বাজেটে কৃষি: কোম্পানি আছে, কিন্তু কৃষক নেই
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের খসড়া বাজেট ঘোষিত হয়েছে গত ১ জুন তারিখে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে দেখা যায়নি বলে আমরা অনেকে চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু, অর্থমন্ত্রী হিসেবে বাজেট ঘোষণা তিনি নিজেই তো দিয়েছেন। এবার বাজেটের পর যেসব প্রতিক্রিয়া এসেছে, তার মধ্যে বেশি করারোপের ওপরই হয়েছে; কিংবা বলা যায় ম্যাক্রো-ইকোনোমিক বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা মাথা ঘামিয়েছেন। সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
আমি কৃষি খাতের বাজেট নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম না, কারণ কৃষি বাজেট থেকে ক্রমশ কৃষক হারিয়ে যাচ্ছে। এই লক্ষণ বিগত কয়েকটি বাজেট থেকেই পাচ্ছিলাম। এবার কৃষি, খাদ্য এবং মৎস ও প্রাণিসম্পদ খাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৫,৩৭৪ কোটি টাকা; যা গত বছরের তুলনায় ১,৬৭৬ কোটি টাকা বেশি। এই বরাদ্দ মোট বাজেটের ৪.৬৪ শতাংশ। গত বছরের তুলনায় বাজেট ২০২৩-২৪ অর্থবছরে টাকার অংকে বাড়লেও এই খাতে বরাদ্দ কমেছে ০.৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ, বাজেটের আকার বেড়ে যাওয়া বা কিছু বরাদ্দও বেড়ে গেলেই প্রমাণ হয় না- যে কৃষির গুরুত্ব বেড়েছে। আবার কৃষি খাত থাকলেই কৃষকের জন্যে বরাদ্দ থাকবে, এমন কোন কথাও নেই। যা এই বাজেট দেখলেই বোঝা যায়।
বাজেট বক্তৃতার ৫৬ পৃষ্ঠা (বা ৮৪ অনুচ্ছেদ) এর শিরোনাম হচ্ছে কৃষিখাত উন্নয়ন ও খাদ্য নিরাপত্তা। কৃষিখাতকেও দেখা হচ্ছে, নির্দিষ্ট কিছু খাদ্য পণ্য (ফসল, মাছ, মাংস) এবং অর্থকরী ও রপ্তানীমুখী পণ্য উৎপাদনের একটি খাত হিসেবে। এর সাথে কোটি কোটি কৃষকের জীবন-জীবিকার সম্পর্ক, পরিবেশের সাথে সম্পর্ক এসব কিছুই যেন অবান্তর।
প্রথমেই কৃষির সাফল্য দেখাতে গিয়ে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশ সবজি, মাছ ইত্যাদি উৎপাদনে বিশ্বে অনেক ভাল অবস্থানে আছে। তার সাথে বর্ণনা করা হয়েছে "ছাগলের মাংস" উৎপাদন করে বাংলাদেশ বিশ্বে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। বিষয়টি এজন্য নজরে আনছি, যে ছাগল পালন গ্রামের দরিদ্র নারীদের জীবিকার একটি বড় অবলম্বন, সেই ছাগলের মাংসই সারা দেশে খাসির মাংস হয়ে বিক্রি হয়, ছাগলের চামড়া রপ্তানি হয়, কিন্তু ছাগলের মাংস আলাদাভাবে কি করে উৎপাদন করা হয়– সেটা জানার একটু চেষ্টা করছি। কারণ এই বিষয়টা ইন্ডাস্ট্রিয়াল পদ্ধতি ছাড়া সম্ভব নয়। খোঁজ নিয়েই জানা গেল, এগুলোকে বাণিজ্যিক মাংস উৎপাদনের ছাগলই বলা হয় এবং তাদের জন্য বিশেষ জাত রয়েছে, চারণভুমিতে খাওয়ানো ছাড়াও রয়েছে খাদ্য হিসেবে রয়েছে বিশেষ ভিটামিনযুক্ত খাবার। দেশীয় জাতের ছাগলের মাংস ভাল হলেও, তা ধীরে ধীরে বাড়ে বলে তারা বাণিজ্যিক হওয়ার যোগ্যতা হারায়। বলাবাহুল্য বাণিজ্যিক মাংস ছাগল বিশেষ খামারে হয় এবং একমাত্র যে সকল ছাগল থেকে অধিক ওজনের মাংস হয় সেগুলোই বাণিজ্যিক ছাগল পালনের উপযোগী। বাণিজ্য মানেই তো তাই।
উৎপাদন বেশি করে আয় বেশি করতে হবে। তো এখানেও কৃষক পরিবারের বা গরিব মহিলাদের ছাগলের কোন স্থান নেই। তাদের শরীরে প্রাকৃতিকভাবে মাংস গড়ে ওঠে, তাই সেটা নিয়ে বাণিজ্য হয় না।
কৃষি উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি শিরোনামে যে অনুচ্ছেদটি রয়েছে, তার মধ্যে চারটি কার্যক্রম আছে যা সরাসরি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করবে, কৃষকের নয়। ১. কৃষকদের সাশ্রয়ী মূল্যে সার সরবরাহে ভর্তুকি; ২. সেচ কাজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলের ২০ শতাংশ রেয়াত; ৩. কৃষি যান্ত্রিকীকরণের হাওড় ও উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ ও অন্যান্য এলাকায় ৫০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তায় ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষি যন্ত্র সরবরাহের কার্যক্রম; ৪. বোরো মৌসুমে দীর্ঘ জীবনকালীন ধানের পরিবর্তে স্বল্প জীবনকালীন ধানের আবাদ।
এই কার্যক্রমগুলোর মধ্যে কৃষক কোথায়? আমরা বহুদিন ধরেই দেখছি, বাজেটে সার-কীটনাশকের ভর্তুকি দেয়ার রেওয়াজ রয়েছে। এবং আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও বাজেটে যখন কৃষকদের জন্য বরাদ্দ দাবী করে, তখন সার-কীটনাশকের কথা বলেন। এই প্রশ্ন তোলা হয় না, যে এই ভর্তুকি কি কৃষক পায় নাকি সার-কীটনাশকের ব্যবসায়ীরা পায়? কৃষক সাশ্রয়ী মূল্যে যা পাচ্ছে, সেই ভর্তুকি ব্যবসায়ীদেরকেই দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, ব্যবসায়ীদের ব্যবসার কোন ক্ষতি হচ্ছে না । অথচ ব্যবসায়ী কিন্তু তার ইচ্ছেমতো সারের দাম কম-বেশি করলেও দেখার কেউ নেই। বিগত কয়েক অর্থবছরের বাজেটে সারের ওপর ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে। এ অর্থবছরে সারের ওপর ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে ১৬,০০০ কোটি টাকা থেকে ২৪,০০০ কোটি টাকা। এবার ভর্তুকির একটি বড় অংশই যাচ্ছে সারের জন্যে।
সেচ কাজে বিদ্যুতের রেয়াত কে পাচ্ছে? নিশ্চয়ই কৃষক নয়। আমরা জানি সেচের জন্যে যে ডিপ টিউবওয়েল বা শ্যালো টিউবওয়েল ব্যবহার হয়; তা সাধারণ কৃষকদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না এবং যারা এর মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় থাকে তারা নিঃসন্দেহে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী। তারা পানির দাম নিয়ে কৃষককে পানি দেয়। আমরা দেখেছি সেচের পানির দাম বাড়িয়ে দিয়ে এবং টাকা দেয়ার পরও পানি দিতে গড়িমসির করার কারণে কৃষক আত্মহত্যাও করেছে। সেচের এই রেয়াত দেয়া কৃষকের উপকারে আসবে কিনা- সেটা দেখার বিষয়। কৃষককে সহায়তা করতে হলে সেচ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে, যেন পাম্পের মালিক ভূগর্ভস্থ পানির মালিক হয়ে না বসে।
এই বাজেটে সবচেয়ে ভীতিকর এবং কৃষক-বিরোধী কার্যক্রম হচ্ছে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ । কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য হাওর ও উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য এলাকায় ৫০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তায় প্রায় ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হবে। এই যন্ত্রপাতির সাথে কৃষি পদ্ধতিরও পরিবর্তন ঘটানো হচ্ছে। বাজেট বক্তৃতায় বলা হয়েছে "কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুবিধা ব্যবহার করে একসাথে ধানের চারা তৈরি, রোপন ও কর্তনের জন্যে সমলয়ে চাষাবাদ পদ্ধতি Synchronised cultivation প্রবর্তন করা হয়েছে। ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদনে (২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১) জানা যায়, এই পদ্ধতি ২০২১ সাল থেকেই দেশের ৬১টি জেলায় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের একটি বিশেষ প্রণোদনা কর্মসূচি হিসেবে চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে বোরো ধানের হাইব্রিড জাতের বীজ, সার, রোপণের ব্যবস্থা করা হয়। এই ব্যবস্থায় কোম্পানির যন্ত্র বিক্রি হবে, এমনকি এই যন্ত্রের প্রয়োজনে একটি বড় ব্লক জমিতে ধানের চারা রোপণ করতে হবে।
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ২০২১ সালে টাঙ্গাইলে ৫০ একর জমির একটি ব্লকে এই যান্ত্রিক পদ্ধতির উদ্বোধন করেন। তা ৫০ একর জমির মালিক কোন একজন কৃষক নিশ্চয়ই নন। এটা কোন জোতদারের জমিতে করা হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। বাংলাদেশে ৮০ শতাংশেরও বেশি কৃষকদের এক একরের কম জমি আছে। তাহলে ৫০ জন কৃষকের জমি নিয়ে এই 'সিনক্রোনাইজ' করা হবে? এর জন্যে আমাদের কোন আইনী, সামাজিক ব্যবস্থার দরকার নাই? এই পদ্ধতি মনে হচ্ছে, শুধু বোরো মৌসুমের জন্যে। বাকী মৌসুমে কি হবে? কৃষি শ্রমিকদের কি হবে? বোরো ধানের স্থানীয় জাত বাদ দিয়ে স্বল্প জীবনকালীন ধানের আবাদ করা হবে। এই প্রকল্পের জন্যে ৩,০২০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল ২০২১ সালে, এবং ২৭৪টি কৃষি ইঞ্জিনিয়ারের পদ তৈরি করা হয়েছে! প্রশ্ন আবারো, কৃষক কোথায়?
কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নিয়ে সরকার খুব জোরেশোরেই নেমেছে ২০২১ সাল থেকে। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (৬ নভেম্বর, ২০২১) আরো বিস্তারিতভাবে লিখেছে। জানা যায়, কোম্পানিগুলোর ধারণা, বাংলাদেশে কৃষি যন্ত্রের বর্তমান বাজার ৩,০০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৩০,০০০ কোটি টাকা হবে, অর্থাৎ ১০ গুণ বাড়বে বলে ধারণা করছে। তাই তারা কৃষকদের ঋণ দেয়ার জন্যেও প্রস্তাব করছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ কি শুধু কিছু যন্ত্রের আমদানি ও উৎপাদনের বিষয়? এর সাথে পুরো কৃষি ব্যবস্থা জড়িত, অথচ সেদিকে কোন নজর নেই। প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময় কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের সাথে গিয়েছেন কৃষিযন্ত্র কোম্পানির প্রতিনিধি।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের উৎপাদন ও ফসল বিক্রির সমস্যা, ন্যায্য মূল্য পাওয়া, ফসল সংরক্ষণ করার সমস্যা সমাধান করুন। বাজেটে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার কোন প্রতিফলন নেই। আধুনিক কৃষির ভয়াবহ নেতিবাচক অভিজ্ঞতার পর– যান্ত্রিক কৃষির প্রকল্প আমাদের শঙ্কিত করছে। কৃষকদের স্থানীয় বীজ, কৃষকের জ্ঞান, ফসলের ন্যায্য মূল্য ও সুস্থ পরিবেশের নিশ্চয়তা দিলে– এ দেশের মানুষের খাদ্য জোগান দিতে পারবে।
আসুন আমরা কৃষকের পাশে দাঁড়াই, কৃষকরাই আমাদের খাদ্য জোগাবে।
- লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী