অ্যাপের মাধ্যমে যেভাবে পড়তে ও লিখতে শিখছেন সোমালি নারীরা
হোদান আর্টান, সোমালিল্যান্ডের রাজধানী হারগেইসাতে বসবাস করা এক দরিদ্র নারী। রাজধানীতে তিনি একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মী হিসেবে কাজ করেন। এটি থেকে খুব সামান্যই আয় করেন তিনি। খবর বিবিসির।
২৩ বছর বয়সী একজন সিংগেল মাদার হিসেবে হোদান নিজের কন্যা সন্তানকে নিয়ে থাকেন একটি মাটির কুঁড়েঘরে। যার ছাদ শক্ত কোনো আবরণে নয়, বরং কাপড় দিয়ে ঢাকা। বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় এরচেয়ে বেশি কিছুর আশা করার সামর্থ্য তার নেই।
নিজের শৈশব সম্পর্কে হোদান বলেন, "আমি যখন ছোট ছিলাম, আমাকে স্কুলে পাঠানোর মতো অবস্থা পরিবারের ছিল না। আমার বাবা-মায়ের ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছে।"
স্কুলের শিক্ষার সুযোগ না পাওয়ায় হোদান পড়তে কিংবা লিখতে পারতেন না। তবে কয়েক মাস আগে তিনি 'দারিজ' নামের একটি অ্যাপের খোঁজ পান। এই অ্যাপটি দেশজুড়ে প্রায় ৪ লাখ ১০ হাজার মানুষকে পড়তে ও লিখতে শেখাচ্ছে।
বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় হোদান নিজের ফোনে অ্যাপটির মাধ্যমে শিখতে শুরু করেন। মাত্র দুই মাস সময়ের মধ্যে তিনি বেশ অভাবনীয় উন্নতি করেন। এখন তিনি সোমালি ভাষায় পড়তে পারেন এবং কিছু ছোটগল্প পড়ে বুঝতেও পারেন।
সোমালিয়া দীর্ঘ সময় ধরে নিরক্ষরতার সমস্যায় ভুগছে। এমতবস্থায় অ্যাপটি ব্যবহার করে হোদানের মতো অনেকেই শিক্ষিত হচ্ছেন।
১৯৯১ সালে গৃহযুদ্ধ চলাকালীন সোমালিল্যান্ড স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তবে এটি একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয়। কিন্তু এটিতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার রয়েছে এবং সোমালিয়ার বাকি অংশের চেয়ে তুলনামূলক বেশি স্থিতিশীলতা রয়েছে।
যুদ্ধের রেশ, দুর্বল অবকাঠামোর ও একের পর এক খরা অঞ্চলটিকে যেন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। যার ফলে এটি বিশ্বের সর্বনিম্ন সাক্ষরতার একটি অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
২০২২ সালের ইউনিসেফের তথ্যমতে, প্রতি চার জনের তিনজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পড়তে ও লিখতে পারেন না। আর প্রতি চার জনের একজন শিশু স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই।
২০১৯ সালে সোমালিল্যান্ড সরকার ও ইউনিসেফ যৌথ অর্থায়নে শিশুদের শিক্ষা লাভের সুযোগ প্রদানের ওপর কাজ শুরু করে। মূলত শিশুরা যাতে অন্তত প্রাথমিক স্কুলের পড়াশোনাটা শেষ করতে পারে সেটির দিকে নজর দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও অঞ্চলটির অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।
এ সম্পর্কে ইউনিসেফ সোমালিয়ার এডুকেশন প্রধান পিটার কোয়ামো বলেন, "জনসংখ্যার বেশিরভাগই গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। তারা অনেকটা বিচ্ছিন্ন। আবার কেউ কেউ প্রতিনিয়ত বাসস্থান পরিবর্তন করছেন।"
পিটার কোয়ামো আরও বলেন, "শুধু সোমালিল্যান্ডই নয়, বরং সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদানেরও বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর অবস্থা এমনই। এই শিশুদের এবং পরিবারগুলির শিক্ষা নিশ্চিত করা বেশ কঠিন।"
এই অঞ্চলের মানুষদেরকে কীভাবে সহজে শিক্ষার আওতায় আনা যায় সেটি নিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নানা এনজিওগুলো বহু প্রজেক্ট তৈরির চেষ্টা করেছে। কিন্তু ইসমাইল আহমেদ ও তার চ্যারিটি সহমিয়ে ফাউন্ডেশন খুব সম্ভবত সমস্যাটির সবচেয়ে ভালো ও কার্যকরী সমাধান খুঁজে বের করতে পেরেছে।
ইসমাইল আহমেদ শরণার্থী হিসেবে সোমালিল্যান্ড থেকে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি লন্ডনের বেশ কয়েকটি নামকড়া বিজনেস স্কুলে পড়াশোনা করেছেন এবং সবশেষে জাতিসংঘের চাকরি পেয়েছিলেন।
কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ করায় ইসমাইলকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। পরে অবশ্য বেআইনিভাবে বরখাস্ত করায় তাকে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল। এই ক্ষতিপূরণের অর্থ দিয়ে তিনি 'ওয়ার্ল্ড রেমিট' নামের একটি মানি ট্রান্সফার অ্যাপ চালু করেছিলেন।
নিজের দেশের জনগোষ্ঠীর জন্য কিছু করার সংকল্প নিয়ে ইসমাইল আহমেদ সহমিয়ে ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বলেন, "করোনা মহামারীতে লকডাউন পরিস্থিতিতে আমি লন্ডনে থাকা সোমালিয়ান শিশুদের পড়াশোনার সুযোগ প্রদানের চেষ্টা করছিলাম। তখন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আমার দেশের মানুষদের শিক্ষা প্রদানের চিন্তা আমার মাথায় আসে।"
সেই চিন্তা থেকেই ইসমাইল আহমেদ দারিজ নামের অ্যাপটি তৈরি করেন। অ্যাপটি চালাতে কোনো পয়সা খরচ হয় না; এমনকি অফলাইনে থাকা অবস্থায়ও চালানো যায়। ফলে প্রত্যন্ত এলাকায় মানুষেরাও সহজেই অ্যাপটি চালাতে পারেন।
ইসমাইল আহমেদ মনে করে, ভবিষ্যতে এভাবে শিক্ষাদানই জনপ্রিয় হবে। তিনি বলেন, "আমাদের নিজেদের মাতৃভাষা শিখতে ক্লাসে যেতে হতো। এখন আমাদের হাজার হাজার ব্যবহারকারী রয়েছে যারা ক্লাসে না গিয়ে নিজেদের ভাষা ভালোভাবে শিখতে পারছে।"
হারগেইসা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে মুবারিক মাহদী নামের এক ব্যক্তি উট চড়ান। শৈশবে তিনি মাত্র দুই বছর স্কুলের যেতে পেরেছিলেন। তখন যা শিখেছিলেন, খুব বেশি একটা মনে নেই তার। তাই ব্যবসা করতে বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাকে।
কেননা অঞ্চলটিতে বেশিরভাগ মানুষই মোবাইল পেমেন্ট অ্যাপ হিসেবে 'জাদ' ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে মাহদীকে পেমেন্ট স্লিপে গ্রাহকদের নাম পড়তে বেশ সমস্যায় পড়তে হতো। কিন্তু এখন যখন মাহদীর উটগুলো মাঠে খেতে চড়ে বেড়ায় তখন তিনি গাছের ছায়ায় বসে মোবাইল ফোনে নিজের মাতৃভাষা শেখার চেষ্টা করেন।
মাহদী জানান, অ্যাপের মাধ্যমে ভাষা শিখে তিনি এখন গ্রাহকদের সাথে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে যোগাযোগ করতে পারেন। এমনকি বর্তমানে তিনি বইও কিনতে শুরু করেছেন।
অন্যদিকে হারগেইসাতে বসবাসকৃত হোদার জানান, অ্যাপের মাধ্যমে পড়তে শেখার ফলে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে।
হোদার বলেন, "আমি অনুভব করি যে, আমি গতকাল যেখানে ছিলাম আজ সেখানে নেই। ভবিষ্যতের জন্য আমি বর্তমান চাকরির চেয়েও ভালো অবস্থানে থাকার চেষ্টা করবো। একইসাথে সফল হওয়ার জন্য আমার দক্ষতা এবং জ্ঞানের ব্যবহার করবো।"