‘গাজার মৃত শিশুদের চোখে না দেখতে পেলে, আদৌ কি আর কোনো শিশুর দিকে তাকাতে পারব?’
শিশুতে শিশুতে কি কোনো তফাত আছে? জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরে নিহত হওয়া শিশুদের ছবি কি বি'আরি-তে নিহত হওয়া শিশুদের ছবির চেয়ে কম ধাক্কা দেওয়া উচিত আমাদের? জাবালিয়ার মৃত শিশুদের ছবি দেখে কি আমাদের মন কাঁদা উচিত? আর ওদের ছবি দেখে মন কাঁদাটা কি ন্যায্য?
নিজের সন্তান আমাদের কাছে পৃথিবীর আর যেকোনোকিছুর চাইতে প্রিয়। আর ইসরায়েলি মৃত শিশু দেখে ইসরায়েলিরা শোকের ভারে যতটা নুয়ে পড়ে, আর কোনো মৃত শিশু দেখলে তারা অতটা দুঃখ পায় না। এটাই মানবচরিত্র, বড় দুর্বোধ্য।
কিন্তু স্রেফ আমাদের শিশুরা নিহত হয়েছে বলেই যে গাজার শিশুদের গণহত্যায় আমরা শোকে জর্জর হব না, তা তো হতে পারে না।
এই বাচ্চারা কারা এবং তাদের ওপর এই বিপর্যয় কারা ডেকে এনেছে (উত্তর: ইসরায়েল ও হামাস), সে কথা মনে করলেই গাজার হত্যাকাণ্ড আমাদের বুকের ওপর পাষাণভার হয়ে চেপে বসবে। কেমন ছিল তাদের জীবন ও মৃত্যু? (উত্তর: এই শিশুরা বেড়ে উঠেছে দারিদ্র্য, যাতনা, অবরোধের মাঝে, ওদের ছিল না কোনো বর্তমান-ভবিষ্যৎ—আর ওদের এত যাতনার সবচেয়ে বড় কারণ ইসরায়েল।)
একজন বিখ্যাত বামপন্থি লিখেছেন: 'যুদ্ধের ময়দানে আমি দুই পক্ষের প্রতি সমান সহানুভূতি দেখাতে পারি না। হয়তো ইউক্রেনে পারি, কিন্তু এখানে নয়। গিদিয়ন লেভি একটি পুড়ে যাওয়া শিশুর কথা বলেছেন, আমি দেখেছি নির ওজ-এর সেই শিশুকে।'
নির ওজের ওই শিশুকে হামাস অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতায় হত্যা করেছে। আর ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জাবালিয়ায় কোনো নির্দিষ্ট কারণ বা ঘৃণা ছাড়াই শিশুদের হত্যা করছে। তারা ভীতিকর সংখ্যক শিশু হত্যা করেছে।
তাহলে নির ওজের শিশুকেই কি দেখা যায় আর জাবালিয়ার শিশুরা কি অদৃশ্য? ওরা কি শিশু নয়? নজিরবিহীন শিশুহত্যা করা হয়েছে গাজায়—শনিবার পর্যন্ত সেখানে ৩ হাজার ৯০০ শিশু নিহত হয়েছে।
গাজার সাপ্তাহিক ছুটির দিনটা ছিল রক্তস্নাত। সেদিনের যেসব ভিডিও প্রকাশ্যে এসেছে, সেগুলো দেখে গা শিউরে উঠেছে। দুটি সাদা প্লাস্টিকের ব্যাগে ক্ষতবিক্ষত আটটি শিশুর মরদেহ, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রয়েছে। প্রতি ব্যাগে চারটি করে শিশু। ব্যাগগুলোর গন্তব্য গণকবর। ওরা গাজার শিশু। ওদের হত্যা করা হয়েছে। এটা যুদ্ধ, কিন্তু যুদ্ধেও কিছু সীমা বেঁধে দেওয়া প্রয়োজন।
আরেকটি ভিডিওতে একটি ধ্বংসস্তূপের পাশে পড়ে থাকতে দেখা গেছে কয়েক ডজন মরদেহ। অধিকাংশ মৃতদেহই শিশুদের। ওদের পাশে বুকফাটা আর্তনাদ করছে প্রিয়জনরা।
গাজার হাসপাতালগুলোতে অনবরত বোমাবৃষ্টি চলছে। শনিবারে বোমা ফেলা আল-নাসের শিশু হাসপাতালে, যেখানে ক্যানসারে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। পাঁচজন নিহত হয় ওই হামলায়। হাসপাতালে ভর্তি শিশুদের আতঙ্ক কল্পনা করা মোটেও কঠিন নয়। এই হাসপাতালটিও খালি করে দিতে হয়—যেন খালি করার বন্দোবস্ত ও জায়গা তৈরিই ছিল!
আহত গাজাবাসীদের নিয়ে রাফা ক্রসিংয়ের দিকে যাওয়ার সময় একটি অ্যাম্বুলেন্সেও বোমা ফেলেছে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী। এতে নিহত হয়েছে ১৫ জন, আহত হয়েছে ৬০ জন। যদিও দাবি করেছে, কাজটি করেছে সন্ত্রাসীরা।
ইসরায়েলের নির্দেশে উপকূলীয় সড়ক দিয়ে দক্ষিণ গাজায় পালানোর চেষ্টা করছিল সাধারণ মানুষ। ওই সড়কে পড়ে থাকতে দেখা গেছে অজস্র মৃতদেহ। ওই মৃতদেহগুলোর মধ্যে ছিল অনেক শিশুও। গাজায় ফেলা প্রতিটা বোমা শিশু হত্যা করে।
এসবের কোনোকিছুতেই কোনো ইসরায়েলির মন কাঁদার কথা নয়, কারণ ইসরায়েল এখন তাদের নিহত হওয়া নাগরিকদের নিয়ে শোক করছে! শুধু তা-ই নয়, এসব দেখে শোকার্ত হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেউ গাজার মৃত শিশুদের দেখে ধাক্কা খেলে তাকে অপরাধী গণ্য করা হচ্ছে। যারা শোক প্রকাশ করছে, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, বিশেষ করে আরব নাগরিকদের। গাজার গণহত্যা দেখে ইসরায়েলে কিছুতেই শোকার্ত হওয়া যাবে না। এমনকি সন্দেহাতীতভাবে নিরপরাধ, নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা দেখেও মন কাঁদা চলবে না এখানে। গাজার শিশুদের মৃত্যুর প্রতিবাদ করা ইসরায়েলে জঘন্য বিশ্বাসঘাতকতা। ওরা গাজার শিশু, ইসরায়েলে ওরা 'শিশু-নয়', ঠিক যেমন ওদের বাবা-মায়েরা মানুষ নয় অর্থাৎ 'অ-মানব'। আমাদের ইসরায়েলের শিশুরা বেশি নিষ্ঠুরভাবে নিহত হয়েছে।
শুক্রবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে বের করা গাজার শিশুদের মরদেহ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তখন তিনি প্রথমে বলেন ইসরায়েলি শিশুর কথা যার বাবা নিহত হয়েছে—এবং তার হত্যাকারীরা ক্রন্দনরত অনাথদের সামনে ফ্রিজ খুলে খাবার বের করে খেয়েছে। এরপর তিনি আসেন গাজায় নিহত হওয়া শিশুদের প্রসঙ্গে: 'ওদের চোখের দিকে যখন তাকাই, আমার নিজের সন্তানদের দেখি। ধাক্কা না খেয়ে কীভাবে থাকতে পারি?'
আর আমরা ইসরায়েলিরা যখন গাজার মৃত শিশুদের চোখের দিকে তাকাই, তখন আমাদের নিজেদের সন্তানকে দেখি না। ওদের চোখের দিকে তাকিয়ে আদৌ কোনো শিশুকে দেখি কি না, তা নিয়েই সন্দেহ আছে।