লাশের সুরতহাল-ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে ভয়ংকর তথ্য রয়েছে: মুনিয়া হত্যামামলার আইনজীবী
মোশাররাত জাহান মুনিয়া হত্যা মামলায় সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন উপেক্ষা করার অভিযোগ করেছেন তার আইনজীবী ও স্বজনরা। একই সঙ্গে আসামি পক্ষ প্রভাব খাটিয়ে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন পাল্টে দিয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।
তাদের দাবি, মামলার প্রধান আসামি সায়েম সোবহান আনভীরসহ অন্যদের বাঁচাতে আসল ঘটনা ধামাচাপা দিতেই মুনিয়া হত্যার ঘটনাকে আত্মহত্যা সাজিয়ে মামলা থেকে তাদের অব্যাহতির আবেদন করা হয়েছে আদালতে।
সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের বেশ কিছু বিষয় উল্লেখ করে বাদীপক্ষের আইনজীবী সরোয়ার হোসেন বলেন, এ দুটি প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলেই মুনিয়াকে হত্যার ঘটনার ভয়াবহ তথ্য বেরিয়ে আসে। মুনিয়ার স্বজনরাও একই দাবি করেন।
২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল রাতে ঢাকার গুলশানের একটি ফ্ল্যাট থেকে গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় ২১ বছর বয়সী মোশারাত জাহান মুনিয়ার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেই রাতেই 'আত্মহত্যার প্ররোচনা'র অভিযোগ এনে বসুন্ধরা গ্রুপের এমডি আনভীরের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মামলা করেন মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান তানিয়া।
ওই বছরের ১৯ জুলাই সেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার ওসি আবুল হাসান ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন। তাতে তিনি আনভীরকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেন।
এদিকে সেই প্রতিবেদনে নারাজি দিয়ে পুনঃতদন্তের আবেদন করেন বাদীপক্ষের আইনজীবী এবং আদালত সেই আপিল গ্রহণ করেন।
মামলার রিটকারী আইনজীবী সরোয়ার হোসেন জানান, মোশাররাত জাহান মুনিয়াকে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে ২০১৯ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বনানীর একটি বাসায় রেখেছিলেন আসামি আনভীর। এরপর ১ মার্চ থেকে খুন হওয়ার আগ পর্যন্ত গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে রাখেন। বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুলশানের বাসায় আনভীর ছাড়া অন্য কেউ ঢুকতে পারতেন না।
সরোয়ার বলেন, "মুনিয়া মারা যাওয়ার পর তার লাশ ঝুলন্ত থাকলেও, পা খাটের সঙ্গে লাগানো ছিল। কেউ আত্মহত্যা করলে পা খাটের সঙ্গে লাগানো থাকবে না। তার মানে তাকে মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছে। অপরাধী এটা খেয়াল করেনি।"
তিনি বলেন, "সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হত্যার আগে তাদের মধ্যে জোর-জবরদস্তি হয়েছে। গুলশান থানা বাদীর বক্তব্য গ্রহণ না করে, ভুল করে পেনাল কোডের ৩০৬ ধারায় আত্মহত্যা প্ররোচনা হিসেবে রেকর্ড করে। কিন্তু প্রথমেই এই মামলা ৩০২ ধারার হওয়ার কথা ছিল।'
এই আইনজীবী বলেন, "ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুনিয়ার শরীরে পুরুষের বীর্য পাওয়া গেছে। তার মানে তাকে মৃত্যুর আগে ধর্ষণ করা হয়েছে। সেই বীর্য আনভীরের, কারণ সিসিটিভি ফুটেজ ও দারোয়ানের কথা অনুযায়ী সেই বাসায় আনভীর ছাড়া কেউ যেতে পারতেন না। আরও ভয়ংকর তথ্য হলো, মেয়েটা তিন সপ্তাহের অন্তঃসত্তা ছিল। তার মানে এটা দুইজনকে হত্যা করা। একদিনের ভ্রুণও যদি হত্যা করা হয়, সেটাও একটা হত্যাকাণ্ড।"
সরোয়ার বলেন, "এসব তথ্য গুলশান থানা ও পিবিআই– দুটোর তদন্তেই এসেছে। তদন্তে বেরিয়ে আসা তথ্যই বলে, এই মামলা সাজানো হয়েছে। এত কিছুর পরও চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আসামিদের অব্যাহতির আবেদন মানে, আসামিরা প্রভাব খাটিয়েছে।"
মামলা সম্পর্কে সরোয়ার বলেন, "প্রথম মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট দেয় ৩০৬ ধারায়। সেখানে আসামিকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়। তার বিরুদ্ধে আমরা নারাজি দিই এবং ফ্রেশ পিটিশন নিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনে যাই। সেখান থেকে এই মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ (১) ধারা এবং ৩০২ ধারায় রেকর্ড করার জন্য দ্বিতীয়বার গুলশান থানাকে বলা হয়। পাশাপাশি পিবিআইকে তদন্তের ভার দেওয়া হয়।"
তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় মামলায় পিবিআইয়ের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধেও আমরা আপিল করেছি নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ২৮ ধারায়। আপিল গ্রহণের পর আমরা হাইকোর্টে শুনানির জন্য দিয়েছি।'
মুনিয়ার বোন নুসরাত জাহান বলেন, "আপনারা এখনও আমার বোনের হত্যা মামলা নিয়ে কাজ করছেন, এটা আমাদের জন্য আশীর্বাদ। তখন বিচার হয়নি। আমরা শুনানির জন্য অপেক্ষা করছি। আমরা আসামির ফাঁসি চাই।"
নুসরাতের স্বামী মিজানুর রহমান বলেন, "আমার শ্যালিকা মুনিয়া হত্যার সঙ্গে যারা যারা জড়িত, সবার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।"
এদিকে মুনিয়া হত্যাকাণ্ডের মামলায় যেসব পুলিশ সদস্য কাজ করেছেন তাদের কেউ বর্তমানে সংশ্লিষ্ট থানায় দায়িত্বে নেই। তবে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কেউই এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হননি।
পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানজিনা আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি একদিন সময় নেন তথ্য দেওয়ার জন্য। তবে পরদিন যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আগে যারা ছিলেন তারা মুনিয়ায় ব্যাপারে কথা বলতে চান না।