অগাধ ভালোবাসা ছিল শিক্ষার্থীদের প্রতি, এক শিক্ষার্থীর হাতেই প্রাণ গেল তার
"শিক্ষার্থীদের খুব ভালোবাসতেন তিনি, প্রায়শই বলতেন 'স্কুলের প্রতিটি শিক্ষার্থী আমাকে খুব ভালোবাসে'। শুধু শিক্ষার্থী নয়, প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষকরাও তাকে ভালোবাসতেন, এই ভালোবাসাই আজ তার কাল হলো," মুঠোফোনে টিবিএসের সাথে আলাপকালে এভাবেই কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সাভারের আশুলিয়ায় নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর হাতে হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করা হাজী ইউনুস আলী কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের স্ত্রী বিউটি রানী নন্দী।
সাভারের আশুলিয়ায় স্ট্যাম্পের আঘাতে শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারের মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বাবাকে আজ বুধবার (২৯ জুন) সকালে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গত শনিবার (২৫ জুন) দুপুর ২ টার দিকে ওই স্কুল মাঠে শিক্ষককে স্ট্যাম্প দিয়ে বেধড়ক মারধর করে জিতু। পরে তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার (২৭ জুন) মারা যান উৎপল কুমার সরকার।
"অন্যান্য দিনের মত ঘটনার দিন সকালেও সাড়ে ৬টা নাগাদ মিরপুরের বাসা থেকে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হন উৎপল। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেড়ে টিফিন নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায় সে, সেদিন বুঝতে পারিনি এ যাওয়াই তার শেষ যাওয়া," বলেন বিউটি রানী।
বিউটি রানী বর্তমানে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদে কর্মরত আছেন বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন।
নিহতের ভাই অসীম কুমার সরকার টিবিএসকে জানান, পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে উৎপল ছিলেন সবার ছোট। উৎপলের মৃত্যুতে তাদের পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
ময়না তদন্ত শেষে উৎপলের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ধর্মীয় রীতি মেনে সোমবার রাতে সেখানেই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।
অসীম কুমার সরকার জানান, উৎপল প্রতিষ্ঠানটির শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হওয়ায় বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের ভূল ত্রুটি হলে শাসন করতেন। এসব কারণেই অভিযুক্ত শিক্ষার্থী উৎপলের উপর ক্ষব্ধ থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিষ্ঠানটির অপর শিক্ষক শফিকুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "সেদিন দুপুরে মাঠে ছাত্রীদের ক্রিকেট খেলা চলছিল। হঠাৎ দশম শ্রেণির ছাত্র জিতু একটা স্ট্যাম্প হাতে উৎপল স্যারের দিকে এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে তাকে কয়েকটি আঘাত করে। আমি তখন মাঠের অপর প্রান্তে ছিলাম। দুর থেকে ঘটনাটি দেখে আমি দ্রুত সেখানে গিয়ে জিতুকে ধমক দিলে সে আমার উপরেও ক্ষুব্ধ হয়ে বাজে আচরণ করে।"
"আমরা আহত অবস্থায় স্যারকে (উৎপল কুমার) প্রথমে আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাই। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।"
অন্যদিকে কলেজের একাধিক শিক্ষার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, এর আগে বিভিন্ন সময় একাধিকবার মেয়েদের উত্যক্ত করার অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়েছিলো জিতুকে। সেসব বিচারের বেশিরভাগ সময়ই উপস্থিত ছিলেন কলেজের শিক্ষক ও শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি উৎপল কুমার। তবে বারংবারবিচারের মুখোমুখি হওয়া জিতুর অভিভাবককে এ বিষয়ে সতর্ক করলেও সংশোধন হয়নি জিতু।
এদিকে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর হামলার শিকার হয়ে উৎপল কুমারের মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে প্রতিষ্ঠানটি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। শিক্ষকরা জানান, জিতু গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ থাকবে।
প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ মো. সাইফুল ইসলাম জানান, ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে যোগ দেন উৎপল সরকার। নিয়মিত কাজের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করতেন তিনি। শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতির দায়িত্বে থাকায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অভিযোগে জিতুকে তার কাছে নিয়ে গিয়েছেন উৎপল। সেসব ঘটনায় জিতুর পরিবারকে বারবার সতর্ক করা হলেও জিতুর মধ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি।
অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটির একাধিক শিক্ষার্থী ও জিতুর কয়েকজন সহপাঠীর সাথে কথা বললে জিতুর এমন বেপরোয়া আচরণের জন্য তার পরিবার ও প্রতিষ্ঠানে তার পরিবারের প্রভাবকেই দায়ী করেন তারা। শিক্ষার্থীরা জানায়, প্রতিষ্ঠানের পরিচালক মো. সুমন সম্পর্কে জিতুর চাচা। এছাড়াও জিতুর বাবা উজ্জল হোসাইন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি হাজী হযরত আলীর ভাগ্নে। একারণে একাধিক অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও জিতুর বিরুদ্ধে কখনো কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।
বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম টিবিএস'কে বলেন, "সভাপতির আত্মীয় হওয়ায় এটা নিয়ে তাদের মধ্যে এক প্রকার দাম্ভিকতা ছিলো এটা ঠিক, তবে আমরা শিক্ষকরা এটিকে কখনোই প্রশ্রয় দেইনি।"
অন্যদিকে নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর হামলার শিকার হয়ে শিক্ষক নিহতের এমন নেক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছেন স্থানীয়রা। আশুলিয়ার চিত্রাশাইল এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, স্থানীয় বাসিন্দা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ইতিমধ্যে মঙ্গলবার সকালে এঘটনায় মানববন্ধন ও একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
এদিকে বুধবার (২৯ জুন) সকালেও প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা শিক্ষক উৎপল কুমারকে হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে একটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। এর আগে মঙ্গলবার সকালে সাভার উপজেলা পরিষদের শহীদ মিনারের সামনে এক মানববন্ধন ও সমাবেশ করে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ।
স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের ঢাকা জেলা (উত্তর) শাখা কমিটির সভাপতি ও সাভার অধরচন্দ্র সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রতন পিটার গোমেজ টিবিএস'কে বলেন, "এমন ঘটনা গোটা শিক্ষক সমাজের উপর হামলার শামিল, ঘটনার পর ৩ দিন পার হলেও এখনো সেই অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ, যা আরও বেশি দুঃখজনক। আমরা অবিলম্বে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।"