স্ত্রী ২, ভুল ভুলাইয়া ৩... হরর সিনেমার সহজ ফর্মুলা কি বলিউডকে সংকট থেকে টেনে তুলতে পারবে?
এই বছর একে একে অশুভ আত্মা, ভূত-প্রেত আর প্রতিহিংসাপরায়ণ ডাইনিরা বলিউডে ফিরে আসছে। ২০২৪ সালে ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে বেশি আয় করা সিনেমাগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল হরর সিনেমা। খবর বিবিসির।
তাই বিবিসি জানার চেষ্টা করেছে, কীভাবে এই কম বাজেটের সিনেমাগুলো ব্যবসাসফল হচ্ছে।
এই মাসের শুরুর দিকে বলিউডে বড় ও ছোট বাজেটের সিনেমাগুলোর মধ্যে এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতা দেখা যায়। একদিকে ছিল তারকাবহুল বিশাল বাজেটের অ্যাকশন ফিল্ম 'সিংহাম এগেইন', অন্যদিকে 'ভুল ভুলাইয়া ৩' নামের মাঝারি বাজেটের হরর-কমেডি সিনেমা। এটি তিন পর্বের হরর-কামেডি সিরিজের সর্বশেষ সিক্যুয়াল।
ফিল্ম অ্যানালিটিক্স ট্র্যাকার স্যাকনিল্কের তথ্যানুযায়ী, 'সিংহাম এগেইন' সিনেমায় বলিউডের পাঁচজন তারকা অভিনেতা অভিনয় করেছেন। তারা হলেন- অজয় দেবগণ, অক্ষয় কুমার, কারিনা কাপুর, দীপিকা পাড়ুকোন ও রণবীর সিং। সিনেমাটি চার দিনে বিশ্বব্যাপী ১.৮৬ বিলিয়ন রুপি [২২.০৫ ডলার;১৭.০৬ পাউন্ড] আয় করেছে।
অন্যদিকে, তুলনামূলকভাবে তরুণ অভিনেতা কার্তিক আরিয়ান অভিনীত 'ভুল ভুলাইয়া ৩' একই সময়ে এর [সিংহাম এগেইন সিনেমা] চেয়ে অল্প কিছু কম আয় করেছে [১.৬৩ বিলিয়ন রুপি]। এর মানে কম বাজেটের এই সিনেমার পারফরম্যান্স তুলনামূলক বেশি ভালো।
সিনেমাটির দ্বিতীয় সিক্যুয়ালেও আরিয়ান ছিলেন, যেখানে তাকে একজন ভন্ড ওঝা হিসেবে দেখানো হয়। একটি রাজপরিবারের সদস্যরা তাদের প্রাসাদ থেকে একটি অশুভ আত্মাকে তাড়ানোর জন্য তাকে ডেকে আনে।
অ্যাডভেঞ্চার এবং হাস্যরসে ভরপুর এই সিনেমাটি দেখতে দর্শকরা প্রেক্ষাগৃহে ভিড় জমাচ্ছেন।
এই সিনেমার সাফল্যের মধ্যদিয়ে, বলিউডে সম্প্রতি একটি নতুন ট্রেন্ডের ধারাবাহিকতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। একসময় যেই হরর এবং হরর-কমেডি সিনেমাগুলোয় দর্শকদের আগ্রহ তলানিতে ছিল, এখন সেসব সিনেমাই বক্স অফিস মাতাচ্ছে।
এই ট্রেন্ড শুরু হয়েছিল অজয় দেবগন অভিনীত সাইকোলোজিক্যাল হরর ফিল্ম 'শয়তান' দিয়ে। স্বল্প বাজেটের এই সিনেমা বিশ্বব্যাপী ২৫ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করেছিল।
এরপরে একে একে 'মুনজিয়া' এবং 'স্ত্রী ২'-তে এই সাফল্যের ধারা বজায় ছিল। শুধু তাই নয় ১০৩ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি আয় করে, 'স্ত্রী ২'-২০২৪ সালের সর্বাধিক উপার্জনকারী হিন্দি চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে।
কাল্পনিক শহর চান্দেরির পটভূমিতে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে রহস্যময় স্ত্রীকে [এক নারীকে] দেখানো হয়েছে। আগে সে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পুরুষদের লক্ষ্যবস্তূ বানাত, এখন সে মুক্তচিন্তার নারীদের অপহরণ করে এমন এক প্রেতের সঙ্গে লড়ছে।
টানা কয়েক মাস সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে চলেছে, যেখানে বলিউডের অন্যান্য বড় বাজেটের সিনেমাগুলো দর্শক অভাবে ধুঁকছিল।
বাণিজ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কোভিড -১৯ মহামারির পরে সিনেমাশিল্প মন্দার মধ্যে পড়েছে এবং বেশিরভাগ চলচ্চিত্র বক্স-অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
মজার বিষয় হলো এই হরর ফিল্মগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই সমালোচকদের কাছ থেকে ভালো রিভিউ পায়নি। এমনকি কিছু কিছু তো 'বাজে' গল্পের জন্য সমালোচনার মুখেও পড়েছে।
তবুও তাদের একের পর এক সাফল্য বলিউডকে নতুন জীবন দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
নতুন করে এই ঘরানার সিনেমার সাফল্যের মূল কারণ কী?
প্রবীণ চলচ্চিত্র সমালোচক মায়াঙ্ক শেখর বলেন, 'হরর-কমেডি সিনোমগুলো দর্শকদের সবচেয়ে সাধারণ অনুভূতি নিয়ে খেলে- এসব সিনেমা ভয় আর হাস্যরসের মিশেল ঘটিয়ে দর্শকদের বুঁদ করে রাখে।'
তিনি বলেন, 'এসব সিনেমা দেখার সময় আপনি হলের মধ্যে চিৎকার এবং হাসির শব্দ দুটোই শুনতে পাবেন। আর এই দুটোই সংক্রামক।'
এছাড়া, 'ভুল ভুলাইয়া ৩' এবং 'স্ত্রী ২'-এর মতো সিনেমাগুলো তাদের প্রিক্যুয়েলগুলোর সাফল্য থেকেও লাভবান হয়েছে।
শেখর আরও বলেন, মানুষ এই সিনেমাগুলোর প্রিক্যুয়েল দেখেছে, তাই শেষটা কী হবে তা জানার আগ্রহ থেকেই অনেক মানুষ এসব সিনেমা দেখতে আসে। তাই মূল সিনেমা সফল ও জনপ্রিয় হলে দর্শকরা তার সিক্যুয়েল দেখার জন্য মুখিয়ে থাকেন। সিনেমাটি নিয়ে সমালোচকদের মন্তব্য সেক্ষেত্রে দর্শকদের ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না।
সম্প্রতি এই দুটি চলচ্চিত্র দেখেছেন অপূর্ব নামের একজন রেডিও জকি।
তিনি বলেন, 'আমি মনে করি আমরা এসব সিনেমা দেখতে যাই কারণ মূল চলচ্চিত্রটি আমাদের পছন্দ হয়েছিল।'
বলিউডে একটি স্বতন্ত্র জনরা হিসেবে হররও বহু বছর ধরে নিজের ফর্মূলায় রূপান্তর ঘটিয়েছে।
লক্ষ্য করলে দেখা যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হরর সিনেমার উপস্থাপনা, কাহিনী এবং ভয় দেখানোর পদ্ধতিতে পরিবর্তন এসেছে।
আশির দশকের হরর সিনোমগুলো সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক দর্শকদের জন্য টার্গেট করে তৈরি করা হতো। এর বদলে আজকালকার হরর সিনেমাগুলো পারিবারের সব সদস্যকে নিয়ে দেখার মতো পরিবার-বান্ধব ঘরানায় পরিণত হয়েছে।
রামসে ব্রাদার্স ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে হিন্দি হরর সিনেমা জগতকে দাপটের সঙ্গে শাসন করেছেন। দো গজ জমিন কে নিচে (১৯৭২) এবং পুরানা মান্দির (১৯৮৪) এর মতো হিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন তারা। এসব সিনেমার ফর্মুলা ছিল একই- অতিরঞ্জিত ভৌতিকতা, ডাইনি, হিংস্রতা এবং সুড়সুড়িতে ভরা।
বাণিজ্য বিশ্লেষক তরণ আদর্শ এ বিষয়ে বলেন, 'চলচ্চিত্রগুলো লাভজনক ছিল, তবে বড় অভিনেতা এবং বৃহত্তর দর্শকদের আকর্ষণ করার মতো মৌলিকতা ও আবেদনের অভাব ছিল।'
দুই হাজারের দশকে প্রযোজক দুই ভাই মহেশ এবং মুকেশ ভাট, পরিচালক বিক্রম ভাটের সঙ্গে মিলে এই ঘরানার সিনেমার হাল ধরেন। তাদের 'রাজ' সিরিজ [প্রথম ছবি মুক্তি পায় ২০০২ সালে] দারুণ সফলতা পায়। এগুলো ছিল রামসে ব্রাদার্সের ফর্মুলারই আধুনিক রূপ, জনপ্রিয় গান এবং যৌন উত্তেজক দৃশ্যে ভরপুর।
তবে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া হরর সিনেমার দর্শক বরাবরই সীমিত।
২০০৭ সাল ছিল হরর সিনেমার জন্য টার্নিং পয়েন্ট। ওই বছর অক্ষয় কুমার এবং বিদ্যা বালান অভিনীত 'ভুল ভুলাইয়া' সিনেমা মুক্তির মধ্যদিয়ে হরর সিনেমার দর্শকরা ফের নড়েচড়ে বসেন।
১৯৯৩ সালের মালায়ালাম ব্লকবাস্টার 'মণিচিত্রতজু' অনুকরণে তৈরি চলচ্চিত্রটি হাস্যরস ও হররের একটি নিখুঁত মিশেল। সিনেমাটি খুব দ্রুত দর্শকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
এই সিনেমাটি ছিল পরিবার-বান্ধব ফর্মুলায় নির্মিত হরর, ফলে এই জনরাটি আগের চিরাচরিত দুর্নাম ঘুচিয়ে নতুন কাঠামোয় আত্মপ্রকাশ করে।
তবে ২০১৮ সালে 'স্ত্রী' সিনেমাটি মুক্তির মাধ্যমে এই জনরাটি আরও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। 'স্ত্রী' -তে সামাজিক থিম যেমন পিতৃতন্ত্র এবং নারীবাদী ধারণার সঙ্গে হররকে মিশিয়ে দেখানো হয়।
এরপর আসি 'ভুল ভুলাইয়া ২' ও 'ভুল ভুলাইয়া ৩'-এর কথায়।
এই সিনেমা দুটির পরিচালক আনিস বাজমি নিজেই বলেন, তার একটি বড় লক্ষ্য ছিল তার চলচ্চিত্রগুলো যেন শিশুদের জন্য উপভোগ্য হয় তা নিশ্চিত করা।
তিনি বিবিসিকে বলেন, 'আমি চাইছিলাম তারা যেন সিটে বসে টান টান উত্তেজনা অনুভব করে, কিন্তু কখনোই সত্যিকার অর্থে ভয় না পায়। যেন একটি রোলার কোস্টার রাইডে চড়ার মতো- উঁচুতে উঠতে আনন্দ, আর নীচে নামার সময় ভয়; একরকম রোমাঞ্চ অনুভব করে।'
এসব সিনেমায় শুধু ভয় আর হাস্যরস থাকে না আরও কিছু সাধারণ উপাদান থাকে। যেমন- এগুলো সাধারণত ছোট শহর বা গ্রামকে অবলম্বন করে নির্মাণ করা হয়। স্থানীয় লোককাহিনীর সঙ্গে ভালবাসা, সাহসিকতা এবং মন্দের উপরে সত্য ভালোবাসার জয়সহ সাধারণ বিষয়বস্তুর সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়।
'তুম্বাড়' সিনেমার কথাই ধরুন, এ যেন পৌরাণিক কাহিনী, হরর এবং নৈতিক অনুশাসনের এক সাহসী মিশেল।
এই সিনেমাটি ভিনায়ক নামক এক চরিত্রকে অবলম্বন করে নির্মিত, যে একটি অপদেবতার রক্ষিত সম্পদের সন্ধান পায় এবং সেগুলো নিজে পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু একসময় সে বুঝতে পারে, এই লোভ একটি মারাত্মক ফাঁদ ছাড়া আর কিছুই না।
২০১৮ সালে প্রথম মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রটি চলতি বছর আবার প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। সিনেমাটি এবার প্রথমবার মুক্তির সময়ের চেয়েও বেশি আয় করেছে।
আদর্শ বলেন, কোনো সন্দেহ নেই এই বছরে বক্স অফিসে হরর ফিল্মের 'পুনর্জন্ম' হয়েছে।
তবে অনেকেই এই ট্রেন্ডকে অতিরিক্ত সরলীকরণ করার ব্যাপারে সতর্ক করছেন। মানে হরর সিনেমামাত্রই এখন হিট হবে, এমনটা না ভাবা।
'মুনজিয়া' সিনেমার পরিচালক আদিত্য সারপোতদার বলেন, 'ভুল ভুলাইয়া' ছিল আমাদের প্রথম হরর-কমেডি সফলতা, এটি একটি সফল ফর্মুলা তৈরি করেছিল। কিন্তু পরবর্তী বড় হিট (স্ত্রী) আসতে দশকের বেশি সময় লেগেছিল।'
বাজমি বলেন, কোন ঘরানা সেটি মুখ্য নয়, বরং কাহিনীর গাঁথুনির ওপর নির্ভর করে কোনো সিনেমা জনপ্রিয় হওয়া না হওয়ার বিষয়টি।
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি