মস্তিষ্কেরও বিশ্রাম প্রয়োজন; কীভাবে কার্যকরী বিশ্রাম দেওয়া সম্ভব
ব্যস্ত জীবনে কাজ থেকে সম্পূর্ণ বিরতি নিয়ে একটু অবসর বের করা বেশ কষ্টসাধ্য। তবে মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্যের জন্য এই বিশ্রাম বেশ প্রয়োজনীয়। এতে করে বহু কাজের চাপ সামলানোর পর মস্তিষ্কের পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম বেশ কাজে দেয়।
এ সম্পর্কে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের লাইফলং হেলথ অ্যান্ড এইজিং এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ভিক্টোরিয়া গারফিল্ড বলেন, "সাধারণভাবে বলতে গেলে পর্যাপ্ত ঘুমের ফলে আমাদের মস্তিষ্ক একটানা কাজ করা থেকে বিরত থাকতে পারে। এতে করে আমাদের কগনিটিভ ফাংশন আরও উন্নত হয়। ফলে পরবর্তী দিন সার্বিকভাবে আরও ভালো অনুভব করা যায়। কেননা এতে করে আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলি বিশ্রামের এবং পুনরুত্পাদনের সুযোগ পায়।"
গারফিল্ড ঘুম নিয়ে প্রায় এক দশক ধরে গবেষণা করছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "গত ১০ বছর ধরে আমার আগ্রহের অন্যতম জায়গা ছিল, ঠিকঠাক ঘুম কেন জরুরী সেটি বোঝার চেষ্টা করা। বিশেষ করে আমরা যখন বয়স্ক হয়ে যাই, তখন মস্তিষ্ক ও দেহের জন্য ঘুম কেন এত গুরুত্বপূর্ণ সেটা খুঁজে বের করা।"
দশকব্যাপী করা গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, খুব কম বা বেশি পরিমাণে ঘুম ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্ট অ্যাটাক, ডিমেনশিয়া, উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার মতো সমস্যার ঝুঁকি বাড়ায়। একইসাথে গারফিল্ডের দলের গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, হালকা দিবা নিন্দ্রার অভ্যাস অন্যদের তুলনায় বয়সের সাথে সাথে মস্তিষ্কের আয়তন বড় রাখতে সহায়ক।
গবেষণাটি গত জুনে স্লিপ হেলথ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এতে ইউকে বায়োব্যাংকের ৩৫ হাজার প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির এমআরআই ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গারফিল্ড জানান, অন্যদের তুলনায় মস্তিষ্কের আয়তনের এই পার্থক্য ১৫ কিউবিক সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। যা বয়সের হিসেবে ২.৫ থেকে ৬.৫ বছর পর্যন্ত পার্থক্য তৈরি করে দেয়।
এ সম্পর্কে গারফিল্ড বলেন, "মস্তিষ্কের আয়তনের বিষয়টি বেশ বড় গুরুত্বপূর্ণ। কেননা মস্তিষ্কের আয়তন কমে গেলে সেটি নানা রোগ-বালাই, অকাল মৃত্যু, মস্তিস্কে চাপ বৃদ্ধির জন্য দায়ী হতে পারে।"
১. পর্যাপ্ত ঘুম
অনেকেই রাতে চার, পাঁচ ঘণ্টার ঘুম যথেষ্ট বলে মনে করেন। কিন্তু মস্তিষ্কের সার্বিক বিশ্রাম বিবেচনায় এরচেয়েও বেশি ঘুমের প্রয়োজন। গারফিল্ডের মতে, বয়সের ওপর ভিত্তি করে রাতে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত।
গারফিল্ড বলেন, "মানুষ হয়তো বিষয়টি নিয়ে খুব একটা ভাবে না। আমি যখন তাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণে না ঘুমানোর অপকারিতা সম্পর্কে জানাই, তখন তারা অবাক হয়ে যায়।"
গারফিল্ড আরও বলেন, "অনেকেই এমনটা বলে থাকেন যে, 'আমিতো রাতে মাত্র চার ঘণ্টা ঘুমাই। আমার তেমন কোনো সমস্যা হয় না।' কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারে না যে, সময়ের সাথে সাথে এর প্রভাব বেশ ক্ষতিকারক।"
২. ঘুমের সময়ের ধারবাহিকতা
কোনোদিন হয়তো আমরা রাত ১১ টায় ঘুমিয়ে যাচ্ছি আবার কোনোদিন হয়তো রাত দুইটায় ঘুমাচ্ছি। ফলে ঘুম থেকে ওঠাও হচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। এটি মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বেশ নেতিবাচক।
তাই চেষ্টা করতে হবে সপ্তাহের সকল দিনই একই সময়ে ঘুমাতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠা। এটি একটি রুটিনের মতো কাজ করে। একইসাথে মস্তিষ্কের সুস্বাস্থ্যের জন্য যে ৭ থেকে ৯ ঘণ্টার ঘুমের প্রয়োজন; সেটি নিশ্চিতে সহায়তা করে।
৩. হালকা দিবা নিদ্রা
হালকা দিবা নিন্দ্রা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই অস্বস্তি বোধ করেন। তবে এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং এটি মস্তিষ্ক ও সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
এ সম্পর্কে গারফিল্ড বলেন, "আমরা দিনে ৩০ মিনিট সময়ের মতো একটা হালকা ঘুম দিতে পারি। এতে করে ছোটখাটো একটা বিশ্রাম হবে এবং সেটি মস্তিষ্কের জন্য বেশ ইতিবাচক হবে।"
গারফিল্ডের দলের গবেষণায় হালকা দিবা নিদ্রার ইতিবাচক ফলাফল দেখা গেলেও অন্য বহু গবেষণায় আবার এমনটা পাওয়া যায়নি। বরং অন্যসব গবেষণায় হালকা দিবা নিদ্রা নিয়ে নেতিবাচক ফলাফলও উঠে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, আলঝেইমার্সে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও থাকতে পারে সেইসব গবেষণায় বলা হয়েছে।
৪. ব্যায়াম করা
শুধু রাতের ঘুম কিংবা হালকা দিবা নিদ্রার ফলেই যে মস্তিষ্ক বিশ্রাম লাভ করবে এমনটা নয়। বরং ব্যায়ামের মাধ্যমেও সেই উদ্দেশ্য অর্জিত হতে পারে।
এ সম্পর্কে গারফিল্ড বলেন, "বহু গবেষণায় দেখা যায়, কাজের চাপের মাঝে একটু হাঁটাহাঁটি করা বেশ উপকারী। বিশেষ করে সকল ডিভাইস থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রকৃতির সংস্পর্শে আসাটা গুরুত্বপূর্ণ।"
তবে এই হাঁটাহাঁটি যে প্রাকৃতিক পরিবেশেই হতে হবে এমনটা নয়। বরং মূল কথা হচ্ছে, যেকোনো স্থানে হাঁটার মাধ্যমে মস্তিস্ককে কাজের চাপ থেকে দূরে সরিয়ে রেখে খানিকটা বিশ্রাম নেওয়া।
৫. মানসিক প্রশান্তিদায়ক কাজ
মেডিটেশন কিংবা প্রশান্তিদায়ক কাজের মাধ্যমেও মস্তিস্ককে বিশ্রাম দেওয়া যায়। তবে সকলের ক্ষেত্রে এটি কার্যকরী নয়। কেননা অনেকেই অল্প সময়ের জন্য নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে রেখে একদম প্রশান্তিদায়ক কিছু করতে পারে।
গারফিল্ড মূলত এক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ওপর কম চাপের সৃষ্টি করে এমন সব কাজ করতে বলেছেন। যেমন, টিভি দেখা কিংবা মুদি জিনিসপত্র কেনার জন্য দোকানে যাওয়া ইত্যাদি। তবে টিভি দেখার মতো জিনিসগুলো যদি নিজের কর্মজীবনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত হয়, তবে সেক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ওপর ঠিকই চাপ পরবে। সেটি খুব বেশি কাজে লাগবে না।