মিশর এবং অন্য আরব দেশগুলি কেন গাজার বাসিন্দাদের আশ্রয় দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে?
হামাসের গত ৭ অক্টোবরের হামলার পর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজার ক্রমাগত বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে। এতে করে ফিলিস্তিনিরা প্রাণভয়ে পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করছে। তবে প্রতিবেশী মিশর এবং জর্ডান গাজার বাসিন্দাদের আশ্রয় দিতে সম্মত হচ্ছে না।
মিশর ও জর্ডানের গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরের সাথে সীমান্ত রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশ দুটি নতুন করে শরণার্থী গ্রহণের সম্ভবনা নাকচ করে দেওয়ার পেছনে অবশ্য যথেষ্ট কারণও রয়েছে। জর্ডানে ইতিমধ্যেই বিশাল সংখ্যক ফিলিস্তিনি শরণার্থী হিসেবে রয়েছে।
অন্যদিকে গতকাল (বুধবার) মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ নিয়ে বেশ কড়া ভাষায় কথা বলেছেন। একইসাথে তিনি উক্ত অঞ্চলের শান্তি বিনষ্ট হতে পারে বলেও সতর্ক করেছেন।
আল-সিসি বলেন, "চলমান যুদ্ধ শুধু গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী হামাসকে হামাসকে লক্ষ্য করে পরিচালিত হচ্ছে না। বরং এই যুদ্ধে বেসামরিক বাসিন্দাদের মিশরে শরণার্থী হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যও রয়েছে।"
এদিকে গত মঙ্গলবার জর্ডানের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লাহ ঠিক একই ধরণের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, "জর্ডান ও মিশর কোনো শরণার্থী গ্রহণ করবে না।"
অবশ্য শরণার্থী গ্রহণ না করার ক্ষেত্রে দেশ দুটির নিজেদের যুক্তিও রয়েছে। তারা মনে করেন, এর মাধ্যমে ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত করতে চায়। একইসাথে এর ফলে ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিও দুর্বল হবে।
ইতিহাসে ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বেশ কয়েকবার বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইসরায়েলের ফিলিস্তিন দখলের সময় আনুমানিক ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছিল। ফিলিস্তিনিরা এই ঘটনাকে আরবিতে 'নাকবা' বলে, যার অর্থ 'বিপর্যয়'।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরায়েল পশ্চিম তীর ও গাজা দখল করে নেয়। তখন প্রায় ৩ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত হতে হয়; যাদের বেশিরভাগই পরবর্তীতে জর্ডানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়।
যার ফলে বর্তমানে শরণার্থী এবং তাদের বংশধরদের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখে পৌঁছেছে। যাদের বেশিরভাগই পশ্চিম তীর, গাজা, লেবানন, সিরিয়া এবং জর্ডানের ক্যাম্প কিংবা আশেপাশে বসবাস করছে। অনেকে আবার শরণার্থী হিসেবে উপসাগরীয় আরব দেশ কিংবা পশ্চিমে বসবাস করছে।
১৯৪৮ সালে যুদ্ধ বন্ধের পর ইসরায়েল ফিলিস্তিনের শরণার্থীদের নিজেদের ঘরে ফিরতে দেয়নি। এরপর থেকেই ইসরায়েল শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের জন্য ফিলিস্তিনিদের দাবি ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করে আসছে। তাদের যুক্তি এই যে, শরণার্থীরা ফিরে আসলে ইহুদিরা হুমকির মুখে পরবে।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে মিশর এবারের চলমান যুদ্ধে শরণার্থী গ্রহণের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। তাদের শঙ্কা এই যে, পূর্ববর্তী সময়ের মতোই নতুন শরণার্থী গ্রহণ করলে তারা আর নিজেদের দেশে ফিরে যেতে পারবে না। এছাড়াও চলমান যুদ্ধ ঠিক কবে নাগাদ শেষ হবে সেটা আঁচ করা যাচ্ছে না।
গত ৭ অক্টোবর হামলার পর থেকে ইসরায়েল বলছে যে, দেশটি গাজায় স্থল আক্রমণের মাধ্যমে হামাসকে পুরোপুরি নির্মূল করতে চায়। তবে এমনটা করা হলে পরবর্তীতে কী ঘটতে পারে এবং কে গাজা শাসন করবে তার কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। ফলে এতে করে একটা উদ্বেগ থেকেই যায় যে, এর ফলে সংঘাত আরও বৃদ্ধি পাবে।
তবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, ফিলিস্তিনিরা যাতে উত্তর গাজা থেকে সরে যাওয়ার আদেশ মেনে নেয়। একইসাথে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে দেওয়া হবে বলেও আশ্বস্ত করা হয়েছে। তবে তেল আবিবের এমন আশ্বাসেও মিশর শরণার্থী গ্রহণে রাজি হয়নি।
আল-সিসি মনে করেন যে, ইসরায়েল পরবর্তীতে যুক্তি দিতে পারে যে, তারা ঠিকভাবে হামাসকে দমন করতে পারেনি। তখন এই যুদ্ধ বছরের পর বছর স্থায়ী হতে পারে এবং শরণার্থীদের দেশে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে।
এ বিষয়ে ক্রাইসিস গ্রুপ ইন্টারন্যাশনালের নর্থ আফ্রিকার প্রজেক্ট ডিরেক্টর রিকার্ডো ফ্যাবিয়ানি বলেন, "গাজায় ইসরায়েলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। বাসিন্দাদের অন্যত্র সরে যাওয়ার নির্দেশও সমস্যাযুক্ত। এই বিভ্রান্তি প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে৷"
এদিকে মিশর গাজার মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য ইসরায়েলের সম্মতি চেয়েছে। গতকাল (বুধবার) ইসরায়েলের পক্ষ থেকেও সম্মতি দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু ঠিক কবে নাগাদ এই মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে পারবে, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এদিকে দেশ হিসেবে মিশরও তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। জাতিসংঘের হিসেব মতে, এরই মাঝে দেশটিতে প্রায় ৯০ লাখ শরণার্থী এবং অভিবাসী রয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৩ লাখ সুদানী রয়েছে যারা নিজেদের দেশে চলমান যুদ্ধ থেকে চলতি বছর পালিয়ে এসেছেন।
এ বিষয়ে কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট ফেলো হেলিয়ার বলেন, "সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনা ইঙ্গিত করে যে, যখন ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ভূখণ্ড ত্যাগ করতে বাধ্য হয়, তখন তাদের আর সেখানে ফিরে যেতে দেওয়া হয় না। এক্ষেত্রে মিশর গাজায় চলমান জাতিগত নিধনে জড়িত হতে চায় না।"
একইসাথে মিশর আশঙ্কা করছে যে, গাজার শরণার্থীদের ব্যাপকভাবে আশ্রয় দিলে হামাস বা অন্যান্য ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর সদস্যরাও দেশটিতে চলে আসতে পারে। এতে করে সিনাই অস্থিতিশীল হতে পারে, যেখানে মিশরের সামরিক বাহিনী বছরের পর বছর ধরে ইসলামিক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে।
২০০৭ সালে হামাস গাজা দখলের পর থেকে মিশর ইসরায়েলের গাজা অবরোধকে সমর্থন করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় পণ্যসামগ্রী প্রবেশে কঠোরতা এবং বেসামরিক নাগরিকদের চলাচলেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে দেশটি। এছাড়াও মিশর হামাস এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনিরা যাতে সীমান্তে পণ্য পাচার করতে না পারে তাই সীমান্তের নীচে সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ককেও ধ্বংস করেছে।