বহুল কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন: চাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বড় বিনিয়োগ
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)-এর মানব উন্নয়ন সূচকে নিম্ন থেকে উচ্চ স্তরে উঠতে বাংলাদেশের প্রায় ২০ বছর লেগেছে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণকারী বাংলাদেশকে উচ্চ মানব উন্নয়ন সূচকের নিচের দিকে থাকা ভিয়েতনামের পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য মানব উন্নয়নে আরও বেশি সাফল্য অর্জন করতে হবে। আর অতি উচ্চ মানব উন্নয়ন সূচকের সর্বশেষ ক্রমে থাকা থাইল্যান্ডের সমকক্ষ হতে হলে আরও বেশি অর্জন দরকার বাংলাদেশের।
এ কাজটা সহজ হবে না। সবার আগে, সার্বিক মানবপুঁজি সূচক উন্নয়নের প্রভাবক মোট জাতীয় আয়ের (জিএনআই) উদাহরণ বিবেচনা করা যাক। যেমনটা দেখা যায়, যেসব দেশের জিএনআই বেশি, সেগুলোই মানব উন্নয়ন সূচকের শীর্ষে অবস্থান করে। এর কারণ সার্বিক মানব উন্নয়নের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগের প্রয়োজন, এবং ধনী দেশগুলোই সেটা করতে পারে। আর এ বিনিয়োগ তাদের সম্পদকে আরও বর্ধিত করে।
ইউএনডিপি'র মানব উন্নয়ন সূচক ২০২১-এ মধ্যম ও উচ্চ মানের সর্বনিম্ন দেশ হচ্ছে যথাক্রমে ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড। ভিয়েতনামের মাথাপিছু জিএনআই ৭,৮৬৭ ডলার, আর থাইল্যান্ডের ১৭,০৩০ ডলার। ক্রয় সক্ষমতার সমতায় বাংলাদেশের জিএনআই বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫,৪৭২ ডলারে।
অর্থাৎ মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের প্রচুর অর্থ প্রয়োজন। আর এ বিনিয়োগ উৎপাদন খাতে প্রয়োজনীয় মানবদক্ষতা সরবরাহকে নিশ্চিত করবে — ফলে বাড়বে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি।
ইউএনডিপি'র মানব উন্নয়ন সূচক ২০২২-এ ১৯১টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে ১২৯ তম হয়ে বাংলাদেশ মধ্যবর্তী স্তরে অবস্থান করছে। অর্থাৎ বিশ্বের ১২৮টি দেশের উন্নততর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মাথাপিছু আয়সহ মানব পুঁজিতে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি গড় মান রয়েছে। এ দেশগুলোর মধ্যে ভুটানও আছে। তবে বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানকে মানব উন্নয়ন সূচকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে গত কয়েক দশকে এক্ষেত্রে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে।
মেয়েদের জন্য বিনা বেতনে পড়ালেখা, ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা, বিনামূল্যে বই — বাংলাদেশের এ ধরনের উদ্ভাবনী প্রকল্পের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে, কমেছে ঝরে পড়ার হারও। এছাড়া তৃণমূল পর্যায় থেকে স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও নেটওয়ার্ক নির্মাণ, সরকারি হাসপাতালগুলোতে সম্ভাব্য সর্বনিম্ন খরচে স্বল্প পরিসরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, দেশজুড়ে টিকাদান কর্মসূচি, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশন সুবিধাকে আরও সহজলভ্য করা — এ সবকিছুই সার্বিক মানব উন্নয়ন স্কোরকে উন্নত করতে অবদান রেখেছে।
কিন্তু সামনের যাত্রাটা আরও কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে। কারণ, এবার বাংলাদেশকে মান নিয়ে ভাবতে হবে। মানের ক্ষেত্রে আমরা এখনো নিম্নস্তরেই রয়েছি। করোনাভাইরাস মহামারি আমাদের জনস্বাস্থ্য সেবা খাতের দুর্বলতাগুলোকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। মহামারির সময় বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ বিদ্যালয় বন্ধ হয়েছিল, এর ফলে নেমে গেছে শিক্ষার মানও। অন্যদিকে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে যথাসম্ভব তাদের স্কুলগুলো খোলা রাখার চেষ্টা করেছিল। অর্থনীতিকে সচল এবং সাধারণ মানুষের আয়ের উপায়কে চালু রাখতে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল শিল্পকারখানাগুলো খোলা রাখতে। কিন্তু অন্যদিকে উন্নত দেশগুলোতে শ্রেণিকক্ষে বা অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার বিষয়েই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হয়।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ও সম্পদের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে এ ধরনের কাজগুলোই তাদের কর্মপদ্ধতি ও প্রাধান্যগুলোর মধ্যে পার্থক্য গড়ে দেয়।
ফেলনা নয় মান
কোভিড-১৯ মহামারির পর থেকেই বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকা এবং পাবলিক পরীক্ষায় বেশি উদারতা দেখিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করার কারণে দেশের শিক্ষার মান আরও হ্রাস পেয়েছে। তারা বলছেন, এমনিতেই শিক্ষার মান আগে থেকেই নিম্ন, তার ওপর নতুন করে এই পতনের ফল ভোগ করবে পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম।
মানের এই একই প্রশ্ন স্বাস্থ্য খাত নিয়েও উঠেছে। চিকিৎসক-রোগীর নিম্ন অনুপাত, রোগী ও নার্স-টেকনিশিয়ানদের আরও স্বল্প অনুপাত, উচ্চ খরচে ভরসাহীন চিকিৎসাসেবা — এ সব মিলিয়ে রোগীদের নিজের পকেট থেকে ব্যয় বেড়ে আকাশছোঁয়া হচ্ছে। এর ফলে অনেক পরিবার দারিদ্র্যের মুখে পড়েছেন।
প্রতি অর্থবছরে বাজেটের আগে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি বরাদ্দের দাবিতে সোচ্চার হন অনেকে। কিন্তু তাদের দাবি খুব একটা শোনা হয় না। বার্ষিক বরাদ্দ বাড়লেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাতে অন্যতম কম বরাদ্দ।
সরকার নিজেও স্বীকার করে, দেশের শিক্ষার মান ক্রমশ পতনমুখী। এ কারণে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার ২০১৯ সালের বাজেট বক্তৃতায় ঘোষণা করেন, দরকার হলে শিক্ষার মানোন্নয়নে সহায়তার জন্য বিদেশ থেকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হবে। কোভিডের পর শিক্ষার মান আরও কমলেও এখন পর্যন্ত বাইরে থেকে শিক্ষক আনার কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
সম্প্রতি জাতিসংঘের একটি রেজল্যুশনে বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল একটি উদ্ভাবনী কমিউনিটিভিত্তিক জনস্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৯৮ সাল থেকে এ ধরনের প্রায় ১৪,০০০ ক্লিনিক সারা দেশের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। কিন্তু আরও ভালো সেবা দেওয়ার জন্য এ ক্লিনিকগুলোকে উন্নত সরঞ্জাম দিয়ে সমৃদ্ধ করতে হবে।
অসংক্রামক ব্যাধির চিকিৎসাখরচের ভার কমাতে সর্বজনীন স্বাস্থ্য বিমা চালুর ক্ষেত্রেও দেশ এখনো বিশেষ অগ্রসর হতে পারেনি।
আসন্ন বাজেট এমন এক সময়ে প্রস্তুত করা হচ্ছে যখন বাংলাদেশের অর্থনীতি কয়েক দশকের মধ্যে নজিরবিহীন চাপের মুখে রয়েছে। কিন্তু গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বাজেটও অন্য সব বাজেটের মতোই — মহামারি ও যুদ্ধের দ্বৈত ধাক্কার মুখে থাকা অর্থনীতিতে আমূল গুণগত পরিবর্তন আনতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বদলের জন্য কোনোপ্রকার ব্যবস্থার রূপরেখা রাখা হয়নি আগামী বাজেটে।
দেশের নিম্ন ও নিম্নমধ্য শ্রেণির একটি বড় অংশের জীবনমানকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, যা দেশের অতীত মানব উন্নয়নের ধারাকেও বিপরীতমুখী করে দিতে পারে।
ক্রমহ্রাসমান দক্ষতা
মানব উন্নয়ন বাড়াতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি বিনিয়োগের কোনো বিকল্প নেই বাংলাদেশের। অবকাঠামো ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে, এখন দুই খাতেই মানসম্মত সেবা নিশ্চিতের জন্য দক্ষ মানবসম্পদের প্রয়োজন — কারণ অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সবসময় কর্মশক্তির সাফল্যের ওপর নির্ভর করে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দ্রুতহারে এগিয়ে যাওয়ার অনেকগুলো উদাহরণ আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে।
মানব উন্নয়ন স্কোরে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে। তবে দেশটি মানব পুঁজিকে শক্তিশালী করতে বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ জন্য ভারত সরকার আয়ুষ্মান ভারত যোজনা, জাতীয় শিক্ষানীতি, আত্মনির্ভর ভারত যোজনা, সমগ্র শিক্ষা, আরবান লার্নিং ইন্টার্নশিপ ইত্যাদি প্রকল্প ঘোষণা করেছে।
মানবসম্পদ উন্নয়নে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের নিজস্ব প্রোগ্রাম রয়েছে। তারা এগুলোকে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচনা করে। দেশটির বেসরকারি খাতও এ যাত্রায় সামিল হয়েছে। তারা কর্মীদের প্রণোদনা দিচ্ছে নতুন করে কাজ শেখা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য যাতে এ কর্মীরা নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে পারেন ও তাদের কাজ থেকে ঝরে পড়ে না যান।
এর পাশাপাশি ভারতের ২৬টি রাজ্য এখন দক্ষ কর্মশক্তি তৈরি এবং নতুন কর্মসংস্থানের জন্য বিলিয়ন ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যবসার নিয়মকানুন শিথিল করতে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
পিয়ার্সন স্কিলস আউটলুক-এর সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ ভারতীয় কর্মী বলছেন তাদের নিয়োগকর্তারা দক্ষতাকে সুবিধা হিসেবে অফার করছেন। নিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে কর্মীদের জন্য যেসব দক্ষতার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সেগুলো হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, ডেটা প্রসেসিং, ও কোডিং।
ওই জরিপে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমস্যা সমাধানের মতো সফট দক্ষতাগুলো বর্তমানে ভারতে ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
বাংলাদেশেও একটি জরিপে সমধর্মী তথ্যের দেখা মিলেছে।
২০২১ সালে একটি জার্মান সংস্থার সঙ্গে সিপিড'র (সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ) যৌথভাবে পরিচালনা করা এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে একজন কর্মীর কাছ থেকে নিয়োগকারীরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব দক্ষতা দেখতে চান, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে যোগাযোগ দক্ষতা (৬১%), সমস্যা সমাধানের দক্ষতা (৪৬%), এবং দলগত কাজ ও নেতৃত্বের দক্ষতা (৩৭%)।
৪০ শতাংশ নিয়োগেকারী জানিয়েছেন, প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে তাদের কর্মীদের নতুন দক্ষতার দরকার হতে পারে।
জরিপে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় ৪৬ শতাংশ বেসরকারি নিয়োগকারী প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর্মী পান না, কারণ বেশিরভাগ আবেদনকারীর প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলো থাকে না।
ওই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, কর্মী নিয়োগের সময় নিয়োগকারীরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি প্রভাবককে বিবেচনায় রাখেন। এগুলো হচ্ছে সফট স্কিল (৮৩ শতাংশ নিয়োগকারী), হার্ড স্কিল (৬৫%), ও কাজের অভিজ্ঞতা (৫১%)।
নিয়োগকারীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সফট স্কিলগুলোর মধ্যে রয়েছে যোগাযোগ, সময় ব্যবস্থাপনা, সমস্যা সমাধান, টিমওয়ার্ক ও নেতৃত্ব, ক্রিটিক্যাল চিন্তা, পেশাদার নেটওয়ার্কিং, ও সৃজনশীলতা।
আর তাদের মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হার্ড স্কিল হচ্ছে কম্পিউটার দক্ষতা, টেকনিক্যাল দক্ষতা, পঠিত বিষয়ে জ্ঞান, ইংরেজি ভাষাদক্ষতা, অপারেশনাল দক্ষতা, ব্যবসায়িক দক্ষতা, সাংখ্যিক ও গাণিতিক দক্ষতা, সাধারণ জ্ঞান, এবং সাম্প্রতিক বিষয়াবলি নিয়ে ধারণা।
'শিল্পকারখানাগুলোতে মধ্যম সারির দক্ষ ব্যবস্থাপনা নেই,' আরও বেশি হার্ড স্কিলের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতে গিয়ে বলেন অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর।
'মার্কেটের চাহিদা ও গ্র্যাজুয়েটদের সরবরাহের মধ্যে একটা শূন্যস্থান রয়েছে,' জরিপ-গবেষণাটির ফলাফল প্রকাশের সময় মন্তব্য করেছিলেন সিপিডি'র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন।
বেসরকারি খাতে দরকারি নতুন দক্ষতা তৈরির জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন, 'সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিচালনায় এক কোটি ১৩ লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য রাখা হয়েছে। কিন্তু এ চাকরিগুলো পাওয়ার জন্য আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা কি প্রস্তুত?'
আর এখানেই আসে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগের প্রসঙ্গ। কারণ দক্ষতা প্রশিক্ষণের জন্য গতানুগতিক শিক্ষাদানের তুলনায় বেশি বিনিয়োগ প্রয়োজন। সাধারণ শিক্ষাপদ্ধতিতে নিজেদের প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মীর চাহিদা মেটাতে বেসরকারি খাতকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে অংশীদারিত্বে যেতে হয়।
'আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও অর্থনীতির মধ্যে একটি সংযোগ তৈরির দরকার,' বলেন নাসিম মঞ্জুর।
ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন নেতা ব্যারিস্টার নিহাদ কবির বলেন, 'আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটি আছে। এখানে শিক্ষার্থীরা খাতভিত্তিক শিক্ষা পায় না এবং সবাই সরকারি চাকরি পেতে চায়।'
বিডিজবস ডটকম-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ. কে. এম. ফাহিম মাশরুরও একই কথা বললেন। তার মতে, জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ ঘোষণার পর থেকেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরি পাওয়ার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহী।
'তাই স্নাতকোত্তর বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই বেসরকারি খাতের বদলে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেন,' তিনি বলেন।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমস্যা সমাধানের মতো মানব সক্ষমতাগুলো বৈশ্বিকভাবেও শীর্ষস্থানীয় প্রয়োজনীয় প্রতিভা হিসেবে দেখা হয়।
আর এ অনুযায়ীই পদক্ষেপ নিচ্ছে বিশ্বের দেশগুলো।
সিঙ্গাপুরের রহস্য
ছোট্ট একটা জেলে গ্রাম থেকে সিঙ্গাপুরের আধুনিক ও সমৃদ্ধ নগর-রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার গল্পটি অবিশ্বাস্য। ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর সিঙ্গাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ানের টিকে থাকা নিয়েই প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। কুয়ান 'অপরিচিত পথে অজানা গন্তব্যের এক যাত্রা' শুরু করেছিলেন।
ছোট্ট এ রাষ্ট্রটির কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। তাই লি কুয়ান শিক্ষার উন্নয়নকে কেন্দ্রে রেখে 'শ্রেষ্ঠ ও সম্ভাবনাপূর্ণদের' গড়ে তোলার নীতি গ্রহণ করেন।
দক্ষতা উন্নয়নে ও তুলনামূলকভাবে ভালো বেতনের মাধ্যমে দেশের 'শ্রেষ্ঠ ও মেধাবীদেরকে' আমলাতন্ত্রে আনতে সিঙ্গাপুর শিক্ষা খাতে বিপুল বিনিয়োগ করে। গত ৫৭ বছরে শিক্ষায় এ বড় বিনিয়োগ ও প্রশিক্ষণের সুফল এখন পাচ্ছে দেশটি; বর্তমানে গণিত, পঠন, ও বিজ্ঞানে বৈশ্বিকভাবে সবচেয়ে বেশি স্কোর অর্জনকারীদের তালিকায় রয়েছে সিঙ্গাপুরের শিক্ষার্থীরা।
সিঙ্গাপুরের সাফল্যের দ্বিতীয় রহস্য হলো এর কার্যকরী জন-আমলাতন্ত্র। বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞানুযায়ী ফলপ্রসূ গভর্নেন্স ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। এ গভর্নেন্সের জন্য প্রয়োজন মানসম্মত আমলাতন্ত্র ও জনসেবা, দক্ষ সরকারি কর্মকর্তা, এবং রাজনৈতিক চাপমুক্ত সিভিল সার্ভিস।
দুর্নীতিমুক্ত দেশের নীতি সিঙ্গাপুর নিষ্ঠার সঙ্গে অনুশীলন করে। অন্য দেশের অভিজ্ঞতাকে গ্রহণ করে নিজেদের সমস্যা সমাধানে সে অভিজ্ঞতা ব্যবহারেও দেশটির আপত্তি নেই। বড় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো থেকে প্রযুক্তি স্থানান্তরের মাধ্যমে এভাবেই সিঙ্গাপুর আমলাতন্ত্রের উন্নয়ন এবং মানব দক্ষতার বিকাশ ঘটিয়েছে।
সিঙ্গাপুরের মতো আরেক এশিয়ান বাঘ দক্ষিণ কোরিয়াও পশ্চিমাবিশ্বের অনেক অগ্রসর অর্থনীতির চেয়ে দ্রুতবেগে ধনী হতে একই গোপন ফর্মুলা অনুসরণ করেছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বড় বিনিয়োগের পাশাপাশি অন্যান্য অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রয়োগের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া কোরিয়ান যুদ্ধের বিধ্বস্ত দেশ থেকে এশিয়ার মিরাকলে রূপান্তরিত হয়েছে।
সিঙ্গাপুরের আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত জাপানও ধনী হওয়ার জন্য মানবপুঁজিতে বিনিয়োগের এই একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল।
সবার জন্য '১৯৬০ সালে আয় দ্বিগুণকরণ পরিকল্পনার' কারণে জাপানের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য হারে এগিয়ে যায়। এই পরিকল্পনা সামাজিক কল্যাণ, কারিগরি প্রশিক্ষণ, ও শিক্ষা খাতে জাপান সরকারের দায়িত্বকে পুনর্ব্যক্ত করে।
বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে ফিনল্যান্ডের। দেশটিতে শিক্ষকরা সর্বোচ্চ সম্মানিত, আর তাদের শ্রমের আর্থিক মূল্যও সবচেয়ে বেশি। ফলে সবচেয়ে প্রতিভাবান মানুষেরাই সেখানে শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত হন। বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন নিম্ন — এ কারণেই মেধাবীরা এখানে শিক্ষক হতে চান না, বিশেষ করে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে।
ফলে শিক্ষার্থীরা উচ্চ মানের শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যার কারণেই শিক্ষার সার্বিক মান নিম্নমুখী অবস্থানে রয়েছে।
শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি, পরবর্তী ধাপের উন্নয়নের দিকে দেশকে এগিয়ে নিতে সরকারি ও বেসরকারি খাতের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে শিক্ষকদের প্রতি মনোভাবকে জাতীয় পর্যায়ে বদল আনতে হবে।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশে ০.৩৯৭ গড় মান নিয়ে মানব উন্নয়ন সূচকে নিম্ন সারিতে ছিল। ২০১০ সালে মধ্যম সারিতে পৌঁছায় এটি। ধীর তবে ধারাবাহিক অর্জনের মাধ্যমে ২০২১ সালে বাংলাদেশের গড় মান বেড়ে ০.৬৬১ হয়।
গত তিন দশক ধরে গড়ে প্রতি বছর ০.০০৮৯ পয়েন্ট বৃদ্ধির প্রবণতা অনুযায়ী, ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডের পর্যায়ে পৌঁছাতে বাংলাদেশের যথাক্রমে পাঁচ ও ১৫ বছর লাগবে। এ সূচকে বাংলাদেশ উচ্চ ও অতি উচ্চ মানের স্তরে পৌঁছাতে পৌঁছাতে এ দুই দেশ আরও ঊর্ধ্বে উঠে যাবে এবং একই সময়ে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো গড় মান অর্জনের সম্ভাবনা থাকবে অন্য অনেক দেশেরও।
বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে চায়। এ অগ্রসর অর্থনীতির পাবলিক সার্ভিস ও পাবলিক খাতের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় যোগ্য মানবসম্পদ বিকাশে বাংলাদেশকে এর প্রচেষ্টা অনেক বেশি বাড়িয়ে তুলতে হবে।
সময় ক্রমশ বয়ে যাচ্ছে। অল্প-দক্ষ জনশক্তির কারণে বাংলাদেশ এর বর্তমান ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড থেকে যথেষ্ট সুফল লাভ করতে পারছে না। অভিবাসী কর্মীদের উদাহরণের কথা বিবেচনা করা যাক। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বেশিরভাগ শ্রমিক দক্ষতার অভাবে বিভিন্ন দেশে ছোটখাটো কাজ করেন। ফলে অন্য দেশের দক্ষ কর্মীর তুলনায় বাংলাদেশিরা কম আয় করেন। নিম্ন উর্বরতা ও মৃত্যুহারের কারণে বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড আগামী ২০৪৫ সালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু বাংলাদেশ এই বিরল সুযোগ হেলায় হারাচ্ছে। আগামী দুই দশক পরে দেশে বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়বে। ফলে অর্থনীতির ওপর তৈরি হবে বাড়তি চাপ।