‘কেউ কি বাতাসের মান আদৌ খতিয়ে দেখছে?’
সিদরাত জেবিন (৩০) ছিলেন একজন চিকিৎসক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে হাঁপানিতে ভুগছিলেন। গতকাল তিনি মারা যান। মৃত্যুর কিছু ঘণ্টা আগে তিনি নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পোস্ট দিয়েছিলেন।
পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, "ঢাকার বায়ুদূষণের কারণ কী? এত প্রকৌশলী থাকার পরও দূষণের কারণ নিয়ে কোনো তথ্য নেই। কেউ কি বাতাসের মান আদৌ খতিয়ে দেখছে? মনে হয় না শুধু ধুলো আর নির্মাণসামগ্রীর জন্য এই অবস্থা। কিছু এলাকায় বাতাসে নিশ্চয়ই বিষাক্ত গ্যাস আছে... এটা খুবই হতাশাজনক কারণ আমাদের শহরে কেউ এই সমস্যার সমাধানে কাজ করছে না।"
তার মৃত্যুর সময় ঢাকার বায়ুমান খুবই অস্বাস্থ্যকর ছিল। সকাল ১০টায় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) ছিল ২৫৩। বিশ্বের প্রধান শহরগুলোর মধ্যে বায়ু দূষণে শীর্ষে ছিল ঢাকা এবং কয়েক দিন ধরেই এটি সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে।
একিউআই সূচক অনুযায়ী, ১৫১-২০০ "অস্বাস্থ্যকর," ২০১-৩০০ "খুবই অস্বাস্থ্যকর" এবং ৩০০-এর বেশি "ঝুঁকিপূর্ণ" হিসেবে ধরা হয়, যা গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
সোমবার রাতে ঢাকার বায়ুদূষণ নতুন রেকর্ড তৈরি করে। রাত ১০টায় আইকিউএয়ার সূচকে একিউআই পৌঁছায় ৪৫৭-এ। সন্ধ্যা ৮টা থেকে টানা ৫ ঘণ্টা এই সূচক ৪০০-এর বেশি ছিল।
পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান কারণ বর্জ্য পোড়ানো, উন্নয়ন কাজ, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, ইটভাটা এবং সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে আসা দূষিত বাতাসসহ অন্যান্য কারণ।
দুই সিটি করপোরেশন অভিযোগ জানিয়েছে, উন্নয়ন কাজ থেকে তৈরি হওয়া দূষণ তাদের কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। পানি ছিটানো ও শহর পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য তাদের যানবাহনের সংখ্যা সীমিত। পানির সরবরাহ কম থাকায় খুব সীমিত পরিমাণে পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে।
কুড়িল এলাকার বাসিন্দা হাবিবুল্লাহ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত কয়েক দিন ধরে আমাদের এলাকায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমার বাড়ি প্রগতি সরণি রোডের কাছাকাছি এবং এই রাস্তাটি অফিসে যাওয়ার জন্য নিয়মিত ব্যবহার করি। আমাদের পরিবারের চার সদস্যই সর্দি-কাশিতে ভুগছি। আমার তিন বছরের শিশুকে এখন বায়ুদূষণজনিত রোগের কারণে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমি বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করলেও, ধুলার প্রকোপ থেকে বাঁচতে পারি না। আমার অ্যাজমা সমস্যা গত কয়েকদিনে বেড়েছে এবং ডাক্তার বলেছে, এমন বায়ু দূষণের মধ্যে ঘরের বাইরে না যেতে। কিন্তু না গিয়ে তো সম্ভব না। বাসার জানালা সবসময় বন্ধ থাকলেও রুমে ধুলা জমে যায়।"
বাড়ছে বায়ুদূষণজনিত রোগীর সংখ্যা
বায়ু দূষণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুসহ সব বয়সী মানুষের অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন ধরনের শ্বাসতন্ত্রের রোগ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
দুই মাস আগেও শ্যামলীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতাল-এর আউটডোরে দিনে গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ রোগী চিকিৎসা নিতেন। এখন তা বেড়ে ৫০০ হয়েছে। ইনডোরে বর্তমানে ভর্তি আছেন ১০০ রোগী, অন্যান্য সময় যা অনেক কম থাকে।
শ্যামলীর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার টিবিএসকে বলেন, "সিজন পরিবর্তন, বায়ু দূষণ বেড়ে যাওয়ায় এখন হাঁচি-কাশি ও অ্যাজমার রোগী অনেক বেড়ে গেছে।"
বাংলাদেশে প্রায় এক তৃতীয়াংশ রোগী ফুসফুসের বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশ অ্যাজমা অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে শুধু অ্যাজমাতে আক্রান্ত ৭০ লাখ মানুষ।
প্রতিরোধমূলক ওষুধ বিশেষজ্ঞ এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. এম এইচ চৌধুরী লেলিন টিবিএসকে বলেন, "বায়ু দূষণের স্বল্পমেয়াদি প্রভাবের মধ্যে রয়েছে হাঁচি, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট। আর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, মাথা ঘোরা, ফুসফুসের প্রদাহ, যক্ষ্মা, ফুসফুসের ক্যানসার, অপরিণত শিশুর জন্ম এবং পুরুষ ও নারীর উভয়ের ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্বের ঝুঁকি বৃদ্ধি।"
তিনি বলেন, "বায়ু দূষণ কমাতে হলে হাইকোর্টের যে নির্দেশনা আছে সেটি আপাতত বাস্তবায়ন করতে হবে। শহরের মধ্যে কোন ইন্ডাস্ট্রি থাকবে না, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে, মোটর গাড়ির ইঞ্জিন ঠিক রাখতে হবে, জ্বালানি যেন মানসম্মত হয় এবং ঢাকার চারপাশে যে ইট ভাটা আছে, তা একটু সরিয়ে নিতে হবে।"
তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতিদিন বায়ুর মান কেমন, তা জানানো উচিত। এছাড়া, অস্বাস্থ্যকর দিনে জনসাধারণকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেওয়া উচিত, প্রয়োজনে স্কুল বন্ধ রাখা এবং ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের বাইরের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলা উচিত।
ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরামর্শক (মেডিসিন) ডা. আশরাফুল ইসলাম ইরফান বলেন, "বায়ুদূষণ থেকে সুরক্ষার জন্য বাইরে থাকাকালে মাস্ক পরা এবং নিয়মিত হাত ধোয়া অত্যন্ত জরুরি। হাঁপানি রোগীরা দূষণের কারণে মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হন। তাদের উচিত ইনহেলার ব্যবহার করা, মাস্ক পরা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়া সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা নেওয়া।"
গত ৯ বছরে বায়ুদূষণে শীর্ষে বাংলাদেশ
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর অ্যাটমসফেরিক পলিউশন স্টাডিজ (সিএপিএস)-এর এক গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে, ২০১৬ সালের পর থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার হয়েছে।
গত আট বছরে (২০১৬-২০২৩) নভেম্বরে ঢাকার গড় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) ছিল ১৭৬.৬৬। তবে এ বছরের নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯৫। এটি গত নয় বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি এবং ২০২৩ সালের তুলনায় ১১.৫ শতাংশ বৃদ্ধি।
সিএপিএস-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত নভেম্বরে ঢাকার বাসিন্দারা এক দিনও নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে পারেননি। এক দিন বায়ুমান ছিল 'মাঝারি, সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য চার দিন ছিল 'ঝুঁকিপূর্ণ', বারো দিন ছিল 'অস্বাস্থ্যকর' এবং তেরো দিন ছিল 'খুবই অস্বাস্থ্যকর।' এমন পরিস্থিতিতে যখন একিউআই ৩০০ ছাড়িয়ে যায়, তখন সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা উচিত।"
কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় গতকাল নাগরিকদের বাইরে মাস্ক পরার আহ্বান জানিয়েছে এবং সংবেদনশীল ব্যক্তিদের প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেছেন, "সম্প্রতি একিউআই ৩০০ ছাড়ালেও এর স্থায়িত্ব দীর্ঘ ছিল না। আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন পদক্ষেপ বিবেচনা করছি, যার মধ্যে দূষণজনিত ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে ঢাকায় স্কুল বন্ধ রাখা এবং একিউআই ২৫০ ছাড়ালেই মোবাইলে সতর্কবার্তা পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "সব মন্ত্রণালয়কে সতর্ক থাকার এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে বারবার অনুরোধ করা হলেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।"
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে নেওয়া পদক্ষেপের বিষয়ে জানা গেছে, তাদের চারটি রোড সুইপার এবং নয়টি পানি ছিটানোর গাড়ি রয়েছে। তবে দূষণের চরম সময়েও কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশন-এর পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সুপারিনটেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার মো. খায়রুল বকর বলেন, "আমাদের ৫ হাজার লিটারের চারটি এবং ৭ হাজার লিটারের পাঁচটি পানি ছিটানোর গাড়ি আছে। কিন্তু পানির স্বল্পতার কারণে প্রয়োজন অনুযায়ী ছিটানো সম্ভব হচ্ছে না। ওয়াসা প্রতিদিন যথেষ্ট পানি সরবরাহ করে না, আর খাল বা নদীর দূষিত পানি ব্যবহার করা যায় না।"
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের একই বিভাগের সুপারিনটেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার খোন্দকার মাহবুব আলম বলেন, "আমাদের দশটি পানি ছিটানোর গাড়ি আছে, যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। ফলে আমরা পালা করে বিভিন্ন এলাকায় পানি ছিটাই। প্রতিটি রাস্তায় সকালবেলায় একবার পানি ছিটানো হয়। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা আবার ধুলায় ঢেকে যায়। রাস্তা সব সময় ভেজা রাখা বাস্তবসম্মত নয়।"