‘মানবানল’ ও ‘আগুন শাস্তি’!
আগুন আর কতটুকু পোড়ে
সীমাবদ্ধ ক্ষয় তার সীমিত বিনাশ
মানুষের মতো আর অতো নয় আগুনের সোনালি সন্ত্রাস
আগুনে পোড়ালে তবু কিছু রাখে
কিছু থাকে
হোক না সে শ্যামল রঙ ছাই
মানুষে পোড়ালে কিছুই রাখে না....
...........হেলাল হাফিজ: মানবানল, 'যে জলে আগুন জ্বলে'
সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনায় কত বেশি আকুতি থাকতে পারে? এম ভি (মোটর ভেসেল) অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লাগার পর সেখান থেকে বের হয়ে আসতে না পারা মানুষগুলোর প্রার্থনা কেমন ছিল? কতটা আকুতি নিয়ে তারা হাত তুলেছিলেন সৃষ্টিকর্তার কাছে? কতটা প্রার্থনার পর কেউ কেউ ঝাঁপ দিয়েছিলেন হিমশীতল নদীর জলে? কতটা আকুতি নিয়ে সবাই প্রার্থনা করেছিলেন তীরে উঠে জীবন বাঁচাতে?
লঞ্চ বা জাহাজকে যে আগুন পোড়ায় সেই আগুনের নাম কী? হিন্দু পুরানে ইন্দ্রর যমজ ভাই হচ্ছে 'অগ্নি'। যারা আগুন উপাসনা করে তারা অগ্নি উপাসক। বনকে পোড়ায় যে আগুন সেটা 'দাবানল'। আগুন জ্বালিয়ে সাতপাক ঘুরে যে বিয়ের রেওয়াজ সনাতন ধর্মে, বিয়ের জন্য জ্বালানো সে আগুনের নাম 'যোজক'। এ আগুন নাকি পোড়ায় আজীবন। যে আগুন জ্বালিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করা হয়তার নাম 'বিধু'। শবযাত্রার শেষে চিতায় উঠিয়ে মুখে যে আগুনের সূত্রপাত করা হয় তার নাম 'মুখাগ্নি'! তাহলে লঞ্চের যে আগুন আটত্রিশ জনের প্রাণ কেড়ে নিলো সেই আগুনের নাম কী? হেলাল হাফিজের কবিতার নামে নাম- 'মানবানল'?
মানুষের কারণে যে আগুন সেটাই মানবানল! অভিযান -১০ লঞ্চে আগুন লেগেছিল ইঞ্জিন রুম থেকেই। তদন্ত কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টে তেমনই জানা গেছে। যদিও হিন্দি সিরিয়াল আর তদন্ত কমিটির চরিত্র এক-সহসা দুটোর কোনটা শেষ হতে চায় না! একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছে সেটা বাংলার নদীবক্ষে চলাচল করা যে কোন যাত্রীবাহী লঞ্চের চরিত্রই ফুটে উঠেছে। যেমন-
এক. প্রায় সব লঞ্চেই নকশার ত্রুটি থাকে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কোন ভবন নাকি নকশা মেপে তৈরি হয় না। যাত্রীবাহী লঞ্চও তাই। অভিযান-১০ এর ইঞ্জিনেও ত্রুটি ছিল।
দুই. কাজীর গরু কেতাবে থাকে গোয়ালে থাকে না। নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের খাতায় যে মাস্টার বা চালকের নাম দিয়েছিল এমভি অভিযান-১০ এর মালিক, দুর্ঘটনার দিন লঞ্চটি চালাননি সেই মাস্টার, চালিয়েছিল অন্য চালক। লঞ্চে মাস্টার নিয়োগের বিষয়টি নৌ পরিবহন অধিদপ্তরকে জানাতে হয়। লঞ্চের চারজন মাস্টার ও ড্রাইভারের ভেতর তিনজন নিয়োগের ব্যাপারটি মালিক অধিদপ্তরকে জানাননি যেটা জানানোর নিয়ম । আগুন লাগার সামান্য পরেই যাত্রীরা বুঝতে পারেন লঞ্চের প্রধান দরজা বন্ধ। নদীর তীরে নোঙর করলেও যাত্রীরা তাই সময় মতো বের হতে পারেননি লঞ্চ থেকে। অভিযান -১০ এর অগ্নিকান্ডে এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৩৮ জন, হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৮৫ জন, নিখোঁজ রয়েছেন ৫১ জন।
তিন. আগুন লাগলে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সে বিষয়ে কর্মীদের কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। তাই লঞ্চে ওঠার পর আগুন লাগলে মানুষকে নিয়তি নির্ভর ও প্রার্থনার স্বান্তনা বুকে নিয়ে পানিতে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকে না! অগ্নি নির্বাপনযন্ত্র লঞ্চে থাকলেও সেটা যেন 'শো-পিস' হয়েই ঝুলে থাকে। সংরক্ষণের সমস্যার জন্যও এসব যন্ত্র ঠিক সময়ে বের করে আনা যায় না, পুরোপুরি কাজে লাগে না।
চার. লঞ্চ মালিকরা না চাইলে ফায়ার সার্ভিস লঞ্চ কর্মীদের জন্য আগুন নেভানোর জন্য কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে না। গত দুই বছরে একটি মাত্র লঞ্চে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল।
পাঁচ. অভিযান লঞ্চের ইঞ্জিন রুমের সাথেই ছিল রান্না ঘর। ইঞ্জিন রুমের চেয়ে দূরে থাকার কথা থাকলেও ছোট ছোট লঞ্চের ইঞ্জিন রুমের সাথেই রান্না ঘর থাকে। রান্নার কাজে ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডার থেকে আগুন লাগার ঝুঁকিটা থেকেই যায়!
ছয়. গাড়ি বা বাসের ইঞ্জিন পাল্টালে যেমন জানানোর নিয়ম আছে তেমনি লঞ্চের ইঞ্জিন পাল্টালেও সেটা অনুমতি নিয়ে করতে হয়। আগে এই লঞ্চে ৫৫০ হর্স পাওয়ারের দুটো ইঞ্জিন থাকলেও পরে অনুমতি না নিয়েই সেখানে ৭২০ হর্স পাওয়ারের দুটো ইঞ্জিন লাগানো হয়। নতুন ইঞ্জিনে দ্বিতীয় দিন চলার সময়েই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে!
সাত. লঞ্চ ছাড়ার আগে বিআইডব্লিউটিএ (বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন সংস্থা) এর 'চেক লিস্ট' করাতে হয় যেখানে বলা হয়েছিল যে লঞ্চের কোন ত্রুটি নেই। লঞ্চ ছাড়ার আগে যাত্রী সংখ্যা ৩১০ জন উল্লেখ করা থাকলেও প্রকৃত সংখ্যা ছিল আরও বেশি!
অভিযান লঞ্চে অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র থাকলেও সেটা ব্যবহৃত হয় নি। আটচল্লিশ ঘন্টা পার হলেও নৌ আদালতে মামলা হয়নি যেটা করার নিয়ম রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে ত্রুটি পূর্ণ নকশা দিয়ে লঞ্চ বানানো, অদক্ষ চালক, অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্য বহন এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস না মানার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে একের পর এক। লঞ্চে প্রাণ বাঁচানোর সরঞ্জামও ঠিক মত থাকে না! দুর্ঘটনার সব কারণ আমরাই আয়োজন করে থাকি বলে বিধাতার কাছে হাত তোলা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় থাকে না! আগুনের ঘটনা প্রথম হলেও বছরের পর বছর ধরে আমরা এভাবেই রাষ্ট্রীয়ভাবে মৃত্যু ফাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এসেছি!
যে আগুন সভ্যতা শুরুর পৃষ্ঠপোষক ছিল সেই আগুন আবার প্রাণহরণকারী। গ্রীক মিথ অনুসারে মানুষ ভালোবাসে এমন এক বিপ্লবী টাইটান দেবতার নাম প্রমিথিউস। মৌরি গাছের ডালে করে স্বর্গ থেকে আগুন এনে উনি মানুষকে বিলিয়েছিলেন। মানুষের খুব বেশি আগুন দরকার ছিল তখন। অন্ধকারে অনেক রোগ শোক জ্বরা মানুষকে ঘিরে ধরেছিল। ব্যাপারটা টের পেয়ে যান দেবতাদের রাজা জিউস। তিনি প্রমিথিউস কে ককাশস পাহাড়ের চূড়ায় বন্দী করে রাখেন। তাতেও মন শান্ত হয়না জিউসের। নতুন শাস্তি জারি হয়। প্রতিদিন এক ক্ষুধার্ত ঈগল এসে খেয়ে যেত প্রমিথিউসের হৃদয় (কারো কারো মতে যকৃত!)! তবে রাতভর নতুন হৃদয় জন্ম নিত। কিন্তু পরদিন আবারো সেই ক্ষুধার্ত ঈগল প্রমিথিউসের হৃদয় খুঁড়ে খুঁড়ে খেত। (জানিনা এই ঘটনা থেকেই জীবনানন্দ লিখেছিলেন কিনা-কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!) বহু বছর পরে হারকিউলিস প্রমিথিউসকে উদ্ধার করেন ।
গল্পের প্রমিথিউস এখন আর নেই, আসেনা হারকিউলিসও। অথচ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দিয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আগুন নেভানো শেখানো গেলে লঞ্চের যাত্রী নামের প্রমিথিউসকে বাাঁচাতে পারতো অগ্নিনির্বাপক হারকিউলিস! সেটা করা না গেলে লঞ্চ যাত্রীদের হতে হবে ব্রজেন দাস কিংবা ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। অসুস্থ মা'কে দেখতে ঝড় বৃষ্টির রাতে যেমন সাতার দিয়ে নদী পার হতেন বিদ্যাসাগর, একালের লঞ্চযাত্রীদেরও তেমনি সাতার জানতে হবে। থাকতে হবে ব্রজেন দাসের মতো দীর্ঘ সাতারের অভিজ্ঞতা। প্রয়োজনে সাতরে যেতে হবে গন্তব্যে!
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ যুদ্ধের আরেক অনুসঙ্গ আগুন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া হতো ভয় ছড়ানোর উদ্দেশ্যে, পলায়নপর অসহায় মানুষের কোন আশ্রয় যেন না থাকে আগুন দেয়া হতো সেকারনেও।অভিযান-১০ লঞ্চে আগুন লাগার কারণ কী? নাকি এর পেছনে কোন নাশকতা আছে? হয়তো জানা যাবে একদিন অথবা জানা যাবে না। যে মানুষেরা নিহত হয়েছেন, তাদের জন্য হয়তো জোড়া ছাগল বা কয়েক হাজার টাকা বরাদ্দ হতে পারে। যারা নিহত হয়েছেন তাদের পরিবারের বেদনা আর যারা আছেন হাসপাতালের বিছানায় তাদের যন্ত্রণা কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। গ্রীক মিথ আর হিন্দু পুরানে আগুনের দেবতা পুরুষ। অভিযান -১০ আগুনের আগুনের পেছনে দেবতারুপী যে পুরুষই থাকুক না কেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক 'আগুন শাস্তি'র আওতায় আনা উচিত!