বিজ্ঞানীদের যে আবিষ্কার ভবিষ্যতের জ্বালানি হাইড্রোজেন উৎপাদনে বিপ্লব আনতে পারে...
জ্বালানি সম্পদের অধিকার নিয়ে বিশ্বজুড়ে হানাহানি। যুদ্ধ, সংঘাতময় ভূরাজনীতির এই খেলায় পরাজিত হচ্ছে শুধু মানবতা। দেশে দেশে বাড়ছে ব্যবধান। অথচ পৃথিবী ভাসছে জ্বালানি সাগরে। না জীবাশ্ম জ্বালানি নয়, বরং আমাদের অনন্ত মহাসাগরের পানিই হতে পারে পরিবেশসম্মত জ্বালানির উৎস। অয়েলপ্রাইস ডটকম অবলম্বনে
পানির প্রতিটি অণু– দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু এবং একটি অক্সিজেন পরমাণু দিয়ে গঠিত। তবে নদী, খালবিলসহ অন্যান্য জলাশয়ের পানি স্বাদু বা সুপেয়; যা পরিবেশ ও জনবসতি দুইয়ের জন্যই অপরিহার্য। সে তুলনায়, সাগরের লোনা পানির ভাণ্ডার অগাধ। অস্ট্রেলিয়ার আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তাই এ উৎসের দিকেই মনোযোগ দেন। সফলও হয়েছেন তারা, যাকে এক কথায় যুগান্তকারী বলা অত্যুক্তি হবে না। সাগরের পানি থেকে কম খরচে এবং জ্বালানি সাশ্রয়ী উপায়ে হাইড্রোজেন আহরণের পদ্ধতি তৈরি করেছেন তারা।
এই উদ্ভাবন নিঃসন্দেহে পথপ্রদর্শক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রিন হাইড্রোজেন বা দূষণমুক্ত উপায়ে হাইড্রোজেন উৎপাদনের দিকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি।
পদ্ধতিটি সম্পর্কে আরএমআইটি জানায়, এর মাধ্যমে সাগরের পানি বিশ্লেষণ করে সরাসরি হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন আহরণ করা যায়, দরকার হয় না লবণাক্ততা মুক্ত করার বাড়তি আরেকটি ধাপ। ফলে একদিকে যেমন অর্থ সাশ্রুয় হয়, তেমনি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় প্রচলিত জ্বালানিও অনেক কম লাগে। ফলে কার্বন নিঃসরণও কমে আসে।
পরীক্ষাগারে সফলভাবে প্রয়োগ করার পর পদ্ধতিটি সম্পর্কে জানানো হয়েছে বৈজ্ঞানিক জার্নাল– উইলি জার্নাল,স্মলে প্রকাশিত এক নিবন্ধে।
হাইড্রোজেনকে বলা হচ্ছে বিশ্বের ভবিষ্যৎ জ্বালানি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন আগামী দিনে জীবাশ্ম জ্বালানিকে হটিয়ে দেবে। শিল্প উৎপাদনেও আসবে বিপ্লব। অনেক শিল্পে জীবাশ্ম জ্বালানি যেমন তেল, গ্যাস বা কয়লা ব্যবহার করতেই হয়, তাদের পক্ষে কার্বন-নিঃসরণ পুরোপুরি বন্ধ করাটা তাই বেশ কঠিন। হাইড্রোজেন জ্বালানি তাদের কার্বন-মুক্ত হতে সহায়তা করবে। এভিয়েশন ও শিপিং শিল্পেও আনবে যুগান্তকারী বিপ্লব।
তবে এপর্যন্ত দূষণমুক্ত উপায়ে হাইড্রোজেন উৎপাদনের পরিমাণ কম। বলতে গেলে, বর্তমানে অধিকাংশ হাইড্রোজেন জ্বালানি-ই উৎপাদন করা হচ্ছে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে। বছরে এই শিল্প ৮৩ কোটি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করছে, যা যুক্তরাজ্য ও ইন্দোনেশিয়ার বার্ষিক নির্গমণের সমান।
অন্যদিকে, পানি বিশ্লেষিত করার মাধ্যমে উৎপাদিত হয় 'গ্রিন' হাইড্রোজেন; কিন্তু এর প্রচলিত উৎপাদন প্রক্রিয়া এতই ব্যয়বহুল যে, বাণিজ্যিকভাবে তা লাভজনক নয়। বর্তমানে তা বৈশ্বিক হাইড্রোজেন উৎপাদনের মাত্র ১ শতাংশ।
আরএমআইটি-র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং গবেষণায় নেতৃত্বদানকারী ড. নাসির মাহমুদ জানান, (প্রচলিত পদ্ধতির) গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদন একইসঙ্গে খুবই ব্যয়বহুল, এবং স্বাদু বা লবণমুক্ত পানির ওপর নির্ভর করে।
বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, "পরিচ্ছন্ন জ্বালানি উৎস হিসেবে হাইড্রোজনের অপার সম্ভাবনার বিষয়টি আমাদের অজানা নয়, বিশেষত সেইসব শিল্পের জন্য যাদের পক্ষে সহজে নবায়নযোগ্য জালানি-নির্ভর হওয়ার উপায় নেই। হাইড্রোজেন সরবরাহ তাদের নতুন পথ দেখাবে। কিন্তু, এজন্য উৎপাদিত হাইড্রোজেনের সম্পূর্ণ উৎপাদন চক্রকেই শতভাগ কার্বনশূন্য হতে হবে। একইসঙ্গে, এটি যেন বিশ্বের অমূল্য সুপেয় পানির মজুতকে ব্যবহার না করে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
"সাগরের পানি থেকে হাইড্রোজেন উৎপাদনের আমাদের পদ্ধতিটি সরল, বড় পরিসরে বাস্তবায়নযোগ্য এবং বর্তমানে যেসব প্রচলিত উপায়ে গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদিত হচ্ছে তার চেয়ে খরচ সাশ্রয়ী। আমাদের প্রত্যাশা, এই পদ্ধতি অস্ট্রেলিয়ায় দ্রুত বর্ধনশীল গ্রিন হাইড্রোজেন শিল্প গড়ে তুলবে"- যোগ করেন ড. নাসির।
গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদন পদ্ধতি
গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদনের জন্য বর্তমানে লবণমুক্ত করা বা মিঠাপানিতে ইলেকট্রোলাইজার ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত করা হয়, এই বিদ্যুৎ প্রবাহ পানির অণুকে তার মৌলিক উপাদান অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনে বিভাজিত করে ফেলে।
বর্তমানে ব্যবহৃত ইলেকট্রোলাইজারগুলো বেশ দামি ক্যাটালিস্ট ব্যবহার করে; এগুলো চালাতে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ শক্তি ও পানির প্রয়োজনও হয়। যেমন ৯ লিটার পানি থেকে মাত্র এক কিলোগ্রাম হাইড্রোজেন উৎপাদন করতে পারে। তারা ক্লোরিনের মতো বিষাক্ত উপাদানও নির্গমন করে।
ড. নাসির বলছিলেন যে, "সমুদ্রের পানি ব্যবহারের প্রধান সমস্যা-ই ক্লোরিন, যা এই প্রক্রিয়ায় বাইপ্রোডাক্ট (উপজাত) হিসেবে তৈরি হয়। আমরা যদি, এই বিপত্তি দূর না করেই সাগরজল থেকে গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদন করি, তাহলে বছরে ২৪ কোটি টন ক্লোরিন উৎপন্ন করব– যা হবে ক্লোরিনের বৈশ্বিক চাহিদার তিন থেকে চারগুণ বেশি। আবার জীবাশ্ম জ্বালানি দিয়ে উৎপাদন করা হাইড্রোজেনও বিকল্প নয়, এটা ঘুরেফিরে পরিবেশের ক্ষতিই করে চলবে।
"আমাদের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন নেই, উপজাত হিসেবে ক্লোরিনও উৎপন্ন হয় না"- যোগ করেন তিনি।
এজন্য সাগরজল ব্যবহারের জন্য বিশেষ ধরনের একটি ক্যাটালিস্ট তৈরি করেছেন– আরএমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি ম্যাটারিয়েলস ফর ক্লিন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রোমেন্টের বিজ্ঞানী দল।
গবেষণার সময় তারা অতি-কার্যকর অথচ ব্যয়-সাশ্রয়ীভাবে উৎপাদন করা যাবে এমন ক্যাটালিস্ট তৈরির লক্ষ্য দেন।
গবেষণায় জড়িত ও পিএইচডি-রত গবেষক সুরাজ লুম্বা বলেন, "একটি সরল পদ্ধতিতে ক্যাটালিস্টের অভ্যন্তরীণ রাসায়নিক প্রক্রিয়াকে পরিবর্তনের দিকে আমরা মনোযোগ দেই। ফলে এটি সহজে উৎপাদন করে বৃহৎ পরিসরে (গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদন শিল্পে) জল বিভাজনে ব্যবহার করা সম্ভব হবে।"
ড. নাসির বলেন, "নতুন এসব ক্যাটালিস্ট চালাতে তুলনামূলক সামান্য পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তির প্রয়োজন হয়, এমনকী রুম টেম্পারেচারেও ব্যবহার করা যায়। সাগরজল বিভাজনে পরীক্ষামূলকভাবে অন্যান্য ক্যাটালিস্ট তৈরি হয়েছে এর আগে; কিন্তু সেগুলো বেশ জটিল, বড় পরিসরে সেগুলো ব্যবহারও করাও কঠিন।"
তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, নতুন এই প্রযুক্তি ইলেক্ট্রোলাইজারের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। অস্ট্রেলিয়ার সরকারের প্রাক্কলন, জীবাশ্ম জ্বালানি-ভিত্তিক হাইড্রোজেনের সাথে প্রতিযোগিতায় সক্ষম হতে হলে গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদনের খরচ হতে হবে প্রতি কিলোগ্রামে মাত্র ২ অস্ট্রেলিয় ডলার। এই প্রযুক্তি সে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে বলে জানান ড. নাসির মাহমুদ।
এই প্রযুক্তিকে আরো উন্নত করতে সহযোগী বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করছেন আরএমআইটির গবেষকরা। গবেষণার পরবর্তী ধাপে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন উৎপাদনের জন্য একটি ইলেকট্রোলাইজার প্রোটোটাইপ তৈরি করা হবে।
এরমধ্যেই সাগরের পানি থেকে হাইড্রোজেন উৎপাদনের এই পদ্ধতির জন্য প্রাথমিক পেটেন্টের আবেদন করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্র উপকূলে যেখানে সুর্যালোক ও বায়ু প্রবাহ প্রচুর, সেখানে সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের অপার যে সম্ভাবনা রয়েছে, সেই শক্তিকে ব্যবহার করেই আগামীর জ্বালানি গ্রিন হাইড্রোজেন উৎপাদন করা যাবে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদনে তখন বিশাল বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে প্রত্যাশিত ভালো মুনাফা তৈরির জন্য এই প্রযুক্তিকে অন্তত কয়েক দশক স্থায়ী হতে হবে।
অবশ্য, এপর্যন্ত হাইড্রোজেন উৎপাদনের যত পদ্ধতি তৈরি হয়েছে তার মধ্যে আরএমআইটি'র বিজ্ঞানীদের তৈরি পদ্ধতিই সবচেয়ে সফল ও সৃজনশীল। নিম্ন তাপমাত্রায় ও কম শক্তি ব্যবহার করায় এর বাণিজ্যিক সম্ভবনা অফুরান। তার সাথে, সাগরজল লবণমুক্ত না করেই ব্যবহারের সুবিধা; ক্লোরিনমুক্ত উৎপাদন ব্যবস্থা– রীতিমতো সাড়া ফেলতে চলেছে জ্বালানি শিল্পে।