সৈন্যদলে ভর্তি এড়াতে পাহাড়ি পথ, নদী সাঁতরে পালাচ্ছেন ইউক্রেনীয়রা
টাইসা নদী বেশ স্রোতঃস্বিনী, পাড়গুলো উঁচু আর কাদায় ভেজা, নদীর বুকেও লুকানো রয়েছে শক্ত পাথরের বোল্ডার। কিন্তু এসব কিছুকে পরোয়া করছেন না যুদ্ধে বাধ্যতামূলকভাবে অংশ নেওয়া থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাওয়া ইউক্রেনীয়রা।
টাইসার সঙ্গে রোমানিয়ার সীমান্ত রয়েছে। এ সীমান্ত অঞ্চল দিয়েই সামরিক ড্রাফট এড়াতে চাওয়া ব্যক্তিরা নদী পার হওয়ার চেষ্টা করেন। পূর্ব রণাঙ্গনের বিপদসংকুল যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়ে তারা এ ভয়ংকর নদী পার হওয়ার চেষ্টাকেই বেশি উপযুক্ত মনে করছেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দুই বছরের বেশি সময় গড়িয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি চাচ্ছেন নতুন করে সৈন্য পাঠাতে যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে। কিন্তু হাজারো ইউক্রেনীয় যুদ্ধের বদলে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার চেষ্টায় প্রেসিডেন্টের সেই লক্ষ্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
ইউক্রেনের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট ভ্লাদিস্লাভ টঙ্কোস্থান বলেন, 'আমাদের এ মানুষদের বিচার করা উচিত নয়। কিন্তু সবাই যদি চলে যায়, তাহলে ইউক্রেনকে রক্ষা করবে কে?'
এ মুহূর্তে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে হলে ইউক্রেনকে এর অস্ত্রভান্ডার আবারও পূর্ণ করতে হবে। আর এ বিষয়টি অনেক বেশি পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। একইসঙ্গে ইউক্রেনকে যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন করে সৈন্য পাঠাতে হবে।
কিন্তু নতুন করে সেনাদলে ভর্তি করানো দেশটির জন্য কঠিন আর ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কয়েক মাসের বিলম্ব ও আলোচনার পর ১১ এপ্রিল ইউক্রেনের পার্লামেন্ট ড্রাফট, অর্থাৎ বাধ্যতামূলক সেনাদলে ভর্তি করানোকে আরও বিস্তৃত পরিসরে নেওয়ার জন্য একটি আইন পাশ করেছে।
ইউক্রেনের জেনারেলরাও স্বীকার করেছেন, তাদের সেনাসংকট তীব্ররূপ নিয়েছে। সম্প্রতি পার্লামেন্টে দেওয়া এক বক্তৃতায় ইউক্রেনীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল ইউরি সডল জানান, রণাঙ্গনের কিছু কিছু জায়গায় রাশিয়ান ও ইউক্রেনের সেনার অনুপাত সাত অনুপাত একে দাঁড়িয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অনেক ইউক্রেনীয় স্বেচ্ছায় যুদ্ধে অংশ নেন। এরপর থেকেই তারা যুদ্ধ করে গেছেন। বছরে এক বা দুসপ্তাহ করে ছুটি পেয়েছেন তারা। সাধারণত যারা সেনাদলে ভর্তি হন, তারা যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত থাকার শর্তে ভর্তি হন। তাদের চাকরি শেষ হওয়ার কোনো নির্দিষ্ট তারিখ থাকে না।
বর্তমানে যুদ্ধে প্রচুর সংখ্যক সৈন্য নিহত হচ্ছেন। তাই যারা ড্রাফটের নিয়মে বাধ্য হয়ে যুদ্ধে যাচ্ছেন, তাদের আশঙ্কা এটা তাদের অগস্ত্যযাত্রা হবে।
রণাঙ্গনে ইউক্রেনের সাফল্যের সম্ভাবনা বর্তমানে থমকে আছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ড্রাফট এড়ানোর চেষ্টা করা মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। দেশ ছেড়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ছয় হাজারের বেশি মানুষ টাইসা নদী পাড়ি দিয়ে রোমানিয়ায় পৌঁছেছেন বলে জানিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। এ পর্যন্ত রোমানিয়া-ইউক্রেন দুই দেশের পাড়েই ২২ জনের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে।
তবে নদী পার হওয়ার সময় ডুবে মরার প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ফলে টাইসা নদী এখন পরিচিত হয়ে উঠেছে 'ডেথ রিভার' নামে। যদিও মূল রণাঙ্গনের লড়াই থেকে এ নদীর দূরত্ব কয়েকশ মাইল।
ইউক্রেনীয়দের সীমান্ত অতিক্রম করার এ প্রবণতাটি বর্তমানে চোরাকারবারের মতো রূপ নিয়েছে। পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি ও রোমানিয়ার সঙ্গে সীমান্ত থাকা দেশটির কার্পাথিয়ান পর্বতমালায় এখন অনেকে দেশছাড়া ব্যক্তিদের সীমান্ত অতিক্রমে সহায়তা করার ব্যবসায় নেমেছে।
ইউক্রেনের সীমান্তরক্ষী বাহিনী জানিয়েছে, অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করা ব্যক্তিদের আটক করলেও তারা নির্ধারণ করতে পারেন না ওই ব্যক্তি ড্রাফট থেকে বাঁচতে সীমান্ত করতে চাচ্ছিলেন কি না। কারণ ওই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কেবল আদালতের রয়েছে। তবে সীমান্ত অতিক্রম করার যে হার বেড়েছে, তা স্পষ্ট।
স্থানীয় একটি বর্ডার গার্ড ইউনিটের একজন মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট লেসিয়া ফেদোরোভা বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর সীমান্ত পাড়ি দিতে খরচ হতো জনপ্রতি দুই হাজার ডলার। এখন সে অঙ্ক ১০ হাজার ডলার পর্যন্তও উঠেছে।
টাইসা নদীর তীরে রাতের আড়ালে বেশিরভাগ মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করতে চান। কিন্তু রাতের বেলা নদীর স্রোত ও গভীরতা অনুমান করা কঠিন বলে জানিয়েছে সীমান্তরক্ষীরা।
'কতশত প্রাণ রণাঙ্গনে ঝরে যাচ্ছে। এ মানুষগুলো বাঁচার আশায় এ নদীকেই অবলম্বন করেন,' বলেন লেফটেন্যান্ট ফেদোরোভা।