সারি সারি মরদেহ, অঙ্গপ্রত্যঙ্গহীন আহতদের চিৎকার: চিকিৎসকদের বর্ণনায় গাজা হাসপাতাল
গাজার আল-আহলি আল-আরাবি হাসপাতালের অর্থোপেডিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ফাদেল নাইম সবে একটা প্রক্রিয়া শেষ করেছেন। তখনই বিশাল এক বিস্ফোরণের শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠল আর তার বিভাগে প্রচুর লোক সাহায্যের আশায় সমবেত হতে থাকলো।
"লোকজন চিৎকার করতে করতে সার্জারি বিভাগে ছুটে এসে বলছিল, 'সাহায্য করুন, আমাদের সাহায্য করুন'।"
তিনি বলেন, "হাসপাতাল জুড়ে ছিল আহতদের ভারী চিৎকার আর খণ্ডবিখণ্ড মৃতদেহ। আমরা সামর্থ্য অনুযায়ী যতজনকে সম্ভব বাঁচানোর চেষ্টা করি, তবে হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি।"
মঙ্গলবারের (১৮ অক্টোবর) হাসপাতাল বিস্ফোরণে শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়। এ ঘটনায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠক বাতিল করেন আরব নেতারা।
বুধবার ইসরায়েল সফর শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্টের জর্ডানে যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠকের কথা ছিল তার। তবে গাজার আল–আহলি আরব হাসপাতালে হামলার ঘটনার জেরে এই বৈঠক বাতিল করে জর্ডান।
ফিলিস্তিনি কর্মকর্তারা বরাবর এ বিস্ফোরণের জন্য ইসরায়েলি বিমান হামলাকে দায়ী করেছেন। তবে ইসরায়েল এই দায় অস্বীকার করে ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের ঘাড়ে চাপিয়েছে।
চিকিৎসক ইব্রাহিম আল-নাকা শতবর্ষী ব্যাপ্টিস্ট হাসপাতালটির জন্য গর্বিত। সংঘর্ষপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থান সত্ত্বেও এই হাসপাতাল সব সময় সকল ধর্মের মানুষকে স্বাগত জানিয়ে এসেছে; এতে আছে মসজিদ আর গির্জার সহাবস্থান।
অথচ মঙ্গলবারের হামলায় সারি সারি মৃতদেহ ও ধবংসপ্রাপ্ত যানবাহনে হাসপাতালের বাইরের সড়ক ধবংসস্তূপে ছেয়ে যায়।
যেখানে বসে রোগীরা পুনরায় সুস্থ হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখত, হাসপাতালের সেই দেয়াল, সেই মাটিতে গাঢ় হয়ে ছিল রক্তের ছোপ ছোপ দাগ।
"এই স্থানটি নারী ও শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়ে রূপ নিয়েছিল; ইসরায়েলি বোমা হামলা থেকে যারা রক্ষা পেয়েছিলেন, তারা এ হাসপাতালটিতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল," বলেন নাকা।
"কোনো রকমের আগাম সতর্কতা ছাড়াই এই হাসপাতালকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। এই বিস্ফোরণের নাম আমরা জানি না; আমরা কেবল দেখেছি এর ফলাফল-যখন এটি শিশুদের ওপর ছোঁড়া হলো এবং তাদের দেহ টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকলো।"
ইসরায়েল-হামাসের চলমান সংঘর্ষের মধ্যে আর কোনো হামলায় একযোগে এত মানুষ নিহতের ঘটনা ঘটেনি। ফলে এতে বিক্ষোভও ছড়িয়েছে ব্যাপকাকারে। জর্ডান, তুরস্কের পাশাপাশি নিন্দার ঝড় বয়েছে বিশ্বজুড়ে।
ব্রিটিশ-ফিলিস্তিনি চিকিৎসক ঘাসান আবুসিত্তাহ বলেন, বোমা হামলার কারণে হাসপাতালটি সারাদিন ধরে কেঁপে উঠছিল। বিস্ফোরণের ঠিক আগে তিনি একটি মিসাইলের শব্দ শুনতে পান, এর পরপরই অপারেটিং রুমের ছাদটি তার এবং অন্যান্য চিকিৎসকদের ওপর ধসে পড়ে। হাসপাতাল প্রাঙ্গনের সর্বত্র তিনি অঙ্গপ্রত্যঙ্গহীন মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। আহতদের একজনকে চিকিৎসা দিয়েছিলেন তিনি; বিস্ফোরণে সেই ব্যক্তির পা উড়ে গিয়েছিল।
আবুসিত্তাহ বলেন, গাজার চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, চিকিৎসকরা ন্যূনতম চিকিৎসার উপকরণটুকু যোগাতে পারছেন না।
"আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি; প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে", আক্ষেপের সুরে বলেন তিনি।
মঙ্গলবারের বিস্ফোরণের আগে গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, গত ১১ দিনে ইসরায়েলি বোমাবর্ষণে কমপক্ষে ৩ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আশরাফ আল-কিদরা জানিয়েছেন, গাজা সিটিতে অবস্থিত আল আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালে বোমা হামলায় ৪৭১ জন নিহত এবং ৩১৪ জনেরও বেশি আহত হয়েছে।
হামাসের সরকারি মিডিয়া অফিসের প্রধান সালামা মারুফ বলেছেন, "ব্যাপটিস্ট হাসপাতালে ইসরায়েলিদের পরিচালিত গণহত্যা একুশ শতকের গণহত্যা এবং এটি ১৯৪৮ সালের নাকবার সময় থেকেই চলে আসছে।"