লঞ্চে অগ্নিকাণ্ড: বছরের পর বছর ধরে অনাকাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা ঝুঁকি জলপথগুলোকে তাড়া করে ফিরছে
নৌপথে আবারো মৃত্যুর মিছিল দেখল বাংলাদেশ। একের পর এক ফেরিডুবিতে হতাহতের সংখ্যায় নতুন মাত্রা যোগ করলো 'এমভি অভিযান-১০' এর অগ্নিকাণ্ড। যেজন্য নৌপথে দুর্ঘটনায় দোষীদের চিরকাল ছাড় পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতিই দায়ী।
লঞ্চটিতে লাগা আগুনে পুড়ে অন্তত ৪০ জনের প্রাণহানির কথা জানা গেছে, আহত হয়েছেন আরো দুই শতাধিক যাত্রী।
তবে রাজধানীর সাথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সংযোগ থাকা সকল নৌপথে নৌযান ডুবির ঘটনাও হরহামেশাই ঘটছে।
চলতি বছরের এপ্রিলে বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিউটের প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত ১৫ বছরে দেশের নৌপথগুলোয় ৫৭৬টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৮২২ জন। আহত ৪১৯ এবং আজো সন্ধান মেলেনি ৮৬৪ জনের।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'সেভ দ্য রোড' শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) জানায়, কেবল ২০২১ সালেই নৌপথে দুর্ঘটনায় ১৮৮ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এই তথ্য গত ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালে এমন দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অদক্ষ কর্মী এবং ফিটনেসহীন অবস্থার কারণেই নৌযান ডুবে যায়। অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাও উচ্চ মৃত্যুর সংখ্যার আরেকটি কারণ।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) চেয়ারম্যান কমোডর গোলাম সাদেক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কর্তৃপক্ষ নৌযানের ক্রু সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়।
"সব ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি"- বলেন তিনি।
অথচ ২০২১ সালে প্রকাশিত বিআইডব্লিউটিসি'র একটি প্রতিবেদন বলছে, গত ১১ বছরে ৩৮৭ জাহাজ বা নৌযান ডুবি হয়েছে। তা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগের অভাবে ক্ষতিগ্রস্তরা ন্যায়বিচার পায়নি।
তবে চেয়ারম্যান সাদেকের মতে, নৌপথ কর্তৃপক্ষ প্রত্যেকটি দুর্ঘটনার তদন্ত করে এবং আইনি ব্যবস্থা নেয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে মাত্র একটি মেরিন আদালত রয়েছে, যেখান 'ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স-১৯৭৬' অনুসারে জাহাজ ও নৌযানের সংশ্লিষ্ট ত্রুটি ও অবহেলার অভিযোগগুলি নিষ্পন্ন করা হয়।
এই আইনের আওতায় নৌযান দুর্ঘটনার জন্য দোষীদের শাস্তি পাঁচ বছরের জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা।
শুক্রবারে এমভি অভিযান-১০ এর ইঞ্জিন রূপ থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয় বলে জানা গেছে। আগুনের লেলিহান শিখা সবখানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যাত্রী বোঝাই লঞ্চটিতে অগ্নি-নির্বাপনের অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা কোনো কাজেই লাগেনি।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যানের বক্তব্য নৌযানটিতে যথাযথ আগুণ নেভানোর যন্ত্রপাতি ছিল।
"তবে ক্রুরা অবহেলা করে সেগুলো ব্যবহার করেনি"- বলে টিবিএস'কে জানান তিনি।
শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) লঞ্চটি ঢাকা থেকে বরগুনা যাচ্ছিল। এসময় ঝালকাঠি জেলার সুগন্ধা নদীতে আগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
এসময় লঞ্চটিতে প্রায় এক হাজার যাত্রী থাকার কথা বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেলা ৩:২৮ ঘটিকায় জানতে পারে ফায়ার সার্ভিস। এরপর বেলা ৩টা ৫০ মিনিট নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় দমকলের ১৫টি ইউনিট। টানা দুই ঘণ্টা আপ্রাণ চেষ্টার পর বেলা ৫টা ২০ মিনিটে তারা আগুন নেভাতে পারেন।
দমকল কর্মকর্তারা জানান, ভারি কুয়াশার কারণে উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হয়। দুর্ঘটনার পর থেকেই নিখোঁজ রয়েছে অনেক যাত্রী।
বেঁচে ফেরা যাত্রীরা বলছেন, বেলা প্রায় ৩টার দিকে লঞ্চের ক্যান্টিন ও ইঞ্জিন রুম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আগুন থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া ও গ্যাসের কারণেও অনেকের মৃত্যু হয়েছে।
অগ্নিনির্বাপনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় প্রাথমিকভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন লঞ্চের যাত্রীরা। বিষয়টি লঞ্চের একজন কর্মীও স্বীকার করেছেন।
এদিকে দুর্ঘটনার শিকার নৌযানটিকে তীরে ভেড়ানো হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ'র নজরদারির ব্যাপারে এর চেয়ারম্যান গোলাম সাদেক আরো বলেছেন, "লঞ্চে যথেষ্ট লাইফবয়া আছে কিনা তা আমরা সব সময় চেক করি। কিন্তু, আপৎকালীন সময়ে যাত্রী ও ক্রুরা সেগুলো ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারে না।"
অগ্নি-দুর্ঘটনা প্রতিরোধকে নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষ জোর গুরুত্ব দিচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সাদেক বলেছেন, "ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের দুর্ঘটনা আর না ঘটে, সেজন্য নৌযান কর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।"