ধসে পড়েছে পঞ্জি ট্রেডিং অ্যাপ ‘এমটিএফই’, সর্বস্ব খোয়ানোর পথে হাজারো গ্রাহক
আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজারে ট্রেডিংয়ের সুযোগের নামে পরিচালিত অনলাইন পঞ্জি স্কিমের অ্যাপ এমটিএফই ধসে পড়েছে। এতে দেশজুড়ে কয়েক হাজার মানুষ সর্বস্ব খুইয়েছেন।
সমস্যা শুরু হয়েছিল দুই সপ্তাহ আগে তথাকথিত সিস্টেম আপগ্রেডের মাধ্যমে। এরপর থেকে ব্যবহারকারীরা অ্যাপটি থেকে কোনো টাকা তুলতে পারছিলেন না। বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) রাতে প্রায় সব ব্যবহারকারীর ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক দেখানো শুরু করে অ্যাপটি। গ্রাহকদের পক্ষে স্বয়ংক্রিয় লেনদেনের পর বিপুল লোকসান হয়েছে বলে দাবি করেছে অনিয়ন্ত্রিত এ সংস্থাটি।
ঢাকার প্রতারিত এমটিএফই ব্যবহারকারী মইনুল ইসলাম বলেন, 'আমি এখন নিশ্চিত, এমটিএফইর দেখানো বিনিয়োগের লাভ-লোকসানের তথ্য পুরোটাই ভুয়া ছিল। আদতে এর ভার্চুয়াল ট্রেডিং আমাদের অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে তৈরি করা নকল ব্যবস্থা ছিল।'
মইনুল আরও বলেন, কয়েকজন বন্ধুকে এই ভুয়া প্ল্যাটফর্মে বিনিয়োগের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজের অজান্তেই এ স্কিম বিস্তারে ভূমিকা রেখেছেন বলে এখন তার অনুশোচনা হচ্ছে।
লোকসানের ক্ষতিপূরণ করতে এমটিএফই সব ব্যবহারকারীর কাছ থেকে নতুন করে অর্থ দাবি করছিল। অনেক ব্যবহারকারী জানান, স্কিমটির অজ্ঞাত এজেন্টরা ভয় দেখানোর কৌশল অবলম্বন করছিলেন — নতুন করে টাকা না দিলে তারা আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিচ্ছিলেন।
বাংলাদেশে মোট কতজন এ স্কিমের প্রতারণার শিকার হয়েছেন তার কোনো স্পষ্ট তথ্য নেই। তবে গ্রাহকদের বিভিন্ন দলের নেতারা অনুমান করছেন, এ সংখ্যা এক থেকে পাঁচ লাখ হতে পারে। তাদের ধারণা, এ স্ক্যামে প্রায় হাজার কোটি টাকা খুইয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
বাংলাদেশে এমটিএফই অ্যাপ ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন দলের প্রায় ৪০০ জনের মতো দলনেতা রয়েছেন। তারা দেশজুড়ে স্কিমটির বিস্তার ঘটাতে কাজ করছিলেন। কোম্পানিটি তাদেরকে এ দায়িত্ব দিয়েছিল। এ দলনেতারা এমটিএফইর সক্রিয় ব্যবহারকারী ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এরকম একজন দলনেতা বলেন, 'রেফারেলের কারণে গত চার-পাঁচ মাসে অ্যাপটির ব্যবহার দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। এখন যা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে আমরা প্রতারণার শিকার হয়েছি।'
এমএফটিই দাবি করেছিল, তারা কানাডায় নিবন্ধিত সংস্থা। এর কার্যক্রম শ্রীলঙ্কা, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও ভারতেও ছড়িয়েছিল। এসব দেশের ব্যবহারকারীদেরও ভাগ্যেও একই পরিণতি হয়েছে।
এমটিএফই ট্রেডিং অ্যাপ: সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় স্ক্যাম
ক্রিপ্টো, বৈদেশিক মুদ্রা, পণ্য, এমনকি বিদেশি স্টক পর্যন্ত নিজের ছায়া প্ল্যাটফর্মে ট্রেড করার সুযোগ দিয়ে এ অ্যাপটি সম্প্রতি অবিশ্বাস্যরকমের জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
ট্রেডিং থেকে উপার্জন এবং অর্থ পরিশোধের কথা বলে অ্যাপটি ব্যবহারকারীদেরকে অবিশ্বাস্য সহজপথে অর্থ আয়ের আমন্ত্রণ জানায়।
অ্যাপের অফারটি যথেষ্ট লোভনীয় ছিল: প্রতিদিন ২৬ ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে দৈনিক প্রায় আধডলার আয় করার সুযোগ।
অ্যাপের সিস্টেমকে এ তথাকথিত ট্রেডিং চালাতে দিতে ব্যবহারকারীকে প্রতিদিন আধাঘণ্টা তার ফোনে অ্যাপটি খোলা রাখতে হয়। একটি ট্রেডিংয়ে জিতলে তিনি আধা ডলার উপার্জন করেন। হারলে জরিমানার পরিমাণও একই হয়।
তবে এক্ষেত্রে সমস্যা হলো, নতুন কেউ ব্যবহারকারীর রেফারেন্স নিয়ে অ্যাপটিতে যোগ দিলে তিনি দুই ডলারের বেশি আয় করেন — পঞ্জি স্কিম পদ্ধতির চিরায়ত নিয়ম যেটি।
গুগল প্লে স্টোরে পাওয়া যায় এমটিএফই অ্যাপটি। দেশে উপজেলা পর্যন্ত মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল এটি। গ্রাহকদের সিমুলেশন প্ল্যাটফর্মে ট্রেডিং চর্চা করতে বলে অ্যাপটি। ট্রেডিংয়ের এ চর্চার সময় লাভ-ক্ষতি যা-ই হোক, তার মালিকানা থাকে ব্যবহারকারীর কাছে।
বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ এমটিএফই অ্যাপে অন্তত ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন।
বাংলাদেশে বিদেশি সম্পদে বিনিয়োগ নিষিদ্ধ। এ কারণেই এমটিএফই ব্যবহারকারীদেরকে প্রথমে গ্রে মার্কেট ব্যবহার করে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিনতে হয়। তারপর তারা প্ল্যাটফর্মটিকে অর্থ দেন।
আবার অ্যাপটি থেকে ব্যবহারকারীদেরকেও ক্রিপ্টো মুদ্রায় অর্থ পরিশোধ করা হয়। ওই ক্রিপ্টো বাংলাদেশি এমটিএফই ব্যবহারকারীরা প্রথমে ডলারে, তারপর স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তর করেন।
এমটিএফইর কয়েক ডজন গ্রাহক জানিয়েছেন, ব্যবহারকারীদের ক্রিপ্টোকে টাকায় পরিণত করার খুব একটা দরকার হতো না, কারণ বেশিরভাগ ব্যবহারকারীই কেবল বড় লাভের আশায় অ্যাপটিতে টাকা ঢেলেছিলেন।
রাজশাহী, সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং ঢাকার যেসব ব্যবহারকারীর সঙ্গে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর কথা হয়েছে, তাদের প্রায় সবাই খুব ভালোমতো জানতেন, হুট করেই যেকোনোদিন অ্যাপটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তারপরও তারা এটিতে বিনিয়োগ করার জন্য অন্যদের আমন্ত্রণ জানাতেন। কারণ এতে তাদের আয় বাড়ত।
বরিশালে এমন একজন ব্যবহারকারী অ্যাপটির মাধ্যমে দুই কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছিলেন।
জেলার বানারীপাড়ায় এমটিএফই ব্যবহারকারীরা প্রায়ই তাদের 'সাফল্য' উদযাপন করতে মিলিত হতেন। এমটিএফই ব্যবহারকারীদের একটি ফেসবুক পেজে প্রায় ৫০ হাজার সদস্য রয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোর বড় কিছু স্ক্যাম
২০২১ সালে বগুড়ার কয়েক ডজন গ্রামবাসী পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন যে, তারা জনৈক রুহুল আমিনের পরিচয় করিয়ে দেওয়া 'এনজেড রোবো ট্রেড' নামক একটি বিটকয়েন ট্রেডিং অ্যাপে ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছেন।
রুহুল আমিন প্রথমে তাদেরকে ৯০ হাজার টাকা বিনিয়োগের বিনিময়ে মাসে ১৫ হাজার টাকা মুনাফা দিতেন। এভাবে তিনি মানুষের কাছ থেকে প্রচুর টাকা তুলে একদিন পালিয়ে যান। তিনি উধাও হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপটিও কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
রাজধানীতে একটি মুদি দোকানের মালিক ২৬ বছর বয়সী রবিন মিয়া ২০২১ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে টলিক নামক অ্যাপে ১৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন।
রবিন প্রতিদিন প্রায় ৯০ হাজার টাকা আয় করতে শুরু করেন। এরপর আট–নয়জন বন্ধু তার সঙ্গে ১০–২০ লাখ টাকা নিয়ে যোগ দেওয়ার পর লাভের অংক আরও মোটা হয়। ২৫ দিনে তার ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্টের মূল্য দাঁড়ায় ৩০ লাখ টাকায়। তারপর হঠাৎ একদিন অ্যাপটি বন্ধ হয়ে যায়।
এর জন্য দায়ী করার মতো কাউকেই পাননি এ ভুক্তভোগীরা।
এ ধরনে পঞ্জি স্কিম মূলত নতুন নতুন ব্যবহারকারীদের থেকে পাওয়া বিনিয়োগের ওপর ভিত্তি করে টিকে থাকে। নতুন পাওয়া এ অর্থ থেকেই অন্য গ্রাহকদের বিনিয়োগের লভ্যাংশ দেওয়া হয়। এরপর এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায় স্কিমটি। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাধারণ গ্রাহকদের বড় একটি অংশ।
বিডিলাইকঅ্যাপস, গোল্ডরাশ, ও গোল্ডেনলাইন-এর মতো কয়েক ডজন অ্যাপভিত্তিক স্ক্যাম দুই লাখেরও বেশি মানুষের কাছ থেকে কয়েকশ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল বলে সে সময় বেশকিছু ভুক্তভোগী দাবি করেছিলেন।
একজন প্রবাসী বাংলাদেশির প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত রিংআইডি ২০২১ সালে বন্ধ হওয়ার আগে মানুষের কাছ থেকে ৩০০ কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করেছিল।
চলতি বছরের শুরুর দিকে রাজশাহী নগরীতে প্রায় ৩০ জন ব্যক্তি পুলিশে অভিযোগ করেন, আল্টিমা ওয়ালেট নামক একটি অ্যাপ তাদের এক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তারা জনৈক মোনায়েমকে এর জন্য দায়ী করেন — এ ব্যক্তিই তাদেরকে অ্যাপটিতে অর্থ ঢালতে রাজি করিয়েছিলেন।
হাজার হাজার তরুণ শিক্ষার্থীকে অকূল পাথারে ফেলে মার্চ মাসে ইএমমুভি নামক আরেকটি অ্যাপ এভাবে বন্ধ হয়ে যায়।