গাজাই কি হবে ইসরায়েলের স্টালিনগ্রাদ?
মঙ্গলবার রাতে গাজা সিটির আল-আহিল আরব হাসপাতালে মারাত্মক বোমা হামলা করেছে ইসরায়েল। এতে অন্তত ৫০০ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন গাজার জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তারা। এ ঘটনায় বিশ্বজুড়ে (পশ্চিমা দুনিয়া বাদে) উঠেছে ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড়। হামলার দায় এড়াতে বরাবরের মতো মিথ্যাচারের কৌশল কাজে লাগাচ্ছে ইসরায়েল। তেল আবিব উল্টো ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে দুষছে। ভিকটিমের ওপরই দোষ চাপানোর পুরোনো এক খেলায় নেমেছে তারা। আর তাতে বিশ্বাস করছে, বা চোখ বুজে সমর্থন দিচ্ছে পশ্চিমারা।
তবে ইসরায়েল যাই বলুক, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত – ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানের ফেলা একটি স্মার্ট বোমার আঘাতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে গুঁড়িয়ে যায় হাসপাতালটি।
অন্যদিকে ইসরায়েলের দাবি, গাজা থেকে ছোড়া একটি রকেট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে হাসপাতালটিতে আঘাত হানে। কিন্তু, হামাসের কাছে এত ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটানোর মতো কোনো রকেট যে নেই, তেল আবিবের বক্তব্যে সেটি সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তাছাড়া, অতীতে হামাস বা ইসলামিক জিহাদ – কারোর রকেটই গাজার জনসংখ্যার এমন প্রাণহানি ঘটায়নি।
ঘটনার পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া তথ্যপ্রমাণ চূড়ান্ত উপসংহারে পৌঁছানোর মতো যথেষ্ট নয়। তবে ধবংসস্তূপ খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে বিস্ফোরক ডিভাইসের বাইরের খোলসের টুকরো। যা অবধারিতভাবে দোষীকে চিহ্নিত করবে।
তবে একথাও সত্য, হাসপাতাল ধবংসের আগে থেকেই গাজার ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচার বিমান হামলার দৃশ্য দেখেছে বিশ্ববাসী। আল আহিল হাসপাতালের ট্রাজেডির আগে থেকেই যা করে আসছে ইসরায়েলি বাহিনী।
ইসরায়েলের নির্বিচার বোমাবর্ষণের পেছনে স্পষ্ট সামরিক লক্ষ্য অর্জনের ধারাবাহিকতা এমনকী খুবই সাবধানী সামরিক বিশ্লেষকরাও খুঁজে পাননি। তাই সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠছে: গত সপ্তাহে কোন যুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের উত্তর গাজা ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছিল ইসরায়েল?
সামরিক কৌশলের দিক থেকে এর সম্ভাব্য দুটি ব্যাখ্যা রয়েছে। কিন্তু, ইসরায়েলের ক্ষেত্রে উভয় ব্যাখ্যা বিশ্বাস করা ভুল হবে।
প্রথম ব্যাখ্যা হতে পারে, এই নির্দেশের মাধ্যমে গাজা উপত্যকার সড়কগুলোতে পলায়মান জনতার ভিড় তৈরি করে চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, যাতে হামাসের যোদ্ধাদের চলাচল খুবই কঠিন হয়ে যায় বা প্রায় অসম্ভব হয়ে ওঠে। প্রথাগত সমর চিন্তার আওতায় এই যুক্তি প্রযোজ্য, কারণ অতীতের বিভিন্ন যুদ্ধে এ কৌশল কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু, এটি প্রথাগত কোনো যুদ্ধ নয়– যেখানে উভয়পক্ষই সমান বা এমনকী কাছাকাছি পর্যায়ের শক্তিধর। হামাসও কোনো প্রথাগত সামরিক সংগঠন নয়। এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে প্রণীত ইসরায়েলের যেকোনো কৌশলের সাফল্য তাই খুবই সীমিত হতে বাধ্য।
বহু বছর ধরে চলে আসা ইসরায়েলি অবরোধের মধ্যে গাজা উপত্যকাজুড়ে সুড়ঙ্গের এক বিস্তৃত অন্তর্জাল তৈরি করেছে হামাস। সঙ্গত সামরিক কারণেই এসব সুড়ঙ্গের অস্তিত্ব চরম গোপনীয়তার সাথে রক্ষার চেষ্টা করে ফিলিস্তিনিরা। এ ধরনের কোনো সুড়ঙ্গের উপস্থিতি জানাজানি হয়ে গেলে হামাস সেটির সম্পর্কে অস্পষ্ট কোনো বক্তব্য বা তথ্য দেয়। ফলে টানেল ব্যবস্থা ঘিরে রহস্যের এক চাদর রয়েই গেছে।
২০০৫ সাল পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলের দখলদার বাহিনী ছিল। দখলদার বাহিনীর চোখে ধুলো দিতে তার আগে থেকেই গাজায় প্রথম সুড়ঙ্গ খোঁড়া শুরু হয়েছিল। ১৯৯০ এর দশকের শেষদিকের ওই সময়ে ধারণা করা হতো, এসব সুড়ঙ্গ দিয়ে গাজার ফিলিস্তিনিরা নিত্যপণ্য, সামরিক সরঞ্জাম চোরাচালান করে আনে। তখন গাজার রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছিল ফাতাহ'র হাতে।
ওই সময়ে খোঁড়া সুড়ঙ্গগুলো ছিল খুবই সাধারণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গাজার অংশ থেকে মিশরের সীমান্ত বেড়ার নিচ দিয়ে পাড়ি দেওয়ার মতো স্বল্প দৈর্ঘ্যের হতো। উভয় দিকে প্রবেশপথ হতো সীমান্ত সংলগ্ন ঘরবাড়ি। এভাবেই সুড়ঙ্গ গোপন রাখা হতো। মাত্র কয়েকশ মিটার দৈর্ঘ্যের এসব সুড়ঙ্গ এতই সংকীর্ণ ছিল যে, এগুলোর ব্যবহারকারীদের চলতে হতো হামাগুড়ি দিয়ে।
১৯৯৩ সালে সার্বিয়ার অবরোধের মুখে পড়ে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার রাজধানী সারেয়েভো। অবরোধ ফাঁকি দিতে তাড়াহুড়ো করে সুড়ঙ্গ খোঁড়ে বসনিয়ার সেনাবাহিনী। সারায়েভোতে যুদ্ধের স্মারক হিসেবে আজো সেই সুড়ঙ্গ আছে, যারা এটি ঘুরে দেখেছেন, তারা সহজেই ১৯৯০- এর দশকে নির্মিত গাজা-মিশর সীমান্ত টানেলগুলোর সাথে তার মিল খুঁজে পাবেন। উভয় ধরনের সুড়ঙ্গই সংকীর্ণ, কায়িক পরিশ্রমে খোঁড়া এক ধরনের সরু টিউব-সদৃশ, যার নিচু ছাদ স্থানে স্থানে বিম ও খুঁটি দিয়ে ঠেস দেওয়া।
সময়ের সাথে সাথে গাজায় পণ্য বা অস্ত্র চোরাচালানের কার্যকর উপায় হয়ে ওঠে সুড়ঙ্গ ব্যবস্থা। ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের আরও ভেতরে বিস্তৃত হতে থাকে এই নেটওয়ার্ক। এর সহায়তায়, বেসামরিক মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে চলাচলের সুযোগ পায় প্রতিরোধ যোদ্ধারা। কারণ, বেসামরিক মানুষের মধ্যে অনেকেই ছিল ইসরায়েলের চর। ইসরায়েলের নজরদারির অন্যান্য উপকরণ স্যাটেলাইট, গোয়েন্দা বিমান, হেলিকপ্টার বা চালকহীন ড্রোনকেও এভাবে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হয়। এক পর্যায়ে সুড়ঙ্গ খননকারীরা অত্যন্ত দক্ষ হয়ে ওঠেন, এবং ভূগর্ভস্থ স্থাপনাগুলোর মানও উন্নত করতে সক্ষম হন।
গত সপ্তাহে হামাসের প্রকাশিত ভিডিওতে বিস্ময়কর আকারের উন্নত সুড়ঙ্গ দেখা গেছে। এগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, কংক্রিটের মজবুত ব্লক একের পর এক বসিয়ে। উচ্চতা ও প্রশস্ততা যোদ্ধাদের দ্রুত চলাচলের উপযুক্ত। আরও রয়েছে রকেটসহ বিভিন্ন অস্ত্র ও গোলাবারুদ মজুতের সুরক্ষিত অংশ।
সুড়ঙ্গগুলোর সঠিক অবস্থান বা সেগুলো কতদূর বিস্তৃত সে সম্পর্কে কিছু জানা না গেলেও– সন্দেহ এর নেটওয়ার্ক বিশাল, যার মাধ্যমে কার্যকরভাবে মাটির নিচ দিয়ে সেনা চলাচল ও গোলাবারুদ স্থানান্তর করতে পারে হামাস। এভাবে হামাসের তুলনামূলক ছোট যোদ্ধাদের দল সুড়ঙ্গ দিয়ে একস্থান থেকে অন্যত্র সরে গিয়ে লড়াইয়ে অংশ নিতে পারে। আক্রমণাত্মক ও প্রতিরোধ– উভয় ধরনের অপারেশনেই যা কাজে লাগে।
তাই হামাসের সেনা বা রসদ চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করতে ইসরায়েল যদি গাজার উত্তর অংশ থেকে সাধারণ মানুষকে পালানোর নির্দেশ দিয়ে থাকে, তাহলে সেটা রণাঙ্গনের মাঠপর্যায়ের বাস্তবতার ভুল পাঠ। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এতটাও অজ্ঞ নয়।
এ নির্দেশের পেছনে ইসরায়েলি সেনানায়কদের দ্বিতীয় চিন্তাধারাটি হতে পারে, ওই এলাকা থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে ফেলে স্থল অভিযান পরিচালনাকে আরও সহজ-সরল করে তোলা।
তাত্ত্বিকভাবে, এর পেছনে জোরালো যুক্তি রয়েছে, আর তা হলো: অধিকাংশ বেসামরিক নাগরিক সরে পড়লে, আক্রমণকারী ধরে নিতে পারবে, এরপরও ওই এলাকায় উপস্থিত যেকোনো ব্যক্তিই যোদ্ধা। ফলে সামরিক দৃষ্টিকোণ দিয়ে হামলার যোগ্য। তাছাড়া, এর মধ্য দিয়ে অভিযানকালে বেসামরিক প্রাণহানির সংখ্যা কমবে এবং ইসরায়েলি বাহিনী নির্বিচারে বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে এমন অভিযোগের সংখ্যাও কমবে।
কিন্তু, বাস্তবতার নিরিখে এসব ব্যাখ্যা ধোপে টেকে না। জাতিসংঘ-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা সংস্থা জোর দিয়েই বলেছে, ২৪ ঘন্টার মধ্যে যুদ্ধ-কবলিত এলাকার ১১ লাখ মানুষের পক্ষে অন্যত্র সরে যাওয়া অসম্ভব হবে– যেটা ইসরায়েলও জানতো। একদিকে টানা বোমাবর্ষণ, অন্যদিকে খাদ্য, পানি, ওষুধ ও জ্বালানির প্রচণ্ড সংকট – এরমধ্যে বেশিরভাগ মানুষের পক্ষে পালানো সম্ভব হতো না। তাছাড়া, পালানোর রাস্তাগুলোর ওপরও বোমা ফেলেছে ইসরায়েল।
এতকিছুর পরও যদি ইসরায়েলের নির্দেশনা অনুযায়ী বেশিরভাগ মানুষ অলৌকিক কোনো উপায়ে উত্তর গাজা ত্যাগ করতে পারতো, তাতেও সহজ হতো না ইসরায়েলের পরিকল্পিত স্থল আগ্রাসন। এমনকী বিশ্বের অন্যতম সুপ্রশিক্ষিত, উন্নত অস্ত্রসজ্জিত পদাতিক সৈন্যদল, আকাশে ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর একক আধিপত্য এবং উচ্চপ্রযুক্তির যন্ত্রপাতি থাকার পরেও নয়।
পুরোনো একটি সামরিক প্রবাদ অনুসারে, একজন সেনানায়ক তখনই একটি এলাকা তার নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে ধরে নিতে পারেন, যখন তার চারপাশে ও কেন্দ্রস্থলে দৃঢ় অবস্থান নিতে পারে তার সেনারা। কিন্তু, বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত গাজার ভবনগুলোর কংক্রিট পড়ে আছে রাস্তায় রাস্তায়, ধবংসস্তূপে ভরা নগরের পরিবেশ প্রতিপক্ষের যোদ্ধাদের অনুকূলে কাজ করে। যেকোন দিক দিয়ে অতর্কিতে চোরাগোপ্তা হামলার জন্য ওঁত পেতে বসে থাকে তারা। এরমধ্যে দিয়ে আক্রমণকারী পক্ষের সেনাদের অগ্রসর হওয়া খুবই কঠিন। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এমন ভূমিতে অপারেশন পরিচালনাকে অন্যতম চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করা হয়।
ইতিহাসে এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্টালিনগ্রাদ শহরের যুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ শহরটির ভবন ও অবকাঠামোগুলো বোমা গেলে ও গোলাবর্ষণ করে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল জার্মান বাহিনী। তারপর প্রবেশ করে শহরে। জার্মান সেনাদের উন্নততর প্রশিক্ষণ, সামরিক অভিজ্ঞতা ও কারিগরি দক্ষতা থাকার পরেও এ শহর দখলে নিতে তাদের আট মাস সময় লাগে। সোভিয়েত প্রতিরোধ যোদ্ধারা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ ও বলিদানের মধ্যে দিয়ে রুখে দিয়েছিল জার্মানদের। এই স্টালিনগ্রাদেই পরে ঘেরাও হয়ে পড়ে জার্মান সেনারা। একপর্যায়ে আত্মসমর্পণেও বাধ্য হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া সেরা খণ্ডযুদ্ধগুলোর একটি ছিল স্টালিনগ্রাদের লড়াই।
এক কথায়, আধা-ধবংস হওয়া নগরে অন্য যেকোনো বৈশিষ্ট্যের ভূমির চেয়ে বেশি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে আক্রমণকারীরা। সাধারণত আক্রমণ অভিযানে সাফল্যের জন্য প্রতি একজন শত্রু যোদ্ধার বিপরীতে আক্রমণকারী পক্ষে তিনজন সেনা থাকতে হয়, কিন্তু নগর যুদ্ধের এমন পরিবেশে সেটাও যথেষ্ট নয়। বাস্তবে ৫:১ বা তার চেয়ে বেশি অনুপাতে সেনা থাকলে সাফল্যের আশা করা যায়।
ইসরায়েলের নির্দেশমতো অধিকাংশ গাজাবাসী যদি উত্তর অংশ খালি করে চলে যায়, তাতে লড়াইয়ে হামাসেরই সুবিধা হবে। ভ্রাতৃহত্যার আশঙ্কা ছাড়াই হামাস যোদ্ধারা তখন হামলা করতে পারবে। তারা এক স্থান থেকে অন্যত্র যেতে ব্যবহার করে সুড়ঙ্গপথ, তাই মাটির ওপরে চলাচলকারী যে কাউকে লক্ষ্যবস্তু বানাবে হামাস যোদ্ধারা। সুড়ঙ্গের মাধ্যমে একদিক দিয়ে হামলা করে, কিছুক্ষণ পরেই আবার আরেক জায়গায় গিয়ে আঘাত হানবে।
ইসরায়েল নিশ্চিতভাবেই তাদের সামরিক অভিযানের পরবর্তী ধাপের (স্থল অভিযানের) পরিকল্পনা করছে। এ অবস্থায়, আগামী দিনগুলোতে ইসরায়েলি বাহিনীর গ্রহণ করা নানান উপায়, তাদের সক্ষমতা ও সম্ভাব্য কৌশল সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারবে বিশ্ববাসী।