মাহসা আমিনির মৃত্যু: ইরানি নারীদের মুক্তির পথ কতদূর?
২২ বছর বয়সী কুর্দিস তরুণী মাহসা আমিনি গত ১৩ সেপ্টেম্বর তার ভাইয়ের সঙ্গে ইরানের কুর্দিস্তান থেকে রাজধানী তেহরান যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে আমিনিকে গ্রেপ্তার করে দেশটির নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশ। তার অপরাধ ছিল, ঠিকভাবে হিজাব না পরা; আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, চুল দেখা যাচ্ছিল তার।
আমিনি পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় ১৬ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে মারা যান। পরিবারের অভিযোগ পুলিশের নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে। ইরানি কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন আমিনি; এতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো দায় নেই।
এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর ঘটনায় ইরানের নারী ও সাধারণ মানুষ ফেটে পড়েছে ক্ষোভে। সারাদেশে ১০০টিরও বেশি শহরে চলছে বিক্ষোভ। নারীরা তাদের হিজাব পুড়িয়ে, চুল কেটে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। আন্দোলনে পুরুষদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ার মত।
বিক্ষোভ দমাতে দেশটির সরকার কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে; শুরু করেছে দমনপীড়ন। সবশেষ খবর অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সরকারি হিসেবে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটি আরও বেশি। সারাবিশ্বে এ ঘটনায় নিন্দার ঝড় শুরু হয়েছে। দেশটির রক্ষনশীল সরকার বিক্ষোভ দমনে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ বেশ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছে। দেশের কোথাও কোথাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট সংযোগও।
ইরানি কর্তৃপক্ষ ২০০৫ সালে 'গাশ্ত-ই এরশাদ' (নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশ) নামে পুলিশের একটি নতুন ইউনিট গঠন করে। গাশ্ত-ই এরশাদ নামের এই বিশেষ পুলিশ বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মানুষ যাতে ইসলামি আদর্শ ও নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করার; এবং কেউ 'অনৈতিক' পোশাক পরেছে বলে মনে হলে, তাকে গ্রেপ্তার করে সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানোর বা বিচারের আওতায় আনার।
ইরানে প্রচলিত শরিয়া আইন অনুযায়ী, নারীদের হিজাব পরা বা চাদর দিয়ে মাথা ঢাকা বাধ্যতামূলক। এছাড়াও নারীদের শরীর সম্পূর্ণ ঢেকে রাখতে পা পর্যন্ত লম্বা ও ঢিলা পোশাক পরার বিধান দেশটিতে রয়েছে। পোশাক ঠিকভাবে না পরার দোহায় দিয়ে নারীদের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ এই পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে কেবল এখনই নয়, এর আগেও অনেকবার উঠেছে।
২০১৪ সালে হিজাব যথাযথভাবে না পরায় ইরানে ৩৬ লাখ অভিযোগ জমা পড়ে। ২০১৭ সালে ৪২ বছর বয়সী নারী শাপারককে হিজাব না পরার অপরাধে ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ডসহ ২০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। পরে তিনি অবশ্য দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।
প্রতিবছর আমিনি বা শাপারকের মত নারীদের সঙ্গে এমন ঘটনা অহরহই ঘটে চলেছে ইরানে। আর এসব ঘটনাকে ইসলামের দোহায় দিয়ে সমর্থন দিচ্ছে সে দেশের কর্তৃপক্ষ।
অথচ ১৯৭৯ সালের আগে ইরানি নারীদের জীবন ছিল এখনকার চেয়ে সম্পূর্ণই আলাদা। তখন পশ্চিমা নারীদের মত ইচ্ছেমতো পোশাক পরা ও চলাফেরার স্বাধীনতা পেতেন নারীরা। আশির দশকের আগে ইরানের নারীরা শিক্ষা, কর্ম, খেলাধুলাসহ অনেক কিছুতেই পশ্চিমা নারীদের সমকক্ষ ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। ফুটবলসহ নানান খেলাধুলায় নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল।
আঁটসাঁট জিন্স, মিনি স্কার্ট, স্নান পোশাকসহ সবধরনের পোশাকে নারীদের দেখা পাওয়া যেত। তবে সে সময়ে যে হিজাব পরা হতো না এমনটিও নয়, বরং সে সময়ে অধিকাংশ নারী হিজাব পরতো। কিন্তু হিজাব পরা তখন বাধ্যতামূলক ছিলনা। জোর করে হিজাব পরানোর জন্য এমন নৈতিক পুলিশ ছিলনা দেশটিতে।
কে জিন্স পরবে আর কে হিজাব, সেটি ছিল একান্তই ব্যক্তি পছন্দের ব্যাপার। যার যেমন খুশি পোশাক পরার স্বাধীনতা ছিল তখন।
১৯৩৬ সালে তৎকালীন পাহলভি সরকার হিজাব নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এটি নিয়েও সেকালে বিক্ষোভ হয়েছিল ইরানে। বলা হয়েছিল, এটা নারী স্বাধীনতার হস্তক্ষেপ। কারণ যারা নিয়মিত হিজাব পরেন, তারা হঠাৎ করেই হিজাব ছাড়া বাইরে আসতে স্বস্তি বোধ করবেন না। সুতরাং, এটি ধর্মীয় স্বাধীনতার লঙ্ঘন।
১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর নারীদের জীবন যাপনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। যারা ঠিকমতো হিজাব পরতেন না বা ইরানে প্রচলিত ইসলামি রীতি মেনে পোশাক পরিচ্ছদ করতেন না, তাদের প্রতি কঠোর হতে শুরু করে ইরানের কর্তৃপক্ষ। এই বিপ্লবের একটি বড় লক্ষ্যই ছিল নারীদের খোলামেলা সাজগোছ ও পোশাক পরিচ্ছদ বন্ধ করা।
১৯৭৯ সালের ৭ মার্চ বিপ্লবী নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনি নারীর পোশক সংক্রান্ত এক ডিক্রি বা নির্দেশনা জারি করেন। ডিক্রিতে বলা হয়, নারীদের কর্মক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক হিজাব পরতে হবে এবং নারীরা মাথা না ঢাকলে, তা অশ্লীলতা হিসেবে গণ্য হবে। এ সময় নারী-পুরুষরা উপহারের মোড়কে মুড়ে রাস্তায় রাস্তায় হিজাব বিলি করতে শুরু করে।
তবে খামেনির ভাষণের পরদিন ছিল ৮ মার্চের আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এদিন হিজাব পরা বাধ্যতামূলক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে এক লাখ নারী-পুরুষ এক হয়ে ইরানে বিক্ষোভ করে।
১৯৭৯ সালের পর শুধু নারীদের পোশাকের ওপরেই নিয়ন্ত্রণ চাপানো হয়নি; নিয়ন্ত্রণ আরোপ হয় তাদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে, খেলাধুলায়, রাজনীতিতে, কর্মক্ষেত্রে, এমন কি ব্যক্তিগত ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়। পশ্চিমাপন্থী রেজা শাহ পাহলভির শাসনামলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য।
বিপ্লবী সরকারের আমলে নারীদের বর্তমান রাজনীতিতে অংশগ্রহণ তেমন দেখা যায় না। ২০০৮ সাল পর্যন্ত নারীরা স্টেডিয়ামে গিয়ে পুরুষ দলের ফুটবল খেলা দেখতে পারতেন না। এটি আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এমনটি নয়; তবে তাদেরকে স্টেডিয়ামে ঢুকতে দেওয়া হতো না। এমন নানান ক্ষেত্রে ইরানের নারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে।
ইরানের ইসলামিক কোডের প্রাদেশিক অনুচ্ছেদ ৬৩৮ অনুযায়ী 'মহিলারা যদি জনসম্মুখে বা রাস্তায় হিজাব পরিধান না করে, তবে তার শাস্তি হিসেবে তাদের ২ দিন থেকে ১০ মাস পর্যন্ত কারাভোগ অথবা ৫০,০০০ থেকে ১০ লাখ রিয়াল পর্যন্ত জরিমানা পরিশোধ করতে হবে'।
বিপ্লব পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে নারীরা তাদের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে অনেকবার বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবার তাদেরকে দমন করা হয়েছে। এর আগে, সর্বশেষ ২০১৯ সালের হিজাব বিরোধী বিক্ষোভ দমন-পীড়নের মাধ্যমে সামাল দেওয়া হয়।
তবে বর্তমান অনলাইনের যুগে ইরানের নারীরা তাদের অধিকার আদায়ে অনেক বেশি সচেতন ও সংগঠিত। নারী অধিকার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে নারীদের সচেতন করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রবাসী ইরানি নারীরা এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি কাজ করছেন।
'মাই স্টেলথি ফ্রিডম'-এর মতো বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে লাখ লাখ ইরানি নারী নিজেদের দুঃখ দুর্দশা ও অধিকার আদায়ের কথা বলছেন। আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে এবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থারত প্রবাসী ইরানি নারীরাও যোগ দিয়েছেন হিজাব বিরোধী এই প্রবল আন্দোলনে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো ইরানের সরকারকে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করেছে। জাতিসংঘ নিরপেক্ষ তদন্তের আহবান জানিয়েছে। তবে এই আহ্বান কতোটা কাজে দেবে সে এক প্রশ্ন! বিশ্বের কোথাও কিছু হলে সবচেয়ে শক্তিধর এই সংগঠনকে কেবল 'সুষ্ঠু তদন্তের আহ্বান', 'তীব্র নিন্দা জানানো', 'বিচারের আহ্বান'- ইত্যাদি জানানো ছাড়া আর তেমন কিছুই করতে দেখা যায় না। যেনো এতটুকুতেই দায়িত্ব সীমাবদ্ধ এই সংগঠনের।
অন্যদিকে, বাইডেন প্রশাসন ইতোমধ্যে ইরানের নৈতিক পুলিশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সারাবিশ্বের অধিকার কর্মীরা ইরানের নারীদের অধিকার আদায়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে সংহতি প্রকাশ করছে।
তবে নানান অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ইরান যদি এখন বিক্ষোভকারীদের আন্দোলন নস্যাৎ করতে দমন-পীড়নের রাস্তায় হাঁটে, তাহলে তাদের ওপর আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞার খড়গ নেমে আসতে পারে। এ ব্যাপারে হয়তো কিছুটা হলেও ভাববে ইরান সরকার।
কিন্তু ভাবলেও নারীদের প্রতি অবিচারের ক্ষেত্রে পরিবর্তন কতোটা আসবে সেটিই এখন বড় সংশয়। মুক্তির জন্য ইরানের নারীদের কতটা পথ পেরোতে হবে, তা বলতে গেলে এখনও অজানা।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।