রাশিয়ার যুদ্ধ বিষয়ক ব্লগার কারা, তারা কেন এত জনপ্রিয়?
গত ২রা এপ্রিল রাশিয়ার সেন্ট পিটারসবার্গে এক বিস্ফোরণে নিহত হন আলোচিত 'ওয়ার কারেসপন্ডেন্ট' বা যুদ্ধবিষয়ক প্রতিনিধি ভ্লাদলেন তাতারস্কি। তবে তিনি 'ওয়ার ব্লগার' হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন। খবর বিবিসির।
ভ্লাদলেনের মতো অনেকেই একেবারে ফ্রন্টলাইনে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের রিপোর্টিং করছেন। এদের বেশিরভাগের মতাদর্শই ইউক্রেন এবং পশ্চিমা বিরোধী।
বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়ান ভাষায় এসব সংবাদদাতাদের 'ভয়েনকরি' নামে ডাকা হয়। এরা মূলত নিজেদের সামরিক জ্ঞানসমৃদ্ধ বিশেষজ্ঞ বলে দাবি করে থাকেন এবং রাশিয়ান সৈন্যদের কাছে প্রবেশাধিকার আছে বলেও প্রচার করেন।
সংবাদদাতাদের অনেকে 'এমবেডেড' হিসেবে সৈন্যদের সাথে অবস্থান করেন। আবার কেউ কেউ সৈন্যদের সাথে মিলে যুদ্ধও করেন।
তবে এ সংবাদদাতারা রাশিয়ান সরকারের সাথে কতটুক ঘনিষ্ঠ তা নিয়ে ভিন্নতা রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই ক্রেমলিন নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে চাকরি করেন আবার অন্যরা কোনো গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত না থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্লগ করেন।
রাশিয়ান দর্শকদের কাছে এসব সংবাদদাতারা বেশ জনপ্রিয়। কেননা, অফিশিয়াল রিপোর্টের বাইরেও যুদ্ধ সম্পর্কে এরা তথ্য প্রকাশ করে থাকেন।
সাম্প্রতিক সময়ে এসব সংবাদদাতাদের কার্যক্রম নতুন নয়। বরং ২০১৪ সালে ইউক্রেনে প্রাথমিক আক্রমণের পর তাদের উত্থান রাশিয়ায় যুদ্ধ প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল।
সংবাদদাতারা যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন করলেও সবসময় যে মস্কো কর্তৃপক্ষ কিংবা যুদ্ধে থাকা সামরিক কমান্ডারের সমর্থন করেন বিষয়টা এমন নয়। উদাহরণস্বরূপ, মাকিভকা শহরে ইউক্রেনের মিসাইল হামলায় কয়েক ডজন রাশিয়ার সৈন্য নিহতের ঘটনায় এসব সংবাদদাতারা রাশিয়ান কমান্ডারদের সমালোচনা করেন।
এমনই একজন হলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করা সেমিঅন পেগভ। মাকিভকায় ইউক্রেনের আক্রমণের ঘটনায় সেমিঅন রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি দায় এড়ানোর অভিযোগ তুলে সমালোচনা করেন।
সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম টেলিগ্রামে সেমিঅনের প্রায় ১.২ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। রাশিয়ায় নিষিদ্ধের তালিকায় না থাকা অল্প কয়েকটি সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মের মধ্যে এটি অন্যতম।
বরিস রযহিন নামের আরেক ব্লগার 'কর্নেল কাসসাদ' নামে ব্লগ করে থাকেন। টেলিগ্রামে তার প্রায় ৮ লাখ সাবস্ক্রাইবার রয়েছে। তিনিও রাশিয়ান কমান্ডারদের 'অযোগ্যতা ও যুদ্ধের পরিণতি বোঝার অক্ষমতা' এর অভিযোগে কড়া সমালোচনা করেছেন।
ওয়াগনার প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানির সাথে সংশ্লিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলো থেকেও যুদ্ধে রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক পোস্ট করা হয়েছে।
অনেকের মতে, রাশিয়ান সামরিক কমান্ডারেরা এসব ব্লগারদের হুমকি মনে করেন। এমনকি কমান্ডারেরা সংবাদদাতা ও ব্লগারদের মুখ বন্ধ করানোর জন্য বহু চেষ্টাও করে থাকেন।
অন্যদিকে ক্রেমলিনভিত্তিক গণমাধ্যমগুলোর সংবাদদাতারা সামরিক বাহিনী কর্তৃক প্রদত্ত অফিসিয়াল তথ্যই প্রকাশ করে থাকেন। কমসোমলসকায়া প্রাভদা নামের এক ট্যাবলয়েডের হয়ে কাজ করা আলেকজেন্ডার কটস তেমনি একজন।
ভ্লাদলেনের নিহত হওয়ার খবরে রাশিয়ান অফিসিয়ালদের সাথে তাল মিলিয়ে কটসও ইউক্রেনের দিকেই মূল অভিযোগ তুলেছেন। তার মতো এমন রিপোর্টাররাই গণমাধ্যমে যুদ্ধ সম্পর্কে ক্রেমলিনের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করেন বলে অনেকে অভিযোগ করেন।
যেমন, রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি স্টেশন রসিয়া ১ এর হয়ে যুদ্ধ কাভার করেন ইয়েভজেনি পডডাবনি নামের এক সংবাদদাতা। ২০২২ সালের জুলাইতে দনবাসের পাওয়ার স্টেশন থেকে তিনি আচমকা জানান যে, অঞ্চলটি ওয়াগনার গ্রুপ দখল করেছে।
ইয়েভজেনির এ সংবাদের পর থেকেই রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমগুলোতে ওয়াগনার গ্রুপ নিয়ে রিপোর্ট করা শুরু হয়। অথচ এর আগে যুদ্ধে গ্রুপটির অস্তিত্ব পর্যন্ত অস্বীকার করা হয়েছে।
যুদ্ধে ক্রেমলিনের হয়ে প্রপাগান্ডা চালানোর অভিযোগে কটস ও ইয়েভজেনিকে পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে।
আবার যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন দেয়া বহু জনপ্রিয় রাশিয়ান সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট পরিচয় প্রকাশ ছাড়াই চালানো হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব একাউন্ট থেকে নানা গ্রাফিক কন্টেন্ট পোস্ট করা হয়।
এমনি একটি টেলিগ্রামভিত্তিক চ্যানেলের নাম 'গ্রে জোন'। ওয়াগনার গ্রুপের সাথে সম্পর্কিত এ টেলিগ্রাম চ্যানেল থেকে গত বছরের নভেম্বরে একজনকে 'বিশ্বাসঘাতক' পরিচয় দিয়ে হাতুড়ি দিয়ে হত্যা করার ফুটেজ পোস্ট করা হয়।
রাশিয়ার যুদ্ধ বিষয়ক সংবাদদাতাদের অনেকেই আবার স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউক্রেনের ধ্বংস কামনা করেন। যেমন, ইয়ুরি কটেনক নামক এক সংবাদদাতা টেলিগ্রামে সকল ইউক্রেনীয় সত্ত্বা ধংসের আহ্বান জানিয়েছেন। টেলিগ্রামে তার ৪ লাখেরও বেশি সাবস্ক্রাইবার রয়েছে।