গাজা যুদ্ধ: ইসরায়েল যে সাফল্য দাবি করছে, বাস্তবে কতখানি সফলতা পাচ্ছে?
গত বছরের ৭ অক্টোবর বিস্ময়ে, আতংকে বিহ্বল হয়ে পড়ে পুরো ইসরায়েলি সমাজ। এদিন ইসরায়েলে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত, সমন্বিত ও মারাত্মক এক অভিযান চালিয়ে তাক লাগিয়ে দেয় হামাস। এতে চমকে যাবার সব উপাদানই ছিল। ইসরায়েলের রয়েছে, বিশ্বের সর্বাধুনিক সামরিক বাহিনী। সুদক্ষ গোয়েন্দা সংস্থা, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা কাঠামো নিয়েও গর্বের অন্ত নেই দেশটির। কিন্তু, সেদিনের হামলা মোকাবিলায় সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ও অসতর্ক ছিল তারা, যা দখলদার ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলেও আঘাত করেছে।
৭ অক্টোবর প্রাথমিক হতচকিত দশা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছে ইসরায়েলের। ওইদিন হামাসের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ধীরে এবং অপর্যাপ্তভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এই ঘটনাও ইসরায়েলের সরকার, সেনাবাহিনী, রাজনীতিবিদদের ঘরে-বাইরে অপদস্থ করেছে।
ইসরায়েলের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া– তাদের সামরিক বাহিনীর সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি অনুসারে নেওয়া হয়, এবং আগে থেকে নির্ধারিত লক্ষ্যবস্তুগুলোর ওপর বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ শুরু হয়। এটি চলমান থাকার মধ্যে সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে একক লক্ষ্যে সংঘবদ্ধ করতে কয়েকদিন লেগে যায়। এরমধ্যে গঠিত হয়- জরুরি জাতীয় ঐক্যের সরকার (যে সরকারের বেশিরভাগ সদস্যই উগ্র ডানপন্থী)। এরপর সামরিক বাহিনীর ৩ লাখ ৬০ হাজার রিজার্ভ সদস্যকে তলবের মধ্যে দিয়ে বিপুল সৈন্য সমাবেশ ঘটানো হয়।
এরমধ্যে গাজা উপত্যকায় চলতে থাকে নির্বিচার বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ। এই শক্তির আশ্রয় নিয়ে, তিন সপ্তাহ পরে গাজায় প্রবেশ করে ইসরায়েলি স্থল সেনারা।
ইসরায়েলি স্থল অভিযান শুরুর পরে কেটে গেছে দুই মাসের বেশি সময়। ইতোমধ্যে গাজা উপত্যকার তিনটি অংশকে একে-অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে ইসরায়েলি সেনারা। গাজা সিটি ও খান ইউনিসকে ঘেরাও করেছে। ভয়াবহ হামলার মুখে বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি পালিয়েছেন গাজার দক্ষিণ অংশে, যেখানে রাফাহ এলাকায় মানবেতর, দুঃসহ অবস্থায় দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তাঁদের।
এদিকে ইসরায়েলের দাবি, তারা হামাসকে এখনো পরাজিত করতে না পারলেও– ঘোষিত লক্ষ্যের কাছাকাছি রয়েছে। এরমধ্যেই হত্যা করেছে হামাসের সাড়ে ৮ হাজার যোদ্ধাকে।
তবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর প্রকাশিত তথ্যে– সামরিক ও কূটনৈতিক নানান ক্ষেত্রেই রয়েছে অসামঞ্জস্য।
সামরিক পারদর্শিতা: পুরোটাই ব্যর্থ নাহলেও, সাফল্য থেকে বহুদূরে
শুধুমাত্র সামরিক ব্যাখ্যায়, ইসরায়েল কিছু মাত্রায় সাফল্য অর্জন করেছে বলা যায়। নগর পরিবেশে জটিল সামরিক অভিযান চালাচ্ছে তারা, এই শহরাঞ্চলের যুদ্ধই আসলে সবচেয়ে মারাত্মক হয়। সেক্ষেত্রে ধীরে পর্যায়ক্রমে– ধীরে ও সতর্কভাবে এগোচ্ছে সেনারা।
ভূমিতে গাজা সিটি ও খান ইউনিসকে তাঁরা ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু এসব শহরে হামাস যোদ্ধাদের পুরোপুরি নির্মূল করতে ব্যর্থ হয়েছে।
প্রচণ্ড প্রতিকূল এ লড়াইয়ের পরিবেশে– সফলভাবে নানান মানের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সেনা ইউনিটের মধ্যে– সমন্বয় ঘটাতে পেরেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এদের মধ্যে বিভিন্ন রকম স্পেশাল ইউনিটও রয়েছে, যারা প্রচলিত আঞ্চলিক বা ব্রিগেড কমান্ডের বাইরে সরাসরি ইসরায়েলি জেনারেল স্টাফের কাছে রিপোর্ট করে।
চেইন অব কমান্ডের এ ধরনের জটিল ব্যবস্থাপনার কারণে ফ্রন্টলাইনে বেশিসংখ্যক পদস্থ কর্মকর্তাদের উপস্থিত থাকতে হচ্ছে, যাতে বিভিন্ন ইউনিটের কার্যক্রম পরিচালনায় বিভ্রান্তি এড়ানো সম্ভব হয়, এবং তাদের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় থাকে। কিন্তু, এতে পদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের নিহত হওয়ার ঘটনাও বেড়েছে। যেমন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এপর্যন্ত যে ১৭২ জন সদস্যের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে, তাদের মধ্যে সিনিয়র নন-কমিশন অফিসারদের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। এর বাইরে কমিশন র্যাঙ্কের অফিসারদের নিহত হওয়ার সংখ্যাও উচ্চ, যেমন এপর্যন্ত অন্তত চারজন পূর্ণ কর্নেল পদমর্যাদার কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েল যতোটা দাবি করছে, নিঃসন্দেহে তার চেয়ে হামাসের কম সংখ্যক সদস্যই নিহত হয়েছে। একটি বিশ্বাসযোগ্য হিসাব অনুযায়ী, এই সংখ্যা সাড়ে ৩ হাজার হতে পারে– যা হামাসের ফ্রন্টলাইন শক্তির মাত্র ২০ শতাংশ। এই হিসাবে দেখা যায়, প্রতি ১ জন ইসরায়েলি সেনার বিপরীতে নিহত হয়েছেন ২০ হামাস যোদ্ধা।
গতানুগতিক যুদ্ধে যেকোনো জেনারেলই এই অনুপাতকে বিজয় হিসেবে ধরে নিয়ে সানন্দে মেনে নিতেন। তবে এই যুদ্ধের বেলায় তা খাটে না। কারণ হামাসের যোদ্ধারা আদর্শিক ও ধর্মীয় ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত, এবং তাঁরা মৃত্যুর পরোয়া না করায় দীক্ষিত। যেকোনো মূল্যে শত্রুর বিনাশই যেখানে মূল লক্ষ্য, এবং নিহতদের দেখা হয় শহীদ হিসেবে। এতে তাদের মনোবল আরও দৃঢ়তা পেয়েছে।
সে তুলনায়, ইসরায়েলি সমাজ ব্যাপকভাবে সামরিকায়িত হলেও– জনগণের মধ্যে নিজস্ব সেনাদের প্রাণহানি মেনে নেওয়ার মতো সহিষ্ণুতা যথেষ্টই কম। অথচ অতি-ধার্মিক ইহুদিরা ছাড়া প্রায় সকলেই– নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সামরিক বাহিনী সার্ভিসে যুক্ত থাকেন। এরপর তাঁরা আবার বেসামরিক জীবনে ফিরে যান। কিন্তু, নিজ 'স্বামী, সন্তান বা ভাইদের'-দের ব্যাপক হারে মৃত্যুর বিনিময়ে এই যুদ্ধে কাঙ্ক্ষিত কোনো সাফল্য দেখছেন না ইসরায়েলিরা।
যুদ্ধে প্রাণহানির বিষয়ে তাঁদের এই মনোভাব আরও স্পষ্টভাবে দেখা যায় গোলানি ব্রিগেডের ক্ষেত্রে। এটি ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সবচেয়ে পুরোনো ও সবচেয়ে খেতাবপ্রাপ্ত ইউনিট। গাজায় যুদ্ধ করতে গিয়ে ৭২ সেনা নিহত হওয়ার পরে, গোলানি ব্রিগেডকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় তেল আবিব।
সবশেষে বলা যায়, ইসরায়েলি বাহিনী ব্যাপক সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব ও মনোবলের দাবি করলেও– কার্যত হামাসের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ককে চিরতরে ধবংস করতে সক্ষমতা ও দৃঢ়তার অভাবই দেখা গেছে। দুই-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদ দিলে– ব্যাপক হতাহতের ভয়ে হামাসের টানেল নেটওয়ার্কে ইসরায়েলি সেনারা প্রবেশ করতে ভয় পাচ্ছে। এই অবস্থায়, সাগরজল দিয়ে হামাসের সুড়ঙ্গগুলো প্লাবিত করতে চাইছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী, তবে এখনও এই কৌশল প্রয়োগ করেনি তারা।
জিম্মি উদ্ধারে সম্পূর্ণ ব্যর্থ
হামাসকে ধবংস করা ছাড়াও ইসরায়েলের ঘোষিত আরেকটি লক্ষ্য হচ্ছে– হামাসের হাতে থাকা জিম্মিদের উদ্ধার। কিন্তু, এপর্যন্ত এই লক্ষ্য শুধু ব্যর্থই হয়নি, বরং ইসরায়েলি সেনাদের দ্বারাই নিহত হয়েছে তিন জিম্মি। ইসরায়েলি স্থল অভিযান শুরু আগে, হামাস জানিয়েছিল, নির্বিচার বিমান হামলায় কিছু জিম্মি মারাও গেছে।
সামরিক প্রযুক্তি বিশ্বসেরা: তবু কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অধরা
সামরিক প্রযুক্তির অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বে নেতৃত্ব দেয় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। তাদের বেশিরভাগ সমরাস্ত্র ও সফটওয়্যার সামরিক বাহিনীর উচ্চ প্রত্যাশাকে পূরণ করেছে। এতে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এসব অস্ত্রের রপ্তানি বাড়বে, যুদ্ধের বিপুল খরচের কিছুটা হলেও তার মাধ্যমে পুষিয়ে নেওয়া যাবে।
গাজার যুদ্ধে সার্ভিসে আগে যুক্ত হওয়া অস্ত্রের সাথে একেবারেই আনকোড়া নতুন অস্ত্রও ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন– আরও এক বছর পর সার্ভিসে যুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও– যুদ্ধের কারণে চটজলদি লড়াইয়ে পাঠানো হয়েছে ইসরায়েলের তৈরি 'এইতান আর্মার্ড ফাইটিং ভিহেইকেল। সেক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যাও হয়নি। আয়রন স্টিং নামক নতুন মর্টার এবং ছোট ও সস্তা নজরদারি ড্রোনও নগরযুদ্ধের ময়দানে মূল্যবান সম্পদ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
বিদ্যমান সমরাস্ত্রও নগর পরিবেশে ব্যবহার উপযোগিতার প্রমাণ দিয়েছে। যেমন ইসরায়েলের সকল সেনা এখন বডি ক্যামেরা ব্যবহার করছে। ডগ স্কোয়াডের কুকুরদের গায়ে ক্যামেরা ব্যবহার করেও, ভবন তল্লাশী চালানো হচ্ছে। এতে হামাসের পেতে রাখা বোমা ও ফাঁদ (বুবি ট্র্যাপ) এড়ানো যাচ্ছে অনেকাংশে।
বিভিন্ন সামরিক প্ল্যাটফর্মের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে কমব্যাট ডেটা লিঙ্ক। এটি গোপন রাখতে সফল হয়েছে ইসরায়েল। রিয়েল টাইম এনক্রিপটেড এই ব্যবস্থাকে হামাস ব্যাহত করতে পেরেছে, বা যোগাযোগে আড়ি পাততে পেরেছে– এমন কোনো ঘটনা সামনে আসেনি।
তবে কিছু অস্ত্র ব্যবস্থায় সমস্যা রয়েই গেছে, যেমন সাঁজোয়া যান ও ট্যাংকে মোতায়েন করা ট্রফি অ্যাকটিভ প্রটেকশন সিস্টেম কাছাকাছি দূরত্বের লড়াইয়ে কিছুক্ষেত্রে সামান্য কার্যকারীতা দেখিয়েছে, নাহলে একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে। অথচ, সমর যানের সুরক্ষায় এই সিস্টেমের ওপর অতি-নির্ভর করেছিল ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। তাই এটির ব্যর্থতায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সেনা হতাহত হয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে এই যুদ্ধে নতুন করেও অনেক কিছু শিখতে হয়েছে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে। যেমন হামাসের আক্রমণ বুঝিয়ে দেয়, মার্কাভা ট্যাংকের উপরিভাগ তুলনামূলক অরক্ষিত। খুব শিগগিরই এতে বাড়তি সুরক্ষা ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়। কিন্তু, সামরিক অভিযানে কার্যকর প্রমাণিত হলেও– ইসরায়েলের কোনো প্রযুক্তিই প্রকৃত 'গেম চেঞ্জার' এর ভূমিকা রাখতে পারেনি।