গ্রিনল্যান্ড কোথায়, কার নিয়ন্ত্রণে, ট্রাম্প কেন কিনে নিতে চান, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ?
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন। আর্কটিক অঞ্চলের এই দ্বীপটি এখন ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণে আছে।
ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে তোলপাড় চলছে আন্তর্জাতিক মহলে।
এর মধ্যেই ট্রাম্পের ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়রও গ্রিনল্যান্ড সফরে পৌঁছেছেন। এসব ঘটনাপ্রবাহই দ্বীপটি জল্পনা-কল্পনার আগুনে ঘি ঢেলেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প কেন গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতে চান—আর এখনই বা কেন?
গ্রিনল্যান্ড কোথায়?
পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপ গ্রিনল্যান্ড আর্কটিক অঞ্চলে অবস্থিত।
দ্বীপটি বিশ্বের সবচেয়ে কম জনবহুল অঞ্চলগুলোর একটি। প্রায় ৫৬ হাজার মানুষ বসবাস করে গ্রিনল্যান্ডে, যাদের বেশিরভাগই ইনুইট আদিবাসী।
গ্রিনল্যান্ডের প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা বরফে আচ্ছাদিত। এ কারণে বেশিরভাগ মানুষ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে রাজধানী নুক-এর আশপাশে বাস করে।
দ্বীপটি ডেনমার্কের একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। ডেনিশ ও মার্কিন সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে এখানে।
গ্রিনল্যান্ডের অর্থনীতি মূলত মৎস্য আহরণের ওপর নির্ভরশীল। এখানকার মোট জিডিপির এক-পঞ্চমাংশই ডেনমার্ক সরকারের দেওয়া মোটা অঙ্কের ভর্তুকি।
গ্রিনল্যান্ডের ভূরাজনৈতিক অবস্থান অনন্য। দ্বীপটি বসে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মাঝখানে। গ্রিনল্যান্ডের রাজধানী নুক যতটা না ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনের কাছে, তার চেয়ে বেশি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কাছে।
গত কয়েক বছরে বিরল মৃত্তিকা ধাতু, ইউরেনিয়াম ও লোহাসহ গ্রিনল্যান্ডের বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি বড় শক্তিগুলোর আগ্রহ বেড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে গ্রিনল্যান্ডের বরফের কিছু অংশ গলে গেলে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন করা সম্ভব হতে পারে।
গ্রিনল্যান্ডের প্রেক্ষাপট
গ্রিনল্যান্ড ভৌগোলিকভাবে উত্তর আমেরিকায় অবস্থিত। তবে গত ৩০০ বছর ধরে অঞ্চলটি ডেনমার্কের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ডেনমার্ক থেকে গ্রিনল্যান্ডের দূরত্ব প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার।
২৯ শতকের মধ্যভাগে দ্বীপটি উপনিবেশ হিসেবে শাসিত হতো। তখন বেশিরভাগ সময়ই এ অঞ্চল ছিল বিচ্ছিন্ন ও দারিদ্র্যপীড়িত।
১৯৫৩ সালে গ্রিনল্যান্ড ডেনমার্কের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং গ্রিনল্যান্ডবাসীরা ডেনিশ নাগরিকত্ব পায়।
১৯৭৯ সালে গণভোটের মাধ্যমে গ্রিনল্যান্ড স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। তবে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষানীতি এখনও ডেনমার্কই নিয়ন্ত্রণ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গ্রিনল্যান্ড কেন গুরুত্বপূর্ণ?
যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই গ্রিনল্যান্ডে কৌশলগত নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষা করে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানি ডেনমার্কের মূল ভূখণ্ড দখল করে নেয়। তখন গ্রিনল্যান্ডে মার্কিন বাহিনী প্রবেশ করে ওই অঞ্চলজুড়ে সামরিক ঘাঁটি ও রেডিও স্টেশন স্থাপন করে।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও মার্কিন বাহিনী গ্রিনল্যান্ডে থেকে যায়। তখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রই পিটুফিক স্পেস বেজ (আগের নাম থুলে এয়ার বেজ) পরিচালনা করে আসছে।
১৯৫১ সালে ডেনমার্কের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি করার পর গ্রিনল্যান্ডে সামরিক ঘাঁটি তৈরি ও পরিচালনার অধিকার লাভ করে যুক্তরাষ্ট্র। মস্কো ও নিউইয়র্কের মাঝামাঝি অবস্থিত পিটুনিক বেজ মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর সর্ব-উত্তরের ঘাঁটি। এই ঘাঁটি ক্ষেপণাস্ত্র সতর্কব্যবস্থা সজ্জিত।
রয়্যাল ড্যানিশ ডিফেন্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মার্ক জ্যাকবসেন বিবিসিকে বলেন, 'রাশিয়া যদি যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে মিসাইল নিক্ষেপ করত, তবে পারমাণবিক অস্ত্র পাঠানোর সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ হতো উত্তর মেরু এবং গ্রিনল্যান্ডের মধ্য দিয়ে। এ কারণেই পিটুফিক স্পেস বেজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
আর্কটিক ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছরে চীন ও রাশিয়া আর্কটিক অঞ্চলে তাদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি আরও জোরালো করার আহ্বান জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
এই অঞ্চলে ওয়াশিংটনের 'বৈধ' স্বার্থ রয়েছে উল্লেখ করে বুধবার ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লার্স লক্কে রাসমুসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলা রেখেছে ডেনমার্ক।
রাসমুসেন বলেন, 'আমরা দেখছি রাশিয়া তার সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে। আমরা দেখছি চীনও এই অঞ্চলে আগ্রহ দেখাচ্ছে।'
অধ্যাপক জ্যাকবসেন আরও বলেন, ট্রাম্প গ্রিনল্যান্ডের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের সম্ভাবনায়ও আগ্রহী হতে পারেন।
'গ্রিনল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে থাকা, উত্তোলন না করা বিরল মৃত্তিকা ধাতুর প্রতি এখন বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে উইন্ড টারবাইন পর্যন্ত সব ধরনের প্রযুক্তিতে এই খনিজগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
এছাড়া বরফ গলার ফলে গ্রিনল্যান্ডের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন এলে তাতে অর্থনৈতিক সুবিধা পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। আর্কটিকে বরফ গলতে থাকায় সেখানে জাহাজ চলাচলের নতুন নতুন পথ খুলে যাচ্ছে। ২০২৪ সালের আগপর্যন্ত এক দশকে এ অঞ্চলে জাহাজ চলাচল বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। আর্কটিক কাউন্সিলের মতে, জাহাজের চলাচল এতটা বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ বরফ গলে যাওয়া।
যুক্তরাষ্ট্র কি গ্রিনল্যান্ডের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চায়?
ট্রাম্প দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
যদিও তার মন্তব্য অস্বাভাবিক মনে হতে পারে, তবে গত ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রেসিডেন্ট গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার চেষ্টা করেছেন।
আর্কটিক নিরাপত্তাবিষয়ক নিউজলেটার '৬৬° নর্থ'-এর লেখক লুকাস ওয়াডেন, 'যুক্তরাষ্ট্র কয়েকবার ডেনিশদের গ্রিনল্যান্ড থেকে সরিয়ে জায়গাটিকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে চেয়েছে, অথবা অন্তত গ্রিনল্যান্ডের সম্পূর্ণ নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে চেয়েছে।'
১৮৬৭ সালে রাশিয়ার কাছ থেকে আলাস্কা কিনে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম এইচ সিউয়ার্ড-এর নেতৃত্বে ডেনমার্কের কাছ থেকে গ্রিনল্যান্ড কিনতেও আলোচনা হয়। কিন্তু সিউয়ার্ড কোনো চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেননি।
জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য বিবেচনায় ১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র ১০০ মিলিয়ন ডলারে (এখনকার হিসাবে প্রায় ১.২ বিলিয়ন ডলার) গ্রিনল্যান্ড কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে ডেনিশ সরকার সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।
প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পও গ্রিনল্যান্ড কেনার চেষ্টা করেছিলেন। ২০১৯ সালের সেই প্রস্তাব ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ড উভয়ই প্রত্যাখ্যান করে। তারা স্পষ্ট বলে দেয়: 'গ্রিনল্যান্ড বিক্রির জন্য নয়।'
গ্রিনল্যান্ডের জনগণ কী ভাবছে?
গ্রিনল্যান্ডের পার্লামেন্ট ইনাটসিসার্টুট-এর সদস্য কুনো ফেনকার বুধবার বলেন, তিনি ট্রাম্পের মন্তব্যকে হুমকি হিসেবে দেখছেন না।
গ্রিনল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা ফেনকার বিবিসিকে বলেন, সার্বভৌম গ্রিনল্যান্ড প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করতে পারে।
তবে ২০১৯ সালে ট্রাম্প যখন প্রথম গ্রিনল্যান্ড কেনার প্রস্তাব দেন, তখন অনেক স্থানীয় বাসিন্দা এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
পূর্ব গ্রিনল্যান্ডের তাসিলাক শহরে জন্মগ্রহণ করা ও বড় হওয়া ট্যুর অপারেটর ডাইনস মিকেলসেন বলেন, 'এটা খুব বিপজ্জনক একটা আইডিয়া।'
গ্রিনল্যান্ডের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী আলেকা হ্যামন্ড বলেন, 'তিনি আমাদেরকে ক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবে দেখছেন। তিনি গ্রিনল্যান্ডের সঙ্গে কথাও বলছেন না—গ্রিনল্যান্ড কেনার বিষয়ে কথা বলছেন ডেনমার্কের সঙ্গে।'