স্পট নরসিংদী স্টেশন: কেন সমাজে নারী বিদ্বেষ বাড়ছে?
নরসিংদী রেল স্টেশনে পোশাকের জন্য তরুণী ও তার বন্ধুদের লাঞ্ছনার সেই ঘটনার অডিওসহ ভিডিওটি দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। মাত্র মাসখানেক আগে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও ডিনেটের করা একটি গবেষণায় যে তথ্য বের হয়ে এসেছে, ঠিক সেটারই প্রকাশ দেখলাম, নরসিংদীর এই ঘটনায়।
স্টেশনে লাঞ্ছিত ছাত্রীটিকে যারা লাঞ্ছনা করেছে, তারাই গলা ফাটিয়ে বলছে "মাফ চা', 'মাথা নিচু কর, ক্ষমা চা"। মেয়েটির অপরাধ সে তার পছন্দমতো পোশাক পরেছে। আমাদের করা গবেষণা এই বিষয়টিকেই সবচেয়ে স্পষ্টভাবে তুলে এনেছে যে, পোশাক বা আচরণ দেখে মুহুর্তে কোন মেয়েকে "ভাল মেয়ে বা মন্দ মেয়ে" হিসাবে বিচার করার এবং "মন্দ মেয়ে" বলে মনে হলে তাদের উপর আক্রমণের মানসিকতা বেড়ে যায়। এই আক্রমণ করাটাকেও তারা যৌক্তিক বলে মনে করে।
গবেষণা বলছে একটি মেয়ে যখন খানিকটা পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক পরে, স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও মেলামেশা করে, সেই মেয়েদের নানাভাবে হেয় করা হয় ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা হয়, এমন ধারণা পোষণ করেন শতকরা ৮১ জন উত্তরদাতা।
অবাক করা তথ্য হচ্ছে, এর পাশাপাশি শতকরা ৬৪ জন মানুষ মনে করে যেসব মেয়ে আচরণ ও পোশাকে সামাজিকতা মানে না, স্বাধীনভাবে চলতে চায় এবং আচরণে নারী-পুরুষ বিভেদ করে না, তাদের প্রতি অন্য মানুষ কটুক্তি, সমালোচনা, তির্যক মন্তব্য ও অপমানজনক আচরণ করতেই পারে।
এর মানে স্বাধীন আচরণ করা নারীদের প্রতি কটুক্তি করলে তাতে কোন দোষ হবে না। যে কারণে স্টেশনে একজন নারী মেয়েটিকে হেনস্তা করতে শুরু করলে সবাই তার পক্ষ নিয়ে মেয়েটির ও তার সঙ্গীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
আসলে নারীর পছন্দের পোশাকের প্রতি অন্য নারীর যে ক্ষোভ এর সাথে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। এর সাথে সম্পর্ক আছে হীনতা, নীচতা, নিজের পরাধীন জীবন, বন্দীত্ব, যৌন ঈর্ষা ও নিজের স্বামী বা ছেলেকে নিয়ে অনিরাপত্তার বোধ (ইনসিকিউরিটি)।
নারী যে কারণে অন্য নারীকে পোশাকের জন্য হেয় করে সেটাrর প্রধান কারণ হলো নিজের ভেতরে থাকা নারীবিদ্বেষ (ইন্টার্নালাইজড মিসোজিনি)। সাম্প্রতিক করা আমাদের গবেষণা বলছে আমাদের দেশে ইন্টার্নালাইজড মিসোজিনি বাড়ছে। এই বিদ্বেষ থেকেই এরা নারী হয়েও নারীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে।
ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ ও নিরাপদ জীবন নিয়ে সমাজে অনিশ্চয়তা, ভীতি ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে বলে মনে করেন শতকরা ৯০ ভাগ উত্তরদাতা। এই সমাজ মনে করে 'মন্দ মেয়ে'র মতো আচরণ সমাজে অনাকাঙ্খিত, কারণ সেটা অন্য ছেলেমেয়েদের নষ্ট করে ফেলবে। নারীর প্রতি এই অদ্ভূত অবমাননাকর ধারণা পোষণ করেন শতকরা ৭৯ জন উত্তরদাতা।
আর তাই অনলাইনে দেখানো "মন্দ মেয়ে"র মতো আচরণ যারা করে, তাদের সেটা থেকে বিরত রাখা জন্য তাকে হেয় করা, তাদের মন্দ বলা ও তাদের প্রতি অপমানজনক আচরণ করা সমাজের জন্য উপকারী বলে মনে করে শতকরা ৪৪ জন উত্তরদাতা। নরসিংদীর ঘটনা এটাই প্রমাণ করে। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নারী অভিযোগ করেছেন যে নিজের ইচ্ছা মতো আধুনিক পোশাক পরার জন্য তাদের পথেঘাটে হেনস্তা করা হয়।
"বাংলাদেশে ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির সহজ বিস্তার এবং নারীর প্রতি সহিংসতা" শীর্ষক এই গবেষণায় বলা হয়েছে, একদিকে যেমন দেশীয় অনলাইন ও মিডিয়াতে নারীর প্রতি অবমাননাকর, নারীর দেহ প্রদর্শন, যৌন আবেদনময় ও পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট বা আধেয় বাড়ছে, অন্যদিকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহার করে কিছু মেয়ে বা নারী ছেলেদের বা পুরুষদের প্রলুব্ধ করে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সচেষ্ট হয়ে উঠছে। এছাড়া প্রচুর সংখ্যক কিশোর, যুবক ও পরিণত পুরুষ নারীর প্রতি অবমাননাকর কনটেন্ট নিয়মিত দেখে থাকে বলে গবেষণায় অংশগ্রহণকারী ৮১ ভাগ উত্তরদাতা মনে করে।
পর্নোগ্রাফি নিয়ে আমাদের পুরোনো অনেক ধারণাকে বদলে দিয়েছে দেশীয় কনটেন্টে তৈরি এইসব পর্নোগ্রাফি, ফেসবুক লাইভ, ইমো লাইভ, বাংলা নিম্নমানের সিনেমা এবং ওয়েব সিরিজ। পর্নোগ্রাফি ইস্যুটি এখানে নতুনভাবে ও ভিন্নভাবে উঠে এসেছে।
সবচেয়ে বিপজ্জনক হলো এইসব অনলাইনে নারীর প্রতি অবমাননাকর যে ইমেজ দেখানো হয়, তা সমাজে প্রচলিত "মন্দ মেয়ে"র ইমেজকে আরো শক্তিশালী করে। বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফি ও অনলাইনে নারী বিষয়ক কী কী আধেয় রয়েছে, তা দেখতে গিয়ে দেখা গেছে নারীর প্রতি টিটকারি, অবমাননা, প্রতিশোধ, ভার্চুয়াল সেক্স, সেক্স ট্রেড প্রোমো, অশ্লীলতা এবং নিউজ প্রোমো এখানে স্থান পেয়েছে।
সমাজে "ভাল" ও "মন্দ" মেয়ে আছে এটা বিশ্বাস করেন শতকরা ৭৯ জন উত্তরদাতা। শতকরা ৫২ জন মানুষ মনে করেন মেয়েদের মিডিয়ায়, সিনেমায় কাজ করা, পুরুষের সাথে রাতের শিফটে কাজ করা বা দূরদূরান্তে একসাথে ভ্রমণ বা কাজে যাওয়া ঠিক নয়।
যখন কেউ "মন্দ" মেয়ের মতো আচরণ করেন, তখন তার প্রতি বিরূপ মন্তব্য, টিটকারি কাটে শতকরা ৭১ জন পথচারী, এরমধ্যে শতকরা ৩৩ জন নারী ও ৩৮ জন পুরুষ। শতকরা ৭৫ জন প্রতিবেশি, পরিবারের সদস্য শতকরা ৪৮ জন, আত্মীয় শতকরা ৬৪ জন এবং অপরিচিত মানুষ ৬৩ জন।
"ভাল মেয়ে", "মন্দ মেয়ে" নিয়ে সমাজে প্রচলিত এই যে স্টেরিওটাইপ বা বহুল প্রচলিত ধারণার আলোকে মনে করা হয় মন্দ মেয়ে, মন্দ ছেলের চাইতেও বেশি বিপজ্জনক। আর এটা মনে করেন শতকরা ৭৪ জন উত্তরদাতা। এখানে নারীকে হেয় করতে গিয়ে পুরুষের মন্দ হওয়াটাকেও একধরনের সমর্থন দেওয়া হয়েছে।
এই "মন্দ মেয়ে" কারা, এর উত্তরে বলা হয়েছে যারা 'নায়িকা'র মতো যৌন আবেদনময়ী আচরণ করে অথবা পশ্চিমা পোশাক পরে, স্বাধীন আচরণ করে, সন্ধ্যার পর বাইরে থাকে, ছেলেদের সাথে মেলামেশা করে বা টিকটক, লাইকি ও ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে অনলাইনে ও সামাজিক মাধ্যমে উপস্থিত থাকে, এরাই মন্দ মেয়ে।
"ভাল" মেয়ের লক্ষণের মধ্যে রয়েছে যারা ধর্মীয় নিয়ম মানে। হিজাব পরে, নিজেকে আকর্ষণীয় করে যারা অনলাইনে আসেনা, ছেলেদের সাথে মেশে না এবং অনলাইনে একাউন্ট নেই। মেয়েকে ভালো বা মন্দ দেখানোর এই মানদন্ড খুব স্থূল কিছু বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। অন্যভাবে বলা হচ্ছে যে, একজন স্বাধীন নারী হচ্ছেন মন্দ নারী।
যারা মনে করছেন হিজাব ও বোরকা ইসলামের ব্র্যান্ড, তারা কি একটু পড়াশোনা করে দেখবেন যে দুনিয়াতে হিজাব কি মুসলিমরা এনেছিল? হিজাবের প্রচলন কারা করেছিল? কেন করেছিল?
শুধু নারীদের দমিয়ে রাখার জন্য যারা নারী বিদ্বেষ ও অমানবিকতাকে নিজেদের ধর্ম ও সংস্কৃতি বলে বয়ে বেড়াচ্ছেন, তাদের পড়াশোনা করা উচিৎ। প্রয়োজন নেই প্রাচীন অসামাজিকতাকে ঢেকে রাখার যে পোশাক তাকে নিজেদের ধর্মীয় পোশাক বলে মনে করার এবং অন্যকে সেই পোশাক পরানোর জন্য হেনস্তা করার বা জোর জবরদস্তি করার।
পবিত্র কোরআন শরীফে নারী ও পুরুষ উভয়ের পর্দার কথা বলা হয়েছে। এই পর্দা বলতে হিজাব বা বোরকার উল্লেখ নেই কোথাও। আর কেউ যদি তার ইচ্ছেমতো পোশাক পরতে চান, তাহলে তাকে আজেবাজে কথা বলে আক্রমণ করতে হবে, সেকথাই বা কোথায় আছে?
টিপ নিয়ে বিতর্কের পর ফেসবুকে একশ্রেণীর মূর্খ ও অসভ্য লোক শেয়ার করতে শুরু করলো যে ইব্রাহিম (আঃ) এর সময়ে নাকি "টিপ যৌনকর্মী সনাক্তের চিহ্ন" ছিল। সেই আমলে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর বিচরণ ছিল বর্তমানের ইরাক, সিরিয়া ও মিশর এলাকায়। তখন সেখানে টিপ এলো কোথা থেকে?
সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, বাংলাদেশে একটা বড় অংশ দেশীয় পর্নোগ্রাফি দেখে শুধু অশ্লীলতা আস্বাদনের জন্য নয়। এর চাইতেও বেশি দেখে নারীকে নিন্দা, নির্যাতন ও অপমান করার জন্য। নারীকে নিপীড়নের উপায় খুঁজে বের করার এবং নারীর পিঠে "মন্দ মেয়ের তকমা" লাগানোর জন্য।
ফেসবুক, টিকটক, লাইকি, ইমো ও ইনস্টাগ্রামের মতো মাধ্যম ছেলেমেয়েদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। অনলাইনে মন্দ কনটেন্ট যেমন এডাল্ট ম্যুভি, ন্যুডিটি, পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি শতকরা ৭৫ জন ছেলে দেখে থাকে বলে উত্তরদাতারা মনে করেন। তবে বিপদের কথা হলো তারা এগুলো দেখার মাধ্যমে এখানে নারীকে যেভাবে দেখানো হয়েছে, যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, সেগুলোকে অনুকরণ করে থাকে।
এমনকি মেয়েরা যে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়, এরজন্যও দায়ী মেয়েরাই- এমন ভেবে থাকেন অনেকেই। যেসব মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় বা যৌন হেনস্তার শিকার হয়, তাদের নিজেদেরও দোষ আছে, এটা ভাবে শতকরা ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা। সমাজের অর্ধেক মানুষ যখন এমন অযৌক্তিক চিন্তা করতে পারে, তখন সেই সমাজ থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা দূর হবে কেমন করে?
এই সমাজে সেক্সিজম হচ্ছে নারীকে শায়েস্তা করার একটা হাতিয়ার। সবচাইতে ভয়ংকর দিকটি হচ্ছে বাংলাদেশে পর্নো ম্যুভির কনটেন্ট ঠিক করে দিচ্ছে যে, এই সমাজে কে "ভাল মেয়ে", আর কে "মন্দ মেয়ে"? এই "ভালো" বা "মন্দ" মেয়ের সাথে সমাজ কী আচরণ করবে সেটাও তারাই নির্ধারণ করে দিচ্ছে। অর্থাৎ ডিজিটাল পর্নোগ্রাফির এই জগৎ সমাজ পরিচালনার মানদণ্ড বা বিবেক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই তথাকথিত "বিবেকবান" সমাজ নারীকে চলাফেরা করার, পছন্দমতো পোশাক পরার, নিজের ইচ্ছামতো জীবন চালনার জন্য কতটা জায়গা করে দেবে, তা ভাবার বিষয়। আর তাই নারীকেই এদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে হবে এবং তা এখনই।
- লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন