নিজের প্রথম আমেরিকান সিনেমা টাইটানিককে নিয়ে বানাতে চেয়েছিলেন আলফ্রেড হিচকক
সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার প্রশ্নে সিনেমার সংখ্যার চেয়ে মানই প্রধান বিবেচ্য। বিখ্যাত অনেক নির্মাতারই সিনেমার সংখ্যা অন্যদের তুলনায় কম।
তবে আলফ্রেড হিচককের কথা একেবারে আলাদা। গুণী এই নির্মাতা যেমন অসংখ্য ক্লাসিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তেমনি তিনি তার কোনো নির্মাণে মান নিয়ে কখনো আপস করেননি।
হিচককের বিশেষত্ব এখানেই, তিনি ৫০টির বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেও, প্রতিটি চলচ্চিত্রে নির্মাণশৈলীর মান বজায় রেখেছিলেন তিনি।
'টাইটানিক জাহাজডুবি'র ট্র্যাজেডি নিয়ে ১৯৯৭ সালে বিশ্বখ্যাত সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন জেমস ক্যামেরন। কিন্তু ক্যামেরনের বহু আগেই এই ঘটনার ওপর একটি রোমান্টিক ডিজাস্টার ফিল্ম নির্মাণের কথা ভেবেছিলেন হিচকক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর বাস্তবে রূপ নেয়নি।
টাইটানিক জাহাজডুবি নিয়ে হিচককের চলচ্চিত্র নির্মাণচেষ্টা
আলফ্রেড হিচকক আমেরিকান সিনেমার ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। তবে অনেকেই হয়ত জানেন না, বিখ্যাত এই নির্মাতার কর্মজীবন শুরু করেন ইংল্যান্ডে চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে।
ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে নির্মিত মারাদাঙ্গা থ্রিলার 'স্যাবোটেজ'- তার ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য সিনেমা না হলেও, এতে তার গল্প বলার ধরন এবং চলচ্চিত্রশিল্পে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের সাহসিকতা দেখিয়ে তিনি কৃতিত্বের ছাপ রেখেছেন।
পরবর্তীতে হিচকক তার উচ্চাভিলাষী প্রজেক্টগুলোর অর্থ সংস্থানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর কথা ভাবেন। ঠিক এসময় তার মেধা এমজিএম'র প্রযোজক ডেভিড ও. সেলৎনিককে আকর্ষিত করে।
বিখ্যাত এই প্রযোজক মনে করতেন, হিচককের অসাধারণ মেধায় নির্মিত চলচ্চিত্র আমেরিকান দর্শকদের মন জয় করতে পারবে।
সে সময় ও. সেলজনিক ছিলেন খ্যাতির চূড়ায়। কারণ তার ১৯৩৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মহাকাব্যিক রোমান্টিক 'গন উইথ দ্য উইন্ড' সবেমাত্র সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে একাডেমি পুরস্কার জিতেছে।
এছাড়া চলচ্চিত্রটি কয়েক দশক শীর্ষস্থান ধরে রাখা 'দ্য বার্থ অফ এ নেশন'কে পিছে ফেলে সর্বকালের সর্বোচ্চ উপার্জনকারী চলচ্চিত্রে পরিণত হয়েছিল।
'গন উইথ দ্য উইন্ড'-এর সাফল্যের পর ও. সেলজনিক সাম্প্রতিক কোনো ঘটনার উপর ভিত্তি করে একটি ট্র্যাজিক ঐতিহাসিক মহাকাব্যিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন।
ততদিনে টাইটানিকের ডুবে যাওয়ার পরে বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। ও. সেলজনিক চেয়েছিলেন এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি ডিজাস্টার ফিল্ম নির্মাণ করবেন।
চলচ্চিত্রটিতে বাস্তবতার ছোঁয়া দেওয়ার জন্য তিনি একটি সত্যিকার জাহাজডুবির পরিকল্পনা করেন। ও. সেলজনিক টাইটানিক ডুবির এই দৃশ্যায়নের জন্য হিচকককে কাজে নিয়েছিলেন।
এই চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন 'মডার্ন টাইমস' ও 'দ্য গ্রেট ডিক্টেট '-খ্যাত অভিনেতা পলেট গডার্ড। এছাড়া মাইকেল ফস্টার ও উইনস্টন মিলারও এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে সম্মত হয়েছিলেন।
এর স্ক্রিপ্ত লিখেছিলেন ইংরেজ নাট্যকার জে বি প্রিস্টলি।
আশা করা হচ্ছিল হিচককের প্রথম এই আমেরিকান চলচ্চিত্র এবং তাতে প্রযোজক হিসেবে ও. সেলজনিকের উপস্থিতি সবমিলিয়ে টাইটানিককে সেসময়ের অন্যতম সফল হলিউড সিনেমায় পরিণত করবে।
কেন হিচককের টাইটানিক চলচ্চিত্রটি করা হলোনা?
বিষয়টি নিয়ে হিচকের প্রচণ্ড উৎসাহ থাকলেও, প্রথম থেকেই টাইটানিক চলচ্চিত্রটি ছিল আইনি সমস্যায় জর্জরিত।
হিচকক একটি বিশাল ট্যাংকের ভেতর একটি বড় আকারের ট্রলার ব্যবহার করে সামুদ্রিক দুর্ঘটনা দৃশ্যায়নের কথা ভেবেছিলেন। তবে সাম্প্রতিক জাহাজডুবির ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং এই দৃশ্যায়নের ব্যাপারে ব্রিটিশ শিপিং সংস্থা কুনার্ড-হোয়াইট স্টার লাইন উদ্বেগ্ন প্রকাশ করে এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। সেসময় হিচককেরা পাশে দাঁড়ান প্রযোজক ডেভিড ও. সেলৎনিক।
এমনকি কুনার্ড-হোয়াইট স্টার লাইন ওয়াশিংটনে স্টেট ডিপার্টমেন্টে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগও দায়ের করে।
একদিকে আইনি জটিলতা, আর অন্যদিকে বহুল পরিচিত এই গল্পে সাসপেন্স কীভাবে আনবেন তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন হিচকক। কারণ দর্শক আগে থেকেই জানে এই ঘটনার শেষ পরিণতি কী।
তিনি বুঝতে পারেন, টাইটানিকের মতো সর্বজনবিদিত একটি গল্পে দর্শকদের আগ্রহ টানতে তাকে কঠোর পরিশ্রম ও ঝুঁকি নিতে হবে। হিচকক বিষয়টি নিয়ে ক্রমেই ভেঙে পড়েন।
ঠিক তখনই ও. সেলজনিক একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের টাইটানিক চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানান তাকে।তিনি ড্যাফনে ডু মরিয়ারের উপন্যাসের কাহিনি অবলম্বনে চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানান হিচকককে।
কিন্তু অল্পদিন পরই টাইটানিকের সমস্ত চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে হিচকক এবং ও. সেলজনিক ডু মরিয়ারের আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস রেবেকার গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।
এরপর 'রেবেকা' দিয়ে হিচকক আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকান প্রযোজনা শুরু করেন। পরবর্তীতে এটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে একাডেমি পুরস্কার লাভ করে।
এই চলচ্চিত্রের নির্মাণশৈলী সম্পর্কে তার নিজের কিছুটা সন্দেহ থাকলেও, রেবেকার সাফল্য এমজিএমের কাছে হিচককের যোগ্যতা প্রমাণ করে। এরপর থেকে হিচকককে আর পেছনে ফিরে তাকতে হয়নি।
টাইটানিকের গল্প নিয়ে আর কিছু না নির্মাণ করলেও শেষ পর্যন্ত ১৯৪৪ সালে হিচকক বানিয়ে ফেলেন একেবারে অন্যরকম এক সামুদ্রিক অ্যাডভেঞ্চার থ্রিলার 'লাইফবোট'।
তার নির্মিত এই সারভাইভাল ফিল্মে একদল ব্রিটিশ ও আমেরিকান নাগরিকের গল্প দেখানো হয়। যাদের জাহাজে একটি জার্মান ইউ-বোট আক্রমণ করায় তারা একটি ছোট ভেলায় আটকা পড়েন।
টাইটানিকের মতো সরাসরি সত্য ঘটনার ওপর নির্মিত না হলেও লাইফবোট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতি খুব সফলভাবেই ফুটিয়ে তুলেছিল।
'লাইফবোট' দারুণভাবে মানুষের নৈতিকতা এবং দুর্যোগ পরিস্থিতির করুণ কাহিনিকে ফুটিয়ে তুলেছিল। টাইটানিক চলচ্চিত্রের মতো না হলেও, শেষ পর্যন্ত 'লাইফবোট' দর্শক নন্দিত হয়েছিল।
জেমস ক্যামেরনের সিনেমা টাইটানিকের সবচেয়ে বিখ্যাত গল্প
হিচককের ছবি বাস্তবে রূপ না নিলেও টাইটানিকের গল্প নিয়ে বরাবরই মুগ্ধ হলিউড।
১৯৩৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ফ্র্যাঙ্ক লয়েড পরিচালিত সিনেমা 'ক্যাভালকেড'-এ টাইটানিকের ডুবে যাওয়াসহ ব্রিটিশ ইতিহাসের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দৃশ্য ছিল। এই সিনেমাটি সেরা সিনেমা হিসেবে একাডেমি পুরস্কার জিতেছিল।
এরপর ১৯৫৩ সালে বারবারা স্ট্যানউইক ও ক্লিফটন ওয়েব অভিনীত চলচ্চিত্র 'টাইটানিক'-ও সফল হয়েছিল।
এছাড়া এই ঘটনা নিয়ে ১৯৫৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ব্রিটিশ ডকুড্রামা 'আ নাইট টু রিমেম্বার' চলচ্চিত্র শ্রেষ্ঠ মৌলিক চিত্রনাট্যের জন্য একাডেমি পুরস্কার অর্জন করে।
এর একদশক পর ১৯৬৪ সালে টাইটানিক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফেরা একজনকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয় 'দ্য আনসিংকেবল মলি ব্রাউন'। এই সিনেমার চরিত্র ডেবি রেনল্ডস তখন সর্বত্র আলোচিত হয়।
অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায় ডেভিড ক্যামেরনের ঐতিহাসিক মহাকাব্যিক সিনেমা 'টাইটানিক'। যা এই দুর্ঘটনা নিয়ে নির্মিত আগের সব চলচ্চিত্রের রেকর্ড ভেঙে সর্বকালের সেরা মাস্টারপিস এবং সর্বকালের সর্বোচ্চ উপার্জনকারী চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে। এছাড়া, চলচ্চিত্রটি সর্বাধিক অস্কার জয়ের রেকর্ডও অর্জন করে।
তবে অনেকের মতে, চলচ্চিত্রটির সাফল্যের বেশিরভাগই এর যুগান্তকারী ভিজ্যুয়াল এফেক্টগুলোর কৃতিত্ব।
হিচকক যা করতে ব্যর্থ হয়েছিল, ক্যামেরন তা করে দেখিয়েছে। দর্শকরা যদিও জানতো জাহাজটি ডুবে যাবে, তবুও জাহাজডুবির সাসপেন্সকে ছাপিয়ে জ্যাক (লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও) ও রোজের (কেট উইন্সলেট) প্রণয় একটি অমর প্রেমকাহিনী হিসেবে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছে।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি