কোরবানি ঈদ: আমাদের কাছে ছিল পেটপুরে মাংস খাওয়ার ঈদ
ঈদের সময়টা এলেই কেন যেন বারবার পেছনের দিনের কথাগুলো মনে হয়। শৈশব-কৈশোরের ঈদ মানে শুধু আনন্দ। স্কুল ছুটি, পাড়ায় পাড়ায় ঘোরাঘুরি, বাড়ি বাড়ি গিয়ে গরু-ছাগল দেখা, তাদের পাতা খাওয়ানো এবং কাদের গরু বেশি সুন্দর তা নিয়ে গল্প করা। ৭০/৮০ এর দশকে পরিবার প্রতি একটি গরুর ভাগ অথবা একটা খাসি কোরবানি দেয়া হতো। যারা খানিকটা অবস্থাপন্ন তারা দুটি ভাগ দিতেন। আমরা কলোনিতে বড় হয়েছি, তাই সেখানকার প্রতিবেশীরা, ঢাকায় আমাদের আত্মীয়-স্বজনরা সবাই এভাবেই কোরবানি দিতেন। নিয়ম আছে বলেই কোরবানি দেওয়া হতো, সেখানে কোনো আতিশয্য ছিল না, ছিল না প্রতিযোগিতা।
কোরবানির ঈদে তেমনভাবে বিশেষ কোনো জামা কাপড় আমাদের দেওয়া হতো না। এক ঈদে নতুন জামা-জুতো, বড় ঈদে বা বকরি ঈদে যত খুশি মাংস খাওয়া, এই ছিল ৪৫/৫০ বছর আগের ঈদের তরিকা। আজকালকার বাচ্চারা হয়ত ভাবতে পারে, এই একটা দিন যত খুশি মাংস খেতে পারছি বলে এত খুশির কী হলো? মাংস খাওয়াতো একটা সাধারণ ব্যাপার এখনকার বাচ্চাদের কাছে। এরা চাইলে যেকোনো দিন যত ইচ্ছে মাংস খেতে পারে। বর্তমানে সচ্ছল পরিবারের শিশু-কিশোররা ঘরে-বাইরে মাংসের নানা ধরনের রান্না খেতে পারে।
কিন্তু সেইসময়ে অর্থাৎ ৭০/৮০ দশকে আমরা এভাবে যত খুশি খেতে পারতাম না, অন্তত ঘরের বাইরেতো নয়ই। হাতে টাকা ছিল না, বাইরে খাওয়ার কোন চল ছিল না, খাবার-দাবারের তেমন কোন দোকানপাটও ছিল না। সেজন্য উৎসবের দিনগুলো আমাদের কাছে ছিল অন্যরকম আনন্দের। একসাথে এত খাওয়া বছরের অন্য দিনগুলোতে পেতাম না। এই শহরে আমাদের সমসাময়িক সময়ে বড় হওয়া শিশু-কিশোরদের অভিজ্ঞতা কম-বেশি একই রকম।
কোরবানির ভাগ বাসায় আসার পর ভাগ-বাটোয়ারা, বিলি-বণ্টন হতো। হাড়ি ভরা মাংস চুলায় উঠানো হতো। এরপর শুরু হতো ক্রমাগত জ্বাল দেওয়ার পালা। পুরো বাড়িময় ভাজা মাংসের গন্ধ থাকতো। আমরা একে বলি ঝুরি মাংস। ঈদের পরে ঝুরি মাংস খাওয়াই ছিল সবচেয়ে আনন্দের। গরম ভাত ও ডাল সহযোগে, রুটি-পরোটা, মুড়ি মাখা সব ধরনের খাওয়া চলতো এই মাংস ভাজা দিয়ে। অনেকের বাসায় ফ্রিজ ছিল না, কাজেই কোরবানির মাংস এভাবে চড়িয়ে দেয়াটাই উত্তম ছিল। ফ্রিজ থাকলেও খুব সামান্য মাংস তুলে রাখা হতো। এখন অবশ্য অনেকের বাসায় আস্ত গরুই নাকি ডিপ ফ্রিজে ঢুকে পড়ে এবং মানুষ বছর ধরে খায়। বিলি-বণ্টন হয় সামান্যই। আর ঝুরি মাংসের কথাতো বাদই দিলাম।
সেইসব দিনের অর্থাৎ আমাদের সময়কার কোরবানি ঈদের কিছু মজার স্মৃতি নিয়ে লেখাটা লিখছি। যদিও শিশু-কিশোরদের কাছে ঈদ এখন তেমন কোন মাজেজা নিয়ে আসে না। বড়দের কাছেও ঈদে আনন্দের চেয়ে, দায়িত্ব ও কাজ অনেক বেশি।
নেহারি খাওয়া হলো না
ঈদের রাতে বিটিভির আনন্দমেলা ছিল প্রতিটি পরিবারের কাছেই দারুণ প্রিয় একটি অনুষ্ঠান। সারাদিন তোড়জোর, ঘোরাঘুরি, খানাপিনা শেষ করে এই আনন্দমেলা দেখতে বসতাম বাসার সবাই মিলে। সেরকমই কোনো এক কোরবানি ঈদে আনন্দমেলা দেখছি। হঠাৎ আমাদের বিল্ডিং এর ১২ নং ফ্ল্যাট থেকে বিভিন্ন কণ্ঠে 'আগুন আগুন' বলে চিৎকার ভেসে এলো। সেই বাসাটা ছিল ইরান ভাইদের। সেখানে ১১ ভাইবোন, খালা-খালু ও দুই জামাই নিয়ে প্রায় ১৫ জন মানুষের ঈদ আয়োজন চলছিল। যেহেতু মানুষ বেশি তাই ইরান ভাইদের বাসায় ছোট সাইজের একটা গরুই কোরবানি দেয়া হতো।
যা হোক, 'আগুন আগুন' চিৎকার শুনে সব ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা দৌড়ে গেলাম। আমাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চেঁচালেই আসাদগেট ফায়ার ব্রিগেডের স্টাফরা শুনতে পেতেন কারণ মাঝে আর কোন ভবন ছিল না। বাড়ি ভর্তি মানুষ, চেঁচামেচি, কান্নাকাটি, আর্ত চিৎকার সব চলছে একসাথে। ইরান ভাইরা ১১ জন ভাইবোন সবাই সবার নাম ধরে হাঁকডাক করছেন। মেঝেতে থই থই পানি, ফায়ার ব্রিগেডের মোটা পাইপ, এদিকে টেলিভিশনে আনন্দমেলা চলছিল। আর উৎসুক জনতা মানে আমরাতো ছিলামই।
কোথায় আগুন, কীভাবে আগুন এই খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল, ছোট রান্নাঘরে কেরোসিনের চুলায় বেশ বড় সাইজের একটি হাঁড়িতে নেহারি বসানো হয়েছিল। কারো শরীরের ধাক্কায় হাড়িসহ চুলাটি উল্টে পড়ে এবং চারিদিকে ধোঁয়া, কেরোসিনের গন্ধ, নেহারির পানি, তেল, পায়া সব ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার আগেই সবাই ভয়ে এত চিৎকার শুরু করেছিল যে, আসলে আগুন লেগেছে কিনা সেটা কেউ খেয়াল করেনি। ভাগ্য ভালো সেদিন আগুন আগুন করে তেলেসমাতি হলেও, আগুনটা লাগেনি, তবে নেহারিটাও আর খাওয়া হয়নি।
ড্রাম স্টিক
নব্বই এর দশকের শুরুতে কোন এক কোরবানি ঈদের আগে দুপুর নাগাদ বিরাট সাইজের একটি টিফিন বক্স নিয়ে চিটাগাং থেকে শহীদ ভাই এসে হাজির। তাও সেটা ছিল একটা ফ্রিজার টিফিন বক্স, যা আমরা কখনো দেখিনি। এত বড় বাক্সে কি আছে তা দেখার জন্য সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। ভাই এর ভেতর থেকে বিরাট সাইজের মুরগির ড্রাম স্টিক বের করতে লাগলেন। দেখে মনে হলো, একেকটাই এক হাত লম্বা। এতবড় ড্রাম স্টিকও আমরা এর আগে কখনও দেখিনি। সেসময় ফার্মের মুরগি বা ব্রয়লার মুরগি সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণাই ছিল না। এত বড় একটা রান কি খাওয়া যাবে? গেলে কীভাবে? স্বাদ কেমন হবে? ধরনের নানা প্রশ্ন আমাদের মাথায় এলো। একেকটার নাকি খাসির রানের মত ওজন!! ভাই বললেন, এই কোরবানি ঈদে গরুর মাংসের পাশে, খাসি বাদ দিয়ে এই মুরগির রোস্ট বানানো হোক। এরপর তিনি নিজেই এগুলোকে রোস্ট বানাবেন বলে উদ্যোগ নিলেন।
শহীদ ভাই জাহাজ থেকে নেমে প্রতিবারই সিদ্ধান্ত নিতেন যে, আর জাহাজে সেইল করবেন না, দেশেই কিছু একটা করবেন। প্রতিবারই উনি জাহাজ থেকে নেমে একটা কাজ খুঁজে বের করেন এবং কয়েকদিনের মধ্যে তা গুটিয়ে আবার জাহাজে গিয়ে ওঠেন। সেবার এসে ভাই কাজ নিয়েছিলেন চিটাগাং এর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে, যারা সামুদ্রিক মাছ, ফার্মের মুরগি এসব নিয়ে বড় আকারের ব্যবসা করে। সেখানে ভাইয়ের চাকরির সুবাদেই আমাদের বাড়িতে ঐ ঢাউস সাইজের চিকেন ড্রাম স্টিকটা ঢুকেছিল। কে জানতো আরো কয়েক বছর পর এই ব্রয়লার মুরগি বাজার দখল করে নেবে এবং আজকের মতো খাসির মাংসকে সরিয়ে ঈদ পর্বে স্থান করে নেবে।
মানুষ বনাম গরু
খবরটি পেয়েছিলাম সম্ভবত উত্তরাঞ্চলের কোন জেলা থেকে। তখন আমি একটি জাতীয় দৈনিকের ডেস্কে কাজ করছি। কোরবানি ঈদের ২/৩ দিন আগে স্থানীয় প্রতিবেদক সড়ক দুর্ঘটনার খবর জানিয়ে বিশাল একটা ফ্যাক্স পাঠিয়েছেন। গরু-ছাগলবাহী ট্রাকটি রাস্তার পাশে একটি খাদে পড়ে গিয়ে ৫ টি গরু ও ৩ টি ছাগল মারা গেছে, বাকিগুলো প্রাণে বেঁচেছে। অবশ্যই এটা একটি খবর, কিন্তু একটি জাতীয় দৈনিকে নিউজের গুরুত্ব অনুযায়ী এটা তেমন কোন খবর না। খবরটা চার প্যারা পড়ার পর যখন মফস্বল পাতায় দিবো নাকি ফেলে বলে ভাবছি, ঠিক তখন শেষ প্যারায় প্রতিবেদক লিখেছেন, এই দুর্ঘটনায় ট্রাকে থাকা ৩ গরু ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন, চালক পলাতক। প্রতিবেদককে ফোন করে জানতে চাইলাম কেন তিন ব্যক্তি নিহত হওয়ার সংবাদ এত পেছনে দিয়েছেন? উত্তরে বললেন, যেহেতু এগুলো কোরবানির জন্য হাটে আনা হচ্ছিল এবং নিহত গরুর সংখ্যা বেশি হওয়ায়, তিনি গরুর কথাই আগে লিখেছেন।
বুদ্ধির বই
আমার এক ভাই এবং তার কয়েকজন বন্ধু মিলে চাকরির পাশাপাশি শুরু করেছিল গরুর ব্যবসা। টাঙ্গাইলে তাদের মস্ত খামার। ২০১৬/১৭ সালে কোরবানি ঈদে তারা কমলাপুর গরুর হাটের ভিআইপি গ্যালারিতে, মানে ছাউনির নিচে স্টল পেয়েছিল, সাথে বসবার জন্য সেখানে ৫টি চেয়ারও ছিল। ঈদের আগের দিন, বিকেল নাগাদ বিক্রির জন্য তাদের কাছে একটিমাত্র গরু বাকি ছিল। সাপোর্ট স্টাফরাও বাড়ি যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল। ওরা খেয়াল করলো, দুপুর থেকেই একজন বয়স্ক মানুষ ২/৩ বার ঘুরেঘুরে এসে ওদের গরুটি কেনার জন্য দরদাম করেছেন। ৭০/৭৫ বছরের ঐ বৃদ্ধের পরনে সাদা ফিনফিনে আদ্দির পাঞ্জাবি, ধবধবে সাদা চুল-দাড়ি, বেশ নুরানি চেহারা। দামে মিলছিলো না বলে ভদ্রলোক বারবার আসা-যাওয়া করছিলেন।
সন্ধ্যার উনি আবার এলেন। দাম দফারফার পর ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দামের গরুটি ওরা এক লাখে দিয়ে দিতে রাজি হয়ে গেল। কারণ রাত হয়ে যাচ্ছিল, ওরাও আর বসে থাকতে চাইছিল না। যাক, বুড়া চাচা এক লাখ টাকায় গরুটি কিনতে রাজি হলেও, শেষ অবধি উনি ৯৯ হাজার টাকা দিলেন। কিছুতেই তার পকেট থেকে পুরো এক লাখ বের করা গেল না।
গরুটি কেনার পর চাচা ওদের পাশেই একটি চেয়ারে বসলেন এবং গরুটিকেও সেখানেই বেঁধে রাখলেন। আমার ভাইটি দেখলো চাচা কারো সাথে যেন ফোনে কথা বলছেন। ১০ মিনিটের মধ্যে দু'জন এলো, আর চাচা ওদের কাছে ১ লাখ ২৫ হাজার দিয়ে ঐ গরুটিই বিক্রি করে দিলেন ।
এই ঘটনা দেখে আসল গরু ব্যবসায়ীদের তো ভিরমি খাওয়ার দশা। একি! বুড়ো চাচা ওদের থেকে গরুটি ৯৯ হাজারে কিনে, ওদেরই পাশে বসে সেটা ২৬ হাজার টাকা লাভে বিক্রি করে দিলেন। চাচার কী কেরামতি ! নুরানি বুড়ো ওদের মত ৬/৭ জন উচ্চশিক্ষিত, উচ্চপদস্থ চাকুরিরত যুবককে ঘোল খাইয়ে দিলেন। বিক্রেতাদের মধ্যে একজন হতভম্ব অবস্থায় চাচা মিয়াকে সালাম করতে চাইলে, চাচা হেসে বলে উঠলেন, "বাবারা সালাম করন লাগবো না। আমি তোমাদের বুদ্ধির বই পড়তে দিমু।" একথা বলে হাসতে হাসতে পগাড় পার হয়ে গেলেন।
- লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট