৪২ বছর অপেক্ষার পর ৯০ বছর বয়সী অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
গত সপ্তাহে ভারতে ৯০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ ৪২ বছর আগে দেশটির উত্তর প্রদেশের এক গ্রামে দলিত সম্প্রদায়ের ১০ জন মানুষকে হত্যার ঘটনায় এ শাস্তি দেওয়া হয়। খবর বিবিসির।
রায়ের পর ভুক্তভোগী পরিবারগুলো জানিয়েছে, আদালত রায় দিতে এতই দেরি করেছে যে এখন আর এই বিচার তাদের কাছে কোনো অর্থ বহন করে না।
অন্যদিকে আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মামলাটি 'বিলম্বে বিচার মানে বিচারের নামে প্রহসন' প্রবাদের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে রইল।
ঘটনার শুরু ১৯৮১ সালের ৩০ ডিসেম্বর। উত্তর প্রদেশের সাধুপুর গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ বাসিন্দাদের জন্য যেন দিনটি ভোলার মতো নয়।
গ্রামটির প্রেমভাতি নামের এক বাসিন্দা (তিনি মনে করেন তার বর্তমান বয়স প্রায় ৭৫) দিনটি সম্পর্কে বলেন, "একদল পুরুষ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে আমার বাড়ির চত্বরে প্রবেশ করে গুলি চালাতে থাকে। তারা আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। তারা শুধু আমাদের দিকে গুলি ছুড়ছিল।"
প্রেমভাতি জানান, গুলি চালানোর কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার তিন সন্তান চোখের সামনেই নিহত হন। এদের মধ্যে দুই ছেলের বয়স ছিল ৮ ও ১০ বছর এবং মেয়ের বয়স ছিল ১৪ বছর।
কোর্টের নির্দেশে ফটোগ্রাফার ও ক্যামেরাম্যানরা গ্রামটি পরিদর্শনে গেলে প্রেমভাতি ঐ ঘটনায় নিজের শরীরে থাকা ক্ষত দেখান। ছবিতে দেখা যায়, তার ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন রয়েছে। ক্ষত শুকিয়ে গেলেও সেদিনের দাগ যেন আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন এই বৃদ্ধা।
৩০ ডিসেম্বরের সেই সন্ধ্যার প্রেমভাতির তিন সন্তানসহ আরো ১০ জন দলিতকে হত্যা করা হয়। ঐদিন আহত হওয়া দুই নারীর মধ্যে তিনি একজন।
গত সপ্তাহের বুধবার বিচারক হারভির সিং এর নেতৃত্বাধীন ফিরোজাবাদের জেলা আদালত ঐ ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে একমাত্র জীবিত গঙ্গা দয়ালকে সাজা প্রদান করে। সাজাপ্রাপ্ত ইয়াদাব সম্প্রদায়ের এ ব্যক্তিকে একইসাথে ৫৫ হাজার রূপি জরিমানা ও অনাদায়ে আরও ১৩ মাসের কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
মামালাটির রায়ে বলা হয়, অভিযুক্ত ১০ জনের মধ্যে ৯ জনই বিচার চলাকালীন মৃত্যুবরণ করেছেন। মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রাজিব উপাধ্যায় জানান, মামলার বেশিরভাগ প্রসিকিউটর ও বাদী পক্ষের সাক্ষীরাও মামলা চলাকালীন মৃত্যুবরণ করেছেন।
প্রেমভাতি এবং দলিত সম্প্রদায়ের অন্য গ্রামবাসিরা জানান, তাদের পরিবারের সাথে কারও শত্রুতা ছিল না।
কিন্তু আইনজীবী রাজিব উপাধ্যায় জানান, দলিত সম্প্রদায় ও ইয়াদাব সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটে এক দোকানকে কেন্দ্র করে। দলিত সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ ইয়াদাব সম্প্রদায়ের মালিকানাধীন একটি রেশনের দোকান নিয়ে অভিযোগ করলে দ্বন্দ্বের শুরু হয়।
তৎকালীন সময়ে হত্যার ঘটনাটি বেশ আলোচিত হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাব সিং গ্রামটি পরিদর্শন করে বিচারের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন।
এমনকি সে সময়ের বিরোধী দল বিজেপির সিনিয়র নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী, যিনি পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন, হত্যাকারীদের বিচারের দাবি নিয়ে গ্রামটিতে মার্চ করেছিলেন।
আদালতের রায়ের পর সাংবাদিকেরা গ্রামবাসীদের কাছে এ বিষয়ে অনুভূতি জানতে গেলে তারা রায়ের খবরটি জানতে পারেন।
রায়ের বিষয়ে প্রেমভাতি বলেন, "অটল বিহারী বলেছিলেন, তিনি নিহত হওয়া মানুষগুলোকে আর ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। কিন্তু উপযুক্ত বিচার যাতে নিশ্চিত হয় সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন, এটা কি আসলেই বিচার না-কি!"
প্রেমভাতির থেকে বয়সে বেশ ছোট মহারাজ সিংও সেই ঘটনায় নিজের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছিলেন। ঐ বিকেলের হত্যাকাণ্ডের গল্প শুনে শুনেই তিনি বড় হয়েছেন।
মহারাজ সিং বলেন, "অবশেষে আমরা যে বিচার পেয়েছি, সেটাকে সাধুবাদ জানাই। তবে রায়টি সঠিক সময়ে দেওয়া হয়নি। খুশি হতাম যদি আমরা সময়মত বিচারটা পেতাম।"
মামলাটি নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতার কারণ হিসেবে আইনজীবী উপাধ্যায় জানান, ১৯৮১ সালে হত্যাকাণ্ডের সময় গ্রামটি মাইনপুরি জেলার অধীনে ছিল। কিন্তু ১৯৮৯ সালে গ্রামটি নবগঠিত ফিরোজাবাদ জেলার অধীনে চলে যায়।
গ্রামটি নতুন জেলার অধীনে চলে যাওয়ার দীর্ঘ ১২ বছর পর্যন্ত মামলাটির ফাইল মাইনপুরি জেলাতেই আটকে থাকে। অবশেষে ২০০১ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের আদেশে মামলার ফাইল ফিরোজাবাদ কোর্টে নিয়ে আসা হয়।
আইনজীবী উপাধ্যায় জানান, মামলার শুনানি শুরু হয় তারও দুই দশক পরে, অর্থাৎ ২০২১ সালে। কেননা তখন সরকার জরুরী ভিত্তিতে দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা মামলাগুলো নিষ্পত্তির পদক্ষেপ নেয়।
অন্যদিকে আইনজীবী আকশাত বাজপাই মনে করেন, অপরাধের বিচার সময় মতোই হওয়া উচিত। দুই-তিন বছর দেরি হলে মানুষ সেটা মেনে নিতে পারে। কিন্তু ৪০ বছরের দীর্ঘসূত্রিতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আইনজীবী আকশাত বাজপাই বলেন, "সঠিক সময়ে বিচার নিশ্চিতের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বিশেষ করে প্রেমভাতির মতো দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের ক্ষেত্রে সেটা আরও প্রযোজ্য। কেননা তারা দেশের সবচেয়ে প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি। এটা ভারতীয় ফৌজদারি বিচার বিভাগের ব্যর্থতা যে, ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে দীর্ঘ ৪২ বছর ধরে যন্ত্রণার মধ্যে বাস করতে হয়েছে।"
তবে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার ক্ষেত্রে এই মামলাটি যে খুব বেশি ব্যতিক্রম, এমনটি নয়। বরং ভারতীয় ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় প্রচণ্ড ধীরগতির কারণে আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হতে প্রায় বছরের পর বছর এমনকি কয়েক দশকও সময় লেগে যায়।
আদালতের এমন প্রবণতার ফলে অসংখ্য মামলা নিষ্পত্তি না হয়ে বহুদিন ধরে ঝুলে আছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পার্লামেন্টে জানানো হয়, ভারতের আদালতগুলোতে প্রায় ৫ কোটি মামলা এখনো ঝুলে আছে।
লাইভ ল ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা ও ভারতীয় ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ এমএ রশিদ জানান, ভারতে মামলার দীর্ঘসূত্রিতার অন্যতম কারণ অপর্যাপ্ত বিচারক। এছাড়া বিচারকাজে এখনো প্রাচীন পদ্ধতির ব্যবহার আরেকটি কারণ। যেমন, এখনো একজন বিচারককে প্রযুক্তি ব্যবহারের বদলে নিজ হাতে সাক্ষ্য লিখতে হয়।
আইন বিশেষজ্ঞ এমএ রশিদ বলেন, "জনসংখ্যার অনুপাতে ভারতে বিচারকের সংখ্যা বেশ কম। প্রত্যেক বিচারকের ওপর প্রচণ্ড চাপ থাকে। তাই বিচারকাজ শেষ হতে অনেক সময় লাগে।"
ভারতের হাইকোর্টে করা আপিলের চূড়ান্ত শুনানি হতে অন্তত ৫ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যায় বলে জানান এমএ রশিদ। এমনকি সেটি সুপ্রিম কোর্টে মীমাংসা হতে আরও ৫ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যায়।
এ সম্পর্কে এমএ রশিদ বলেন, "তাই ভারতে একজন আসামির ২০ থেকে ৩০ বছর পর আপিল পর্যায়ে খালাস পাওয়ার ঘটনাও অস্বাভাবিক নয়।"