জলবায়ু পরিবর্তন: বরফ গলার কারণে খাদ্য সংকটে পড়ছে মেরু ভালুক
আর্কটিক সাগরে বরফ গলে যাওয়ার কারণে মেরু ভালুকরা খাদ্য সংকটে পড়ছে। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, বরফ গলে যাওয়ার কারণে তাদের খাদ্যাভ্যাসের যে পরিবর্তন ঘটেছে, তার সাথে মানিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে এই প্রাণীটির জন্য।
আর্কটিকের এই বিখ্যাত প্রাণী সাধারণত খাদ্য হিসেবে উপকূলে বরফের উপর রিংযুক্ত সীল শিকার করে।
কিন্তু বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভালুক তীরে বেশি সময় কাটাচ্ছে কারণ খাদ্য হিসেবে প্রাণিগুলোর পাখির ডিম, বেরি এবং ঘাসের দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে।
এতে প্রাণীগুলোর দ্রুত ওজন কমার পাশাপাশি মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।
মেরু ভালুক আর্কটিকের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রান-প্রকৃতির যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তবে প্রাণীটির উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অনেক জটিল।
১৯৮০ এর দশকে অপরিকল্পিত শিকারের কারণে মেরু ভালুকের সংখ্যা কমে গিয়েছিল।
বৃহত্তর আইনি সুরক্ষার কারণে মেরু ভালুকের সংখ্যা বাড়লেও বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে এখন সেগুলো সব থেকে বেশী হুমকির মুখে পড়েছে।
আর্কটিকের বরফ ভালুকগুলোর বেঁচে থাকার চাবিকাঠি হলেও বরফ গলায় প্রাণীগুলো খাদ্য সংকট সহ অন্যান্য প্রতিকূলতার মুখোমুখি হচ্ছে।
মেরু ভালুক সামুদ্রিক বরফকে একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে রিংযুক্ত সীল শিকার করে। বসন্তের শেষেরদিকে এবং গ্রীষ্মের শুরুতে সীলগুলোতে চর্বি বেশি থাকে। এই চর্বি মেরু ভালুকের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু উষ্ণ মাসগুলোতে আর্কটিকের অনেক অংশেই এখন বরফের পরিমাণ কমে গেছে।
এই গবেষণাটি পশ্চিম ম্যানিটোবায় চালানো হয়েছে। দেখা গেছে, ১৯৭৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই অঞ্চল বরফমুক্ত থাকার সময়কাল তিন সপ্তাহ বৃদ্ধি পেয়েছে।
বরফ গলে যাওয়ার সাথে সাথে প্রাণীগুলো কীভাবে বেঁচে থাকে তা বোঝার জন্য গবেষকরা তিন বছর সময় নিয়ে গ্রীষ্মের মাসগুলোতে ২০টি মেরু ভালকের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে।
রক্তের নমুনা সংগ্রহ করার পাশাপাশি ভালুকের ওজন মাপার জন্য প্রাণীগুলোর গলায় জিপিএস-সজ্জিত ভিডিও ক্যামেরা কলার পড়ানো হয়েছিল।
এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা প্রাণীগুলোর গতিবিধি, কর্মকাণ্ড এবং খাদ্যাভ্যাস বুঝতে সক্ষম হয়।
গ্রীষ্মের মাসগুলোতে যখন বরফ সম্পূর্ণ গলে যায় তখন ভালুকগুলো বেঁচে থাকার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছিল। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল পর্যাপ্ত বিশ্রাম গ্রহণের মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করা।
অধিকাংশ ভালুক গাছপালা বা বেরি খাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কোনো কোনো ভালুক সাঁতার কেটে খাবারের সন্ধান করেছিল।
কিন্তু গবেষণা বলছে, উভয় পদ্ধতিতেই ভালুকগুলো পর্যাপ্ত খাবার পায়নি। ২০ টি ভালুকের মধ্যে ১৯ টি ভালুকের ওজন কমে গেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভালুকগুলোর ওজন ১১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। গড়ে ভালুকগুলোর ওজন দিনে এক কেজি করে কমেছে।
আলাস্কায় চালানো ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভের প্রধান লেখক ড. অ্যান্থনি প্যাগানো বলেছেন, "ভালুকগুলো যেই কৌশলই ব্যবহার করুক না কেন, মাটিতে বেঁচে থাকার সময়কাল দীর্ঘ করতে সক্ষম হওয়ার আগে পর্যন্ত সেগুলো কোন সুবিধা করতে পারবে না।"
ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সির বিয়ার (ভালুক) সেন্টারের সহ-লেখক চার্লস রবিন্স বলেছেন, "মেরু ভালুক সাদা কোট পরা গ্রিজলি ভালুক নয়। এরা অনেক আলাদা।"
যে তিনটি ভালুক পানিতে নেমেছিল সেগুলোর মধ্যে দুটো ভালুক মৃত প্রাণীর দেহ খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু ভালুকগুলো পরিশ্রম করে খুব ক্লান্ত ছিল বলে বেশিক্ষণ খেতে পারেনি।
ডা. প্যাগানো বিবিসি নিউজকে বলেছেন, "একটি প্রাক-প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা মেরু ভালুক একটি মৃত বেলুগা তিমি খুঁজে পেয়েছিল। অল্প কয়েকটি কামড় দেওয়ার পর প্রাণীটি মৃতদেহটিকে বিশ্রামের জন্য ব্যবহার করে। এটি প্রমাণ করে, ভালুকগুলো একই সাথে খাওয়া এবং সাঁতার কাটার মত কাজ করতে পারে না।"
গবেষণার অন্যতম আশ্চর্যজনক ফলাফল ছিল, একটি মেরু ভালুকের ওজন ৩২ কেজি বেড়েছে!
গবেষকরা বিশ্বাস করেন, এই ভালুকটি বেশিরভাগ সময় বিশ্রাম নিয়ে এবং শক্তি সঞ্চয় করে কাটিয়েছে। পাশাপাশি সৌভাগ্যজনকভাবে ভালুকটি একটি প্রাণীর মৃতদেহের সন্ধান পেয়েছিল
যদিও পূর্ববর্তী গবেষণা থেকে পরবর্তী কয়েক দশকের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক দিক গুলো জানা গেছে, নতুন এই কাজটি থেকে মেরু ভালুকের প্রজাতির জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।
অন্যান্য গবেষকরা বলেছেন, অবস্থানের উপর নির্ভর করে মেরু ভালুকের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আলাদা হবে।
নরওয়েজিয়ান পোলার ইনস্টিটিউটের জন আরস বলেছেন, "সম্ভবত মেরু ভালুকগুলো ভবিষ্যতে যেখানেই সমুদ্রের বরফ গলে শেষ হয়ে যাবে, সেখান থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু কখন এবং কোথায় সেটা বলা কঠিন।"
গবেষণায় যুক্ত না থাকা আরস বলেন, "কিছু অঞ্চলে ভালুকগুলো আরো কয়েক দশক ধরে ভালো থাকবে।"
তিনি আরো জানিয়েছেন, "এই গবেষণাটি এমন একটি ক্ষেত্র নিয়ে করা হয়েছে যেখানে কোন পূর্বাভাস ছাড়াই সমুদ্রের বরফ গলতে থাকলে পরিস্থিতি খুব অল্প সময়ের মধ্যে মেরু ভালুকের জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে।"
গবেষণাটি "নেচার কমিউনিকেশন" জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: তাসবিবুল গনি নিলয়