চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতা: গন্ডগোলটা কোথায়?
গত দুই দশক ধরে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের জন্য জলাবদ্ধতা ও অবর্ণনীয় দুর্ভোগ নিয়ে আসছে বর্ষা। অল্প বৃষ্টিতেই শহরের বেশ কিছু সড়ক ও নিচু এলাকাসমূহ হাঁটু থেকে কোমর পর্যন্ত পানির নিচে চলে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা), পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), বাংলাদেশ রেলওয়ে, এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ — এ ছয়টি রাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রত্যেকটির নিজস্ব মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে। আর এসব সংস্থা নিজেদের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছাড়াই স্বাধীনভাবে কাজ করে।
এ সমন্বয়ের অভাবকেই বন্দরনগরীর চিরস্থায়ী জলাবদ্ধতা সংকটের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
চসিক, সিডিএ, ওয়াসা, ও পাউবো জলাবদ্ধতা নিরসন সম্পর্কিত পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। গত ১০ বছরে নগরীতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের পেছনে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে চারটি প্রকল্পে মোট ১৪ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু জলাবদ্ধতার সমস্যা বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে এবং কিছুক্ষেত্রে পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হয়েছে।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ রাশিদুল হাসানের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করেছে। প্রকল্পগুলোর কোথায় গন্ডগোল হয়েছে এবং কেন শহরে জলাবদ্ধতার সমাধান হচ্ছে না সে বিষয়ে কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছেন এ বিশেষজ্ঞ।
ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা অমান্য করে প্রকল্প
১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে শহরের প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টার্শিয়ারি ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে সুনির্দিষ্ট করে। পরিকল্পনায় বর্ধিষ্ণু শহরের পানি নিষ্কাশনের জন্য চারটি নতুন খাল খননের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে একটি খালের নির্মাণকাজ ২০১৪ সালে শুরু হলেও এখনও শেষ হয়নি। ২০১৮ সালে শুরু হওয়া মহাপরিকল্পনা অমান্য করে গৃহীত মেগা প্রকল্পগুলোয় প্রধানত শহরের প্রাথমিক ড্রেনসমূহের (খাল) ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেকেন্ডারি এবং টার্শিয়ারি ড্রেনগুলো সেই আগের মতোই পুরোনো এবং জরাজীর্ণ রয়ে গেছে। ফলে বৃষ্টির পানি সরু ও জরাজীর্ণ অভ্যন্তরীণ ড্রেনের মাধ্যমে প্রাথমিক খালে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে।
তড়িঘড়ি করে নেওয়া প্রকল্প
সরকার অগ্রাধিকারভিত্তিতে জলাবদ্ধতা নিরসন করতে বলার পর সিডিএ সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই তড়িঘড়ি করে প্রকল্প হাতে নেয়। এমনকি এটি চসিক, ওয়াসার মতো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো এবং সুশীল সমাজের নেতাদের সঙ্গেও কোনো আলোচনা করেনি। ফলে সমস্যা সমাধানে প্রকল্পগুলো কার্যকর হতে পারেনি।
পলিফাঁদ ছাড়া খাল
চট্টগ্রাম একটি পাহাড়ি শহর। প্রতিদিনই অসাধু লোকজন এখানে পাহাড় কাটছে। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের বালুকাময় মাটি ভেসে গিয়ে খালে পড়ে। এভাবে খালসমূহ ভরাট হয়ে পানি প্রবাহে বাধা তৈরি হয়, যা শহরে জলাবদ্ধতার আরেকটি কারণ। সিডিএ প্রকল্পের একটি বড় দুর্বলতা হলো এখানে পলিফাঁদ নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
রাস্তার উচ্চতা বাড়ানো
সাম্প্রতিক সময়ে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সংস্কারের মাধ্যমে অনেক রাস্তার উচ্চতা বাড়ানো হয়েছে। ফলে রাস্তার দুই পাশের বাড়িঘর ও দোকানপাট রাস্তার সমান্তরালে না থেকে নিচে অবস্থান করছে। বৃষ্টি হলে পানি নিচু এলাকায় চলে গিয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে।
ভরাট হয়ে গেছে ৭০ শতাংশ জলাশয়
একসময় চট্টগ্রাম শহরে পুকুরের মতো প্রচুর জলাশয় ছিল যেগুলো বৃষ্টির পানি ধরে রাখত। বিগত ৪০ বছরে ভবন নির্মাণের জন্য প্রায় ৭০ শতাংশ জলাশয় ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এর ফলে বৃষ্টির পানি জমার জায়গার অভাবে জলাবদ্ধতা বেড়েছে।
আবাসন প্রকল্পের জন্য খোলা জায়গার ব্যবহার
মেগাসিটি চট্টগ্রাম ৭০ লাখেরও বেশি মানুষের বাস। এ ধরনের বড় শহরে বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে এবং তারপর ভূগর্ভে পুনরায় পানির সংস্থান করতে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ খোলা জায়গা থাকা দরকার। কিন্তু শহরের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য সিডিএ আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে প্রায় সমস্ত খোলা জায়গা ব্যবহার করে ফেলেছে। যেমন আগে চান্দগাঁও এবং বহদ্দারহাট থেকে বৃষ্টির পানি নিচু এলাকায় প্রবাহিত হতো। কিন্তু সেখানে সিডিএ অনন্যা আবাসিক নামক একটি আবাসন প্রকল্প ঠিক করেছে। আবাসন প্রকল্পটি গড়ে উঠতে শুরু করার পর থেকে এলাকাটি এখন সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতার শিকার। কল্পলোক আবাসিক এলাকা নির্মাণের পর বাকালিয়া এলাকাও একই পরিণতির শিকার হয়েছে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি ও নিষ্ক্রিয় স্লুইস-গেট
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির হাত থেকে শহরকে রক্ষার জন্য সিডিএ কর্তৃক বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলোতে ৪১টি স্লুইস-গেটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এসব স্লুইস-গেট নির্মাণের কাজ এখনও শেষ না হওয়ায় বৃষ্টির পানি সময়মতো পাম্প করে বের করা যাচ্ছে না। এটি জলাবদ্ধতা সংকটকে বাড়ানোর আরেকটি কারণ। সরকার জলাশয় রক্ষায় আইন প্রণয়ন করলেও নগরীর সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক জলাশয়গুলো বিলীন হওয়ার পেছনে সরকারি সংস্থাগুলোর অনীহা দায়ী।
দুর্বল বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা
চট্টগ্রাম নগরীতে প্রতিদিন তিন হাজার টন কঠিন বর্জ্য তৈরি হয়। চসিক-এর তথ্য অনুযায়ী, এটি দৈনিকভিত্তিতে মাত্র দুই হাজার টন বর্জ্য অপসারণ করতে পারে। বাকি এক হাজার টন বর্জ্য ড্রেন ও খালে ফেলা হয়, যা জলাবদ্ধতার আরেকটি কারণ।