে সরকারি নিয়ম-কানুনের ঘাটতি রয়েছে।
তালহার এখন চারটি দোকান। স্থায়ী কর্মী সংখ্যা ৪ জন। বেশি কাজের চাপ তৈরি হলে অস্থায়ী ভিত্তিতে আরো কর্মী যোগাড় করেন। সাধারণত শিক্ষার্থীদের এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেন। দিনে তাদের সম্মানী হয়ে থাকে ৫০০ টাকা। দোকানভাড়া, বেতন দিয়ে তালহার মাসিক খরচ দেড় লাখ টাকার মতো। তালহার এখন প্রধান আয় সার্ভিস দিয়ে। তিনি কাই অ্যালুমিনিয়ামের অফিস, আরলা ফুডসের পরিচালকের বাসা ইত্যাদি বড় বড় প্রতিষ্ঠানে মাসভিত্তিতে সেবা দিয়ে থাকেন।
তালহা শেরে বাংলা নগর মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে ছয় ফুটের ট্যাংক গড়ে দিয়েছেন। এটি ইনসেপটা ফার্মাসিউক্যালসের পক্ষ থেকে উপহার দেওয়া হয়েছে হাসপাতালকে। কক্সবাজারেও একটি সমুদ্র বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ৪টি ট্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন।
তালহা শেষে বললেন, 'এটা একটা সম্ভাবনাময় খাত। সরকার এ খাতের জন্য উপযুক্ত নীতি গ্রহণ করলে এতে কর্মসংস্থানের ভালো সুযোগ তৈরি হবে। বাড়িতে একটি সমুদ্র তৈরির সামর্থ্যবান লোকের সংখ্যা দিনদিনই বাড়ছে দেশে। তারা ঘরে বা অফিসে ট্যাংক বসাতে আগ্রহীও হচ্ছেন, কিন্তু নীতিমালা সুষ্ঠু না হওয়ায় ভরসা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।'