টাইটানিক দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া নাবিকের স্মৃতি: ‘বোধহয় আজ রাতেও ওটা নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখব’
সৃষ্টির পর প্রথমবার সমুদ্রে নেমেই ডুবে গিয়েছিল টাইটানিক। সে ঘটনার ১০০ বছর পার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জাহাজটির যাত্রী ও গত শতাব্দীর অন্যতম বড় এ দুর্ঘটনার ভুক্তভোগী প্রত্যক্ষ্যদর্শী ফ্রাঙ্ক প্রেন্টিসের বর্ণিত অভিজ্ঞতা এখনো সমান রোমহর্ষক।
টাইটানিকে চড়ার সময় ২৩ বছর বয়সি যুবক ছিলেন ফ্রাঙ্ক প্রেন্টিস। ৬৭ বছর পর তার সাক্ষাৎকার নেয় বিবিসি। তখনি বোঝা গিয়েছিল, ভয়াল ওই রাত তাকে এখনো তাড়া করে বেড়ায়। ১৯১২ সালের ১৪ এপ্রিল আটলান্টিক মহাসাগরে একটি ভাসমান বরফখণ্ডের গায়ে ধাক্কা লেগে টাইটানিক ডুবে গেলে দেড় হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন।
জাহাজের একজন কর্মী ছিলেন প্রেন্টিস; অর্থ ও রসদ দেখাশোনা করতেন তিনি। ১৯৭৯ সালে বিবিসির ডকুমেন্টারি সিরিজ দ্য গ্রেট লাইনার্স-এ তিনি স্মৃতিচারণ করেছিলেন সে মুহূর্তটির কথা যখন তিনি টের পেয়েছিলেন, জাহাজে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে।
'ওরকম বলতে গেলে কোনো ধাক্কা অনুভূত হয়নি। গাড়ির ব্রেক জোরে চাপলে যেমন লাগে, ওরকমই ছিল ঘটনাটা। তারপর জাহাজ থেমে যায়। জাহাজের একটা পোর্টহোল খোলা ছিল। আমি সেটা দিয়ে বাইরে তাকালাম। দেখি আকাশ পরিষ্কার, ঝকঝকে তারা দেখা যাচ্ছে, সমুদ্রও মহাশান্ত। ঘটনা কী কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।'
পরিস্থিতি বোঝার জন্য কেবিন ছেড়ে ডেকে যান প্রেন্টিস। তিনি কিছু বরফ দেখেছিলেন বটে, তবে পানিতে হিমশৈল বা পানির ওপরে জাহাজের গায়ে কোনো ক্ষতির চিহ্ন দেখা যায়নি। কিন্তু পানির তলায় জাহাজের গায়ে তৈরি হওয়া ফাটল ছিল মারাত্মক। তখন মনে করা হতো, টাইটানিক কোনোদিন ডুববে না।
নারী ও শিশুদের লাইফবোটে ওঠার আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রেন্টিস জানান, অনেকে তা করতে অনিচ্ছুক ছিলেন। এর কারণ ছিল দুটো: জাহাজ থেকে লাইফবোট সমুদ্রে ফেলার উচ্চতা ছিল ৭০ ফুট (২১.৩ মিটার) এবং মানুষজন তখনো বিশ্বাস করেননি এ জাহাজ আদতে ডুবতে পারে।
'ভুলবেন না যে আমাদের ১৬টা লাইফবোট ছিল, প্রতিটাতে ৫০ জন বসতে পারত। সবগুলো ভরাট হলে আমরা ৮০০ জনকে বাঁচাতে পারতাম, কিন্তু লাইফবোটের কল্যাণে দুর্ঘটনায় বাঁচার সংখ্যা ছিল ৫০০,' তিনি বলেন।
প্রেন্টিস ও আরও কয়েকজন মানুষকে আদেশ দেওয়া হয় জাহাজের ভাঁড়ারঘর থেকে যতটা সম্ভব বিস্কুট নিয়ে আসতে। তারা যখন ডেকে ফিরে আসেন, ততক্ষণে জাহাজ একপাশে হেলে পড়েছে। ফরে প্রেন্টিস আর লাইফবোটে পৌঁছাতে পারেননি। দ্রুত লাইফ জ্যাকেট গায়ে দিতে শুরু করলেন তিন। জাহাজের তৃতীয় শ্রেণীর যাত্রীর ডেকে উঠে এসেছেন, সবার মধ্যে আতঙ্ক।
তারপর টাইটানিক ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেল।
'হঠাৎ জাহাজটার দুপাশ ওপরের দিকে উঠে গেল। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল জাহাজ ভেঙে টুকরো হয়ে যাচ্ছে,' ফ্রাঙ্ক প্রেন্টিস বলেন।
একটা তক্তা ধরে ঝুলে ছিলেন প্রেন্টিস। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে হাত ছেড়ে দিতে হয়। তিনি পড়ে যান পানিতে। 'আমার গায়ে একটা লাইফবেল্ট ছিল। পানিতে ভীষণ শব্দ করে পড়ি,' তিনি বলেন। 'চারপাশে মরা ভেসে থাকা' পানিতে আধাডোবা অবস্থায় তিনি দেখলেন, টাইটানিক ধীরে ধীরে পানির তলায় চলে যাচ্ছে।
'ক্রমেই জমে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় একটা লাইফবোটের কাছাকাছি আসি। তারা আমাকে টেনে তুলে নেন,' বলেন এ সৌভাগ্যবান নাবিক।
সমুদ্রে ৬০ মাইল দূরে অবস্থান করছিল আরএমএস কার্পাথিয়া। টাইটানিকের ডিসট্রেস কল শুনে এটি দিক বদল করে অকুস্থলে পৌঁছায় এবং বেঁচে যাওয়া ৭০০ জনকে নিউ ইয়র্কে নিয়ে আসে।
১৯৮২ সালে ৯৩ বছর বয়সে মারা যান ফ্রাঙ্ক প্রেন্টিস। দুর্ঘটনার রাতে তার ঘড়িটি ২টা ২০ মিনিটে জমে গিয়েছিল। সে ঘড়ি স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বাকি জীবন নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন তিনি।
সাক্ষাৎকারে তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ওই সময়ে এসে তিনি টাইটানিক নিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করেন কি না। তিনি বলেন: 'আজ রাতেও মনে হয় আমি ওটা নিয়ে স্বপ্ন দেখব; দুঃস্বপ্ন দেখতে হবে।
'আপনারা ভাববেন, আমি যথেষ্ট বুড়ো হয়ে গেছি, এখন আর ওসব দুঃস্বপ্ন আমার দেখার কথা নয়। কিন্তু বরং অবাকই হবেন। রাতে বিছানায় গাটা এলিয়ে দিন, পুরো ঘটনা আবার চোখের সামনে ভেসে উঠবে।'