গাজার নজিরবিহীন মানবিক সংকটে যেভাবে উপসাগরীয় দেশগুলো সহায়তার হাত বাড়িয়েছে
অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলি বোমাবর্ষণ থামছেই না। হাসপাতালের পর এবার গাজা শহরে একটি গ্রিক গির্জায় বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল যে হামলায় এ পর্যন্ত ৮ জন নিহতের খবর মিলেছে।
এ নিয়ে গাজা উপত্যকায় মৃতের সংখ্যা ৩,৭৮৫ জনে এসে দাঁড়িয়েছে; যাদের মধ্যে রয়েছে কমপক্ষে ১,৫২৪ শিশু। এমন মানবিক সংকটে আরব উপসাগরীয় রাষ্ট্রসমূহ গাজার বেসামরিক নাগরিকদের সহায়তা ও সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের অতর্কিত হামলার পর থেকে দুই পক্ষের ব্যাপক সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত গাজার প্রায় ২২ লাখ অধিবাসী খাবার, পানি, ওষুধ এবং বিদ্যুতের তীব্র সংকটে পতিত হয়েছে।
জ্বালানির অভাবে গাজার একমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে। হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিকের আশ্রয়স্থল- গাজা উপত্যকার হাসপাতালগুলোতে কয়েক দিনের মধ্যে জেনারেটরের জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে; যা রোগীদের জীবনকে তীব্র ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে বলে আশংকা করছে জাতিসংঘ।
গাজায় মানবিক ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে রাফাহ ক্রসিং সীমান্ত খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত খুলে দেয়া হয়নি সেটি। ফলে কোনো রকম মানবিক সহায়তা পৌঁছানো যাচ্ছে না। এখন প্রায় ২০০-এর বেশি ট্রাক এবং ৩ হাজার টন পণ্য সহায়তা রাফাহ ক্রসিংয়ের কাছাকাছি অবস্থান করছে বলে জানা গেছে।
মিশরের সাথে গাজার একমাত্র সংযোগস্থল এই রাফাহ ক্রসিং।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, 'অবিলম্বে' পানীয় এবং জ্বালানি সরবরাহ করা না হলে গাজার বাসিন্দারা মহামারির সম্মুখীন হবে।
বুধবার (১৮ অক্টোবর) ইসরায়েল জানায়, মিশরকে গাজা উপত্যকায় সীমিত মানবিক সহায়তা প্রদানের অনুমতি দেবে তারা। গাজার আল আহলি আল-আরব হাসপাতালে ভয়ংকর বোমা হামলার পর বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় ওঠার পর, এই ঘোষণার কথা জানায় ইসরায়েল। অপরদিকে বৃহত্তর সংঘাত প্রতিরোধের আশায় ইসরায়েল সফর করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
বাইডেন জানান, মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ক্রসিং খুলে দিতে সম্মত হয়েছেন; ২০ ট্রাক মানবিক সাহায্যের অনুমতি দিয়ে প্রাথমিকভাবে ক্রসিং খুলতে সম্মত হয়েছে দেশটি।
হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুক্রবার থেকে দলটি যাত্রা শুরু করবে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হয়, মিশর থেকে আসা খাদ্য, পানীয় বা ওষুধ সরবরাহ তারা 'ব্যহত করবে না', যদি তা কেবল গাজার দক্ষিণে বেসামরিক লোকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়, এবং হামাস সদস্যদের কাছে না পৌঁছায়।
মিশরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামেহ শউকরি আল-আরাবিয়া টিভিকে বলেছেন, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এই ত্রাণ সরবরাহ করা হবে।
ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে রাফাহ ক্রসিংয়ের মিশরীয় পার্শ্বে একাধিকবার বোমা হামলা হয়েছে। ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য মিশরকে সীমান্ত বরাবর আগে তাই সংলগ্ন রাস্তা মেরামত করতে হবে।
ইসরায়েলের ঘোষণার আগেই জেনেভায় রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটির মুখপাত্র ক্রিস্টোফ হ্যাঙ্গার আরব নিউজকে বলেছিলেন, "এ অবস্থায় আমরা তো গাজায় সহায়তা পৌঁছাতে পারব না।"
গাজায় মানবিক সাহায্য প্রেরণের ব্যাপারে কথা বলতে মিশরে আল-সিসির সাথে সাক্ষাতের কথা ছিল জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের।
জাতিসংঘ প্রধানের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক এক বিবৃতিতে বলেন: "অবশ্যই গাজার মধ্য দিয়ে মানবিক সহায়তা প্রেরণের জন্য আমাদের নিরাপদ প্যাসেজের প্রয়োজন। বোমা নিক্ষেপের মধ্যে আমরা আমাদের যান চলাচল করতে দিতে পারি না।"
এদিকে সৌদি আরবের রাজনৈতিক ভাষ্যকার খালেদ আল-মাইনা বলেন, "ইসরায়েলের জন্মের পর থেকে সৌদি জনগণ এবং সরকার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সবসময়ই সহানুভূতিশীল।"
২০০০ সাল থেকে সৌদি সহায়তা সংস্থা, কেএস রিলিফ খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি, স্যানিটেশন এবং আশ্রয় সহ একাধিক খাতে ফিলিস্তিনি জনগণকে ৬ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা প্রদান করেছে।
শুধুমাত্র ২০২২ সালে সৌদি আরব ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থায় ২৭ মিলিয়ন ডলার সহায়তা করেছে। সোমবার সৌদি ঘোষণা করেছে যে, দেশটি ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস ইন দ্য নিয়ার ইস্ট (ইউএনআরডব্লিউএ)-কে আরও ২ মিলিয়ন ডলার অনুদান দেবে।
শুধু সরকারই নয়, সৌদি আরবের বেসরকারি খাতও সহায়তায় এগিয়ে এসেছে। সৌদির ম্যাকডোনাল্ডস ঘোষণা দিয়েছে গাজার ত্রাণ সহায়তায় ৫৩৩,০০০ ডলার অনুদান দিবে।
২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রথম আরব উপসাগরীয় রাষ্ট্র হিসেবে আব্রাহাম চুক্তির অধীনে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে।
দুই দেশের মধ্যে একটি বিস্তৃত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তি এই বছরের মার্চে কার্যকর হয়, যা ছিল কোনো আরব রাষ্ট্রের সাথে ইসরায়েলের প্রথম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি; আমিরাতের পর বাহরাইন ও মরক্কোও এটি অনুসরণ করে।
গাজায় উদ্ভূত সংকটের প্রতিক্রিয়া হিসাবে সংযুক্ত আরব আমিরাত একটি প্রচারাভিযান চালু করেছে; এর নাম দেয়া হয়েছে, 'তারাহুম'- আরবিতে যার অর্থ দয়া বা সমোবেদনা।
গাজার বেসামরিক নাগরিকদের সহায়তার উদ্দেশ্যে এমিরেটস রেড ক্রিসেন্টের তত্ত্বাবধানে সংযুক্ত আরব আমিরাত অনুদান এবং স্বেচ্ছাসেবকদের আহবান জানিয়েছে; আবুধাবি ক্রুজ টার্মিনালে প্রথম ত্রাণ কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এছাড়াও মঙ্গলবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন রশিদ আল-মাকতুম ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ২০ মিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তা বিধানের নির্দেশ দিয়েছেন।
পিছিয়ে নেই আরেক মুসলিম রাষ্ট্র কাতার। গত সোমবার আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-থানির নির্দেশনায় কাতার ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট ৩৭ টন খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা বহনকারী একটি বিমান মোতায়েন করেছে।
এক বিবৃতিতে কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলে, "গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের ফলে যে কঠিন মানবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য কাতার রাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থনের অংশ এই সহায়তা।"