আমেরিকার বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে রাশিয়া, চীন, ইরান
দুনিয়ার সর্বত্র একাট্টা হচ্ছে- আমেরিকার (যুক্তরাষ্ট্রের) ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা। ইউক্রেন যুদ্ধের আগে 'সীমাহীন' কৌশলগত অংশীদারিত্বের ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া ও চীন। এই যুদ্ধ লড়তে পুতিনকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে ইরান। কয়েক দশক ধরে বেইজিং ও তেহরানের নিজস্ব একটি কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, যা দিন দিন গভীরতর হচ্ছে।
বৈরী শক্তিগুলোর দৃঢ় জোটের মুখোমুখি এখনও হয়নি ওয়াশিংটন। কিন্তু, আগামীতে হবে না– সে নিশ্চয়তা দেয়া যায় না। বিশেষত আলোচিত তিনটি দেশই যখন আমেরিকার চরম বিরোধী এবং প্রতিনিয়ত তাদের স্বার্থের যোগসূত্র এক হচ্ছে।
জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক আধিপত্য ধরে রাখতে বিশ্বের অনেক দেশের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক জোট গড়েছে আমেরিকা। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সহযোগিতার এটাই সর্বোচ্চ মানদণ্ড তার কাছে। এজন্য বিশ্বের নানান প্রান্তের মিত্রদের সাথে ডজন ডজন চুক্তি করেছে ওয়াশিংটন।
এসব চুক্তি আমেরিকানদের চেতনায়, জোট গঠন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু ধারণারও জন্ম দিয়েছে।
যেমন মার্কিনীরা মনে করেন, আমেরিকার বেশিরভাগ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা- দৃঢ় অঙ্গীকারমূলক চুক্তি দ্বারা নির্ধারিত। দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভিন্নতা যার উৎস। ফলে আমেরিকার গঠিত সমর জোটগুলি, একাধিক ক্ষেত্রে নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একত্রে কাজ করে। যেমন- চীন ও রাশিয়ার মতো প্রতিদ্বন্দ্বী মোকাবিলাসহ এর আওতায় মিত্র দেশের বাহিনীকে প্রশিক্ষিত করা, প্রতিরক্ষার পরিকল্পনা ও একসঙ্গে সমর অভিযান পরিচালনায় সক্ষমতা গড়ে তোলা হয়।
মার্কিন জোটগুলিকে তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী: যেমন নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) এবং পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে করা নিরাপত্তা চুক্তিসমূহ, যেগুলি অনেক প্রজন্ম ধরে কার্যকর রয়েছে।
সে তুলনায়, ততোটা সম্ভ্রম জাগায় না ইরান, চীন ও রাশিয়ার সম্পর্ক। এই দেশগুলি একে-অপরকে রক্ষায় প্রকাশ্য কোনো ঘোষণা দেয়নি। পরস্পরের সাথে তাদের সম্পর্কও অবিশ্বাসে ঘেরা।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ইউক্রেনের রণাঙ্গনে রাশিয়াকে একলা ছেড়ে দেয়ায় নিঃসন্দেহে ক্ষুদ্ধ পুতিন। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী তেহরান ও মস্কো।
সে তুলনায়, আমেরিকা ও যুক্তরাজ্য একে অপরের শত্রুতে পরিণত হবে- এমন ভবিষ্যৎ কল্পনা করাও কঠিন। অন্যদিকে, সম্প্রসারণবাদী অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলো এক পর্যায়ে একে-অন্যের গলা কাটতে উদ্যত হবে– পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে সহজেই সে অনুমান করা হয়।
কিন্তু, আমেরিকানরা মিত্রতার যে সংজ্ঞায় বিশ্বাসী– তেমন মিত্র নয়– রাশিয়া, ইরান ও চীন। হয়তো তাদের তা দরকারও নেই।
ঐতিহাসিক বিবেচনায় আমেরিকার জোটগুলিকে ব্যতিক্রমই বলা যায়। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়েও ইউরোপীয় কূটনীতি ছিল বেশ সংকীর্ণ ও পরিবর্তনশীল অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গড়া। যেমন প্রথম মহাযুদ্ধের আগে ব্রিটেন- ফ্রান্স ও রাশিয়ার গঠিত ত্রিপক্ষীয় জোট। কিছু বিষয়ে দুর্বলভাবে ঐক্যমত্য ছিল জোট গঠনকারীদের মধ্যে, ছিল না দৃঢ় প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি। তবু এই জোট মহাযুদ্ধ শুরু হলে একযোগেই লড়েছে।
এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অক্ষশক্তি জার্মানি, ইতালি ও জাপানের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ভিত্তিতেই গঠিত হয় আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত ও ধবংসাত্মক জোট। অথচ তাদের মধ্যে ছিল পরস্পরের সংস্কৃতির প্রতি অশ্রদ্ধা ও বিদ্বেষ।
আমেরিকার বৈরী শক্তিগুলোর সম্পর্ক বিবেচনা করে বলা যায়, তারা ওয়াশিংটনের জোট সংজ্ঞায় উৎরাতে না পারুক, এই সম্পর্ক কৌশলগত দৃশ্যপট বদলাতে প্রকৃত সহযোগিতা স্থাপন করছে কিনা–সেটাই মূল বিবেচ্য।
আর উত্তর হলো হলো 'হ্যাঁ' তারা তা করতে পারছে। চীন ও রাশিয়ার অংশীদারিত্ব প্রধানত ক্রমবর্ধমান অস্ত্র বাণিজ্য, যৌথ সামরিক মহড়া ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নির্ভর। মধ্য এশিয়ায় অগণতান্ত্রিক সরকারগুলিকে টিকিয়ে রাখতে একাট্টা মস্কো ও বেইজিং, যা দুর্বল করছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রচেষ্টা। ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব দিচ্ছে স্বৈরাচার-বান্ধব সেন্সরশিপকে।
তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো– উভয় দেশ একদা তাদের মধ্যে উত্তেজনার কারণ হয়ে থাকা অনেক বিষয়ের সমাধান করতে পেরেছে, যাতে তারা অভিন্ন শত্রু আমেরিকার প্রতি বৈরিতায় মনোযোগ দিতে পারে।
রাশিয়া ও চীন উভয়ই ইরানের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক কামনা করে। ২০১৫ সালে সিরিয়ায় সামরিক মিত্র হয়ে ওঠে রাশিয়া ও ইরান। বাশার আল আসাদ সরকারের পতন ঠেকাতে সেনা পাঠায় তারা। এর মাধ্যমে মার্কিন চালকে বাজিমাৎ দেয় ভূরাজনীতির দাবায়। দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়া ও চীনের দেয়া সমরাস্ত্র ইরানি সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করছে; তাদের সাথে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের বন্ধন– তেহরানকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আঘাত লঘু করার শক্তি দিয়েছে।
২০২১ সালে ইরানের সাথে ২৫ বছর মেয়াদী কৌশলগত অংশীদারিত্বের চুক্তি করে চীন। রাশিয়া-ইরানের সম্পর্ক আরও উল্লেখযোগ্য। খবরে প্রকাশ, ইউক্রেন যুদ্ধ লড়তে মস্কোকে ড্রোন দিচ্ছে ইরান, দিচ্ছে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়ানো যায় এমন অভিজ্ঞতালদ্ধ পরামর্শ। এতে মস্কো বেশ উপকৃতই হচ্ছে।
অন্যদিকে, ইরানের কৃত্রিম উপগ্রহ প্রকল্পে উদার সহায়তা দিচ্ছে রাশিয়া। খাদ্যশস্য কেনার ক্ষেত্রে দিচ্ছে অগ্রাধিকার।
রাশিয়া ও ইরানের এই মেলবন্ধন নিয়ে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভান বলেছেন, 'পুরো বিশ্ব এই সহযোগিতার দিকে লক্ষ্য রাখছে এবং একে মারাত্মক হুমকি বলে মনে করছে'।
অথচ এই সহযোগিতার যুক্তি সহজে বোধগম্য। এই তিনটি স্বৈরাচারী শক্তি অনুদার রাজনৈতিক ব্যবস্থা রক্ষা করে আমেরিকাকে তাদের ভৌগলিক সীমানা থেকে বের করে দিতে চায়। এবং স্নায়ুযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র যে একক বিশ্ব আধিপত্য কায়েম করেছে—তার অবসান চায় একান্তভাবে।
মস্কো, তেহরান ও বেইজিং– একে-অন্যের লড়াই লড়তে চায় না বটে, কিন্তু আমেরিকার মতো প্রযুক্তি ও আর্থিক শক্তিতে বলীয়ান পরাশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে হলে 'সংখ্যাতেই শক্তি' এই পরীক্ষিত সত্যকে মেনে চলছে। বিশ্বের একাধিক প্রান্তে অস্থিতিশীলতা তৈরি করে তারা আমেরিকার শক্তিকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে পারে।
রাশিয়া, চীন ও ইরানের শাসক গোষ্ঠী– সবাই ভালো করেই জানে, আমেরিকা বা তার মিত্ররা যদি তাদের কাউকে চূড়ান্তভাবে হারাতে পারে– তাহলে বাকিরা একা ও দুর্বল হয়ে পড়বে। এই উপলদ্ধিই তাদের দিয়েছে ঐক্যের তাগিদ– পশ্চিমারা একে প্রকৃত জোট না বললেও তাতে সত্য বদলাবে না।
- লেখক: ব্লুমবার্গের কলামিস্ট হাল ব্র্যান্ডস, জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক অধ্যয়ন কেন্দ্রের হেনরি কিসিঞ্জার সম্মাননাপ্রাপ্ত অধ্যাপক। তিনি আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউডের একজন গবেষক।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ