তুমি তো সেই গেলেই চলে: রশিদ খানের প্রয়াণে স্মৃতিতর্পণ
১৯৯১ সালের জানুয়ারি মাসে রবীন্দ্রসদনে ২৩ বছরের রশিদ খানের গান শুনেছিলাম প্রথম। পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল তরুণ শিল্পীদের নিয়ে। সে অনুষ্ঠানে ছিলেন রশিদ খান, স্লাইড গিটারে দেবাশিস ভট্টাচার্য (তাঁর কাছেই তখন আমি শিখছি), সরোদে তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, সন্তুরে তরুণ ভট্টাচার্য, মণিপুরিতে শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায় (পরে বিশ্বভারতীতে কাজ করতে গিয়ে তাঁর আংশিক সহকর্মী হয়েছিলাম) এবং প্রীতি পটেল, যাঁরা পরবর্তীকালে সকলেই শিল্পী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। তখন আমি ১৭, রশিদ ২৩ — ছয় বছরের তফাত আমাদের বয়সের, সময়ের হিসেবে আমরা সমসাময়িক। রশিদ খানকে আমরা একেবারে আমাদের সময়ে পরিণত হতে দেখেছি। রোগা, কালো, কিন্তু চোখ দুটো উজ্জ্বল। উজ্জ্বল চোখে একটা ভাসাভাসা ব্যাপার ছিল — যেটা বছর দুয়েক আগে যখন শেষবার দেখি তখনও দেখেছি।
আজ প্রায় তেত্তিরিশ বছর পরেও রশিদ খান নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রথম গান শোনার স্মৃতিটাই ফিরে আসে। সেদিনের অপরিণত রশিদের গানে যে ভবিষ্যৎ শিল্পীর আভাস পাওয়া গিয়েছিল, সেই টানেই বার বার ওঁর গান শুনতে ছুটে গিয়েছি। যদিও সেই ভালোলাগার আবেশ বিগত কয়েক বছরে কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে নানা কারণে। কিন্তু আজও রশিদ খান নামটার সঙ্গে ভালোলাগা, ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। আজও ওঁর আগের রেকর্ডিংগুলো শুনলে সেই দ্যুতির ঝলক কান এড়িয়ে যায় না। অমন অনায়াস সোজা ভঙ্গি, মিঠে আওয়াজের আয়োজন মনে হয় না ওঁর সময়ের আর কারও আছে। 'প্রতিভা' শব্দটা আমার নিজের কাছে মনে হয় অর্থহীন শব্দ — কে প্রতিভাবান নয়, আর কে হয় — সে নিয়ে মুনি, ঋষি এবং আমাদের মতো অপোগণ্ডরা কেউই ঐকমত্যে পৌঁছাবে বলে মনে হয় না। কিন্ত রশিদের গান আমাদের হৃদয়কে, মনকে ভরে রেখেছিল বেশ কয়েক বছর। আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম আমাদের গানের দৈন্য বুঝি ঘুচল। যেখানে যখন সুযোগ হয়েছে ওঁর গান শুনতে গিয়েছি।
২০০২ সালে আমরা মহীশূরে। আমাদের বন্ধু বাঁশিওয়ালা রবিশংকর মিশ্র [সত্যি অর্থেই সে বাঁশিওয়ালা — নিজে সে একজন উঁচুমানের বাঁশি বাজিয়ে, সেই সঙ্গে ভারতের একজন সর্বাগ্রগণ্য বাঁশি প্রস্তুতকারক। গতকালই (৮ জানুয়ারি) কলকাতায় বাঁশুরিয়া দেবেন্দ্র মুর্ডেশ্বরের স্মৃতিতে সে অনুষ্ঠান করে গেছে ভবানীপুর সংগীত সম্মিলনীতে] খবর দিলো স্পিকম্যাকের উদ্যোগে রশিদ গাইবেন মহীশূরের একটি কলেজে। সে সময় মহীশূরে স্পিকম্যাকে খুবই সক্রিয় ছিল — তাদের বদান্যতায় ওখানে সে সময় কার না গান-বাজনা শুনেছি! বসুন্ধরা ডোরাইস্বামী, দিনকর কাইকিনী, ব্রিজভূষণ কাবরা, এস সি আর ভাট, পরভিন সুলতানা, কে জে জেসুদাস, কুন্নাকুড়ি বৈদ্যনাথন, লালগুড়ি জয়রামন, নিত্যানন্দ হলদিপুর, রাজন-সাজন মিশ্র... কত নাম আর বলব! সেদিনের অনুষ্ঠানে রাগ যোগ গেয়েছিলেন রশিদ। যোগের সঙ্গে বৃষ্টির যোগ আছে কি না জানি না — কিন্তু গান চলতে চলতেই অঝোর ধারে বৃষ্টি শুরু হলো। গানের আওয়াজ ছাপিয়ে যাওয়ার মতো বৃষ্টি। সেদিন গানের সঙ্গে সে বৃষ্টির যুগলবন্দি আমাদের ভিজিয়েছিল, আজ ওঁর চলে যাওয়ার দিনে সেদিনের সেই আনন্দের ভিজে ভাবটা আবার ফিরে এল বিষাদ হয়ে।
জানি তো চলে যাওয়াটা কোনো বিশেষ ঘটনা নয় — যেকোনো সময় যে কেউ চলে যেতে পারে, পরে এসে আগে চলে যাওয়ার আক্ষেপ তো শতক পেরোনো সুভাষ মুখুজ্জে কবেই করে গেছেন। কিন্তু কিছু কিছু যাওয়া আমাদের কিছু স্মৃতি এবং সময়কে নিয়ে চলে যায়। রশিদের চলে যাওয়া আমাদের কিছুটা সময়ের চলে যাওয়া যেন। রামপুর-সহসৱান ঘরের তাঁর সময়ের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি হিসাবে নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একসময়ে ভৈরবীতে একটা ঠুমরি গাইতেন প্রায়ই — 'আজ রাধা ব্রিজ কি চলি'! সে ঠুমরির ঠমক চমক আমাদের হৃদয়ে রাধার অভিসারের অভীপ্সা জাগাত। আমরা কম বয়সে যখন গান শুনতে শুরু করি তখন ওঁর গানে কোনো ক্লাসিসিজ়মের খোঁজ করিনি — বিশুদ্ধ সুরের অমন ঢেউ আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত। ওরকম ভরাট পুরুষালি বলিষ্ঠ কণ্ঠের প্রেমে আমরা মজে গিয়েছিলাম — সুরের ওরকম ভরভরন্ত টইটম্বুর ভাব ওঁর সম্পদ।
অহেতুক পণ্ডিতি ওঁর গানে কখনোই শুনিনি, এমনকি রবীন্দ্রসংগীত যখন গেয়েছেন তখনও কোনোরকম বাড়াবাড়ি শুনিনি (যে পরিমিতির অভাব অনেক রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীর গানেও আজকাল শোনা যায়)। কিছুদিন আগে ঘরে বসে গাওয়া 'মেরে ন্যায়না সাৱন ভাদো' শুনেছিলাম — কী নিষ্ঠায়, কী আবেগ দিয়ে সেই গান গেয়েছেন! অনেক ক্লাসিক্যাল শিল্পীর যেমন একটা 'সব জানি' ভাব থাকে পরিবেশনের সময়, বিশেষ করে 'লাইট' গান গাওয়ার সময়, সেরকম অ্যাটিটিউড ওঁর গায়কিতে ছিল না, বা আমার চোখে পড়েনি। আপাত ঝকঝকে সফল গায়কের মধ্যে একজন সহজ, অনাড়ম্বর মানুষকে উঁকি দিতে দেখেছি অনেক সময়ই। আমার প্রিয় রশিদ খান সোহিনীর, ঝিঁঝিটের (সাগরিকা থেকে বেরোনো ঝিঁঝিটের তারানা রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল আমাদের), শিবরঞ্জনীর, শ্যাম-কল্যাণের, যোগের, মিঞাঁ কি টোড়ির। এক-একটা ক্যাসেট বেরোতো আর সেগুলো বুঁদ হয়ে শোনা দিনের পরে রাতে, আবার রাতের পরে দিনে — এভাবেই রশিদ আমাদের দখল করে নিয়েছিলেন। একথা বললে অতিকথন হবে না যে, রশিদ বাংলার শ্রেষ্ঠতম সংগীতমানব অন্তত গত অর্ধ শতকে; আর কেউ ওঁর সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারেনি, পারাটা কঠিন। গান ওঁর মধ্যে সহজ ভাবে অনায়াসে এসেছিল, ওস্তাদি বা কালোয়াতির ডনবৈঠক ওঁকে দিতে হয়নি বা সেভাবে নিজেকে প্রমাণ করার দরকার হয়নি।
মনে পড়ছে ২০০৭-এর জানুয়ারি মাসে কলকাতার সিগাল প্রকাশনা সংস্থা নিজেদের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আয়োজন করেছিল সারা রাত্রিব্যাপী সংগীতানুষ্ঠানের। সেসময়ের দুজন আপাতনবীন শিল্পী আমাদের সেই রাত অধিকার করেছিলেন। প্রথমে রশিদ খান — তিনি তখন ৩৯ বছরের যুবক। মাথার চুল কাঁচাপাকা, পরনে সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা। শুরু করলেন দরবারি কানাড়া। রাত বারোটায় শুরু হয়েছিল অনুষ্ঠান। ঘণ্টা আড়াইয়েকের সে অনুষ্ঠানে দরবারির যে মহাকাব্যিক বিস্তার তিনি ঘটিয়েছিলেন সেরকম অভিজ্ঞতা জীবনে খুব বেশি ঘটে না। ইংরেজি সাবলাইম (sublime) শব্দটি এক্ষেত্রে আমাদের অর্থবোধে সহায়ক হতে পারে। দরবারির ওরকম ধীর, গভীর, অতলান্ত রূপ শুনতে পাওয়া সারা জীবনের এক অনন্য সঞ্চয় হয়ে থাকে।
নিখুঁত স্বরক্ষেপণ, লম্বা দম, অসামান্য তৈয়ারি আর পরিমিতিবোধ; এসবের মিশ্রণে রশিদ ভারতীয় সংগীতের এ যুগের শ্রেষ্ঠতম পারফর্মার। কেউ কেউ নানা সময়ে অভিযোগ করেছেন ওঁর রাগরূপায়ণের সীমাবদ্ধতা নিয়ে। মনে পড়ে গত শতকে কিরানা ঘরানার প্রবাদপুরুষ আবদুল করিম খাঁ সম্বন্ধে রবিশঙ্করের মূল্যায়ন — আবদুল করিমের গানে যেন শতাব্দীর কান্না জমা হয়েছিল। রশিদের গান সম্পর্কে বলতে ইচ্ছে করে রাগরূপায়ণে সূক্ষ্ম আবেগের নিয়ন্ত্রিত প্রকাশে রশিদের তুলনা রশিদ নিজেই। রশিদের মায়ের মেসো রামপুর-সহসৱান ঘরের যুগন্ধর গায়ক ওস্তাদ নিসার হুসেন খান ওঁকে তালিম দিয়েছিলেন কলকাতার সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে নিয়ে এসে। কিন্তু ঘরানার গণ্ডির সীমাবদ্ধতায় নিজেকে আটকে না রেখে এক শিক্ষর্থীর অনন্ত জিজ্ঞাসা ওঁকে তাড়িত করেছে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। বিভিন্ন ঘরানা এবং গায়কির সমন্বয় ওঁর একটা নিজস্বতা গড়ে দিয়েছিল। সেটাই রশিদের অনন্যতা। সিনেমার গান, ফিউশন, রবীন্দ্রসংগীত, ভজন, গজল সবরকমের গানেই তিনি ছিলেন অনায়াস। সন্দেহ নেই যে রাগসংগীতের নিরলস চর্চা তাঁকে গানের জগতে অবাধ বিচরণে অধিকারী করে তুলেছিল।
রশিদ খানের মৃত্যু ভারতীয় সংগীত জগতে ক্ষতি, বড়ো ক্ষতি। এই বয়সে চলে যাওয়াটা আরও বেশি করে মুচড়ে দিচ্ছে আমায় বা আমার বয়সি আরও অনেককে, বা আপামর সংগীতপিয়াসীদের! অনেক গান তো হলো গাওয়া — বলার সময় যে আসেনি এখনও! গাওয়ার বাকি ছিল অনেক!
সঙ্গে রইল অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে গাওয়া দুটি রাগ — যোগ এবং বেহাগ। এ রেকর্ডিং দুটিই বহুশ্রুত বলে মনে হয় না। রশিদ বেঁচে থাকুন তাঁর গানে — গান ছাড়া গায়কের আর কোনো পরিচয় স্থায়ী নয়।
১০ জানুয়ারি, কলকাতা
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।