রাশিয়ায় পুতিন-কিমের সাক্ষাৎ; একইদিনে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা
উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আজ (বুধবার) রাশিয়ায় সাক্ষাৎ করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে যে, চলমান বৈঠকে এই দুই নেতা মস্কো ও পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যকার অস্ত্র চুক্তি নিয়ে আলোচনা করবেন।
সাক্ষাতের নির্ধারিত সময় কিংবা স্থান নিয়ে দুই দেশের পক্ষ থেকে আগে থেকে কিছুই জানানো হয়নি। তবে রয়টার্সের তথ্যমতে, পুতিন রাশিয়ার সূদুর পূর্বাঞ্চলের আমুরে অবস্থিত ভোসতোচনি রকেট ও মহাকাশ কেন্দ্রে সফর করেছেন। সেখানেই হচ্ছে পুতিন ও কিমের সাক্ষাৎ।
এর আগে আরআইএ নিউজ এজেন্সির রিপোর্ট মতে, সফর সম্পর্কে পুতিন বলেন, "আমার সেখানে নিজস্ব অনুষ্ঠান রয়েছে। এই সম্পর্কে আমি সেখানে গেলেই আপনারা বিস্তারিত জানতে পারবেন।"
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে যে, সাক্ষাতে কিম সম্ভবত ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে অস্ত্র সরবারাহের প্রস্তাবে রাজি হতে পারে। আর বিনিময়ে উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার কাছ থেকে খাবার এবং নিউক্লিয়ার চালিত সাবমেরিন ও স্পাই স্যাটেলাইটের প্রযুক্তি সহায়তা চাইতে পারে।
সাক্ষাৎ সম্পর্কে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন জানান, তিনি কিমের সাথে উত্তর কোরিয়ার স্যাটেলাইট প্রোগ্রামসহ নানা ইস্যু নিয়ে আলোচনা করবেন।
সাক্ষাতে রাশিয়াকে উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে অস্ত্র সরবারাহের বিষয়ে আলোচনা হবে কি-না সে সম্পর্কে জানতে চাইলে পুতিন বলেন, "আমরা সব বিষয় নিয়েই আলোচনা করবো।"
মহাকাশ কেন্দ্রে সাক্ষাতের শুরুতে পুতিন প্রায় ৪০ সেকেন্ড ধরে কিমের সাথে করমর্দন করেন। এরপর পুতিন কিমকে বলেন, "আমি আপনার সাক্ষাৎ পেয়ে আনন্দিত। এটা আমাদের নতুন কসমোড্রোম।"
কিম মূলত একজন দোভাষীর মাধ্যমে পুতিনের সাথে কথা বলছিলেন। আমন্ত্রণ জানানোয় ও উষ্ণ অভ্যর্থনা প্রদান করায় কিম পুতিনকে ধন্যবাদ জানান।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক জটিল সমীকরণে রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া দুই দেশই বর্তমানে বেশ কয়েকটি নিষেধাজ্ঞায় রয়েছে। এমতবস্থায় দেশ দুটির দুই শীর্ষ নেতার বৈঠককে বেশ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে ওয়াশিংটন ও মার্কিন মিত্ররা।
বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালীন সম্ভাব্য অস্ত্র চুক্তি নিয়ে দেশগুলো বেশ শঙ্কিত। যদিও এমন চুক্তি হওয়ার কথা বরাবরই অস্বীকার করে আসছে মস্কো ও পিয়ংইয়ং।
সাক্ষাতের স্থান হিসেবে ভোসতোচনি রকেট ও মহাকাশ কেন্দ্রেকে বেছে নেওয়ার পেছনেও অবশ্য রাজনীতি দেখছেন বিশ্লেষকেরা। কেননা এটি স্পেস প্রযুক্তিতে মস্কোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও শক্তিমত্তার প্রতীক। অন্যদিকে উত্তর কোরিয়া গত চার মাসে দুবার রিকনেসান্স স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করতে যেয়ে ব্যর্থ হয়েছে।
স্যাটেলাইট তৈরিতে রাশিয়ার পক্ষ থেকে উত্তর কোরিয়াকে সহযোগিতা করা হবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে পুতিন বলেন, "আমরা কিন্তু এজন্যই এখানে এসেছি। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম রকেট ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে বেশ আগ্রহ দেখিয়েছেন। তারা স্পেস প্রযুক্তিতে উন্নতি করার চেষ্টাও করছেন।"
উত্তর কোরিয়া ইতিমধ্যেই পরমাণু অস্ত্র থেকে শুরু করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রে সক্ষমতা অর্জন করেছে। এবার নিজেদের স্পাই স্যাটেলাইট তৈরির বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব সহকারে দেখছেন কিম।
আরআইএ কর্তৃক প্রকাশিত ফুটেজে দেখা যায়, কিম ও পুতিনকে সাক্ষাতের সময় নিরাপত্তা কর্মী ও রুশ গণমাধ্যম কর্মীরা চারপাশে ঘিরে রেখেছেন। এই দুই নেতা হাসিমুখে হাত মেলাচ্ছেন। পরবর্তীতে কাঁচের দেয়াল ঘেরা একটি বিল্ডিংয়ে এই দুই নেতা একসাথে হেঁটে প্রবেশ করেন।
টেলিভিশন ফুটেজে দেখা যায়, পুতিন ঘুরে ঘুরে কিমকে মহাকাশ কেন্দ্রের সুযোগ-সুবিধা দেখাচ্ছেন। অন্যদিকে কিম এগুলো নিয়ে পুতিনের কাছে বেশ বিস্তারিতভাবে জানতে চাচ্ছেন।
এদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান সরকারের দাবি মতে, কিম ও পুতিনের সাক্ষাতের কয়েক ঘণ্টা আগে উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ের কাছের একটি এলাকা থেকে সমুদ্রে দুটি স্বল্প-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, কিম দেশের বাইরে থাকা অবস্থায় উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ঘটনা এটাই প্রথম। তিনি ক্ষমতার ১২ বছর ধরে থাকলেও মাত্র সাতবার দেশের বাইরে সফর করেছেন। যার সবগুলোই ছিল ২০১৮ ও ২০১৯ সালে।
ইন্টারফ্যাক্স নিউজ এজেন্সির তথ্যমতে, অস্ত্র চুক্তি নিয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তবে তিনি জানান, দুই দেশ কিছু 'সংবেদনশীল' ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছে; যেটি জনসম্মুখে বলা হবে না।
এদিকে গতকাল (মঙ্গলবার) পেসকভ বলেন, "কিমের সফরটি বেশ কার্যকরী হবে এবং এতে উভয় পক্ষই আলোচনা করবে। উত্তর কোরিয়াকে মানবিক সহায়তা এবং দেশটির উপর আরোপিত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব নিয়েও আলোচনা হতে পারে।"
অন্যদিকে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, কিম ও পুতিনের বৈঠক বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনশীল অবস্থার প্রেক্ষাপটে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, "দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একইসাথে কোরীয় উপদ্বীপের পরিস্থিতি অবশ্যই এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বিবেচনায় বিষয়।"
কিম গতকাল (মঙ্গলবার) শীর্ষ সামরিক সহযোগীদের নিয়ে ব্যক্তিগত ট্রেনে করে রাশিয়ায় উদ্দেশে রওনা হন। এক্ষেত্রে আলোচনা শেষে উত্তর কোরিয়া যদি অস্ত্র চুক্তিতে রাজি হয়; তবে ইউক্রেন যুদ্ধে এর একটা স্বল্পমেয়াদী প্রভাব থাকবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তবে অস্ত্রগুলোর সার্বিক মান বিবেচনায় সেটি যুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী কোনো প্রভাব রাখতে পারবে কি-না; সেই বিষয়ে অনেকেই সন্দিহান।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাশিয়া। এমতবস্থায় উত্তর কোরিয়ার সাথে অস্ত্র চুক্তি করলে সেটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশনের লঙ্ঘন হবে বলে মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া।
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে প্রকাশ্যে সমর্থন প্রদান করা অল্প কয়েকটি দেশের মধ্যে উত্তর কোরিয়া অন্যতম। গত সপ্তাহেই পুতিন উত্তর কোরিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও উন্নত করার কথা বলেছিলেন।