তিনি মা দিবস প্রবর্তন করেন—তারপর বাকি জীবন এর বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছেন
মা দিবসের প্রবক্তা আনা জার্ভিস নামের মার্কিন এক নারী। কিন্তু পরবর্তীতে কয়েক দশক ধরে তিনি দিবসটির বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। এমনকি এই লড়াইয়ের পেছনে তিনি তার জীবন ও সব সম্পদ উৎসর্গ করেছিলেন। শেষ জীবনে নিঃস্ব ও রিক্ত অবস্থায় তিনি মারা যান।
একবার আনা জার্ভিস ফিলাডেলফিয়ায় তার বন্ধু জন ওয়ানামেকারের ছোট্ট রেস্তোরাঁয় খাচ্ছিলেন। এসময় একটি সালাদের বিশেষ নাম তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি এক প্লেট সেই সালাদ অর্ডার করেন। ওয়েটার সালাদ দিয়ে যাওয়ার পর, জনসম্মখে তিনি এগুলো মাটিতে ফেলে দিয়েছিলেন। কারণ সালাদটির নাম ছিল 'মাদার্স ডে সালাদ', মা দিবস নিয়ে এমন বাণিজ্য দেখে ঘৃণায় তিনি এ কাজটি করেছিলেন।
অথচ বেশ কয়েক বছর আগে মায়েদের সম্মানে তিনিই প্রথম মা দিবসের প্রবর্তন করেছিলেন।
তবে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন এই নারী এক সময় দিবসটি পালনকে সম্মান হিসেবে নয় বরং তার অতি প্রিয় অনুভূতির অবমাননা হিসেবে মনে করেছেন। ঘটা করে দিবসটি পালন তার কাছে মুনাফা অর্জনের একটি সস্তা বিপণন কৌশল বলে মনে হয়েছিল।
জার্ভিস এবং কীভাবে মা দিবস জাতীয় ছুটির দিনে পরিণত হয়েছিল তা নিয়ে গবেষণা করা ইতিহাসবিদ ক্যাথরিন আন্তোলিনি বলেছেন, জার্ভিস দেশে প্রথম মা দিবস অনুষ্ঠানের আয়োজন করার কয়েক বছর পর ১৯০০- এর দশকের গোড়ার দিকে একটি সংবাদপত্রে এই ঘটনাটি নিয়ে নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল। এরপর থেকে দিবসটির বাণিজ্যিকীকরণ হতে থাকে এবং পরবর্তী কয়েক দশক ধরে মা দিবসকে আজকের বাণিজ্যিক ছুটির দিনে পরিণত হওয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্য কঠিন লড়াই শুরু করেন জার্ভিস।
তার কাছে, এটি ছিল শুধু মায়েদের সম্মান জানানোর একটি দিন এবং তিনি এটি তার নিজের মায়ের স্মরণে শুরু করেছিলেন। তাই মানুষদের তার এই অনুভূতিকে অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে দেখে জার্ভিস ভয়াবহ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
আর তাই দিবসটির প্রকৃত মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার চেষ্টায় মরিয়া হয়ে তিনি ব্যবসায়ীদের প্রচণ্ড গালমন্দ করেন, মামলার হুমকি দেন, রাজনীতিবিদদের কাছে চিঠি লেখেন, সংবাদপত্রে নিবন্ধ লেখেন, প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, এলিনর রুজভেল্টের সঙ্গে লড়তেও পিছপা হননি এবং প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্যদের হস্তক্ষেপ দাবি করেন।
আন্তোলিনি বলেছেন, এক সময় তিনি এই ছুটির আইনিস্বত্বও দাবি করেছেন। এমনকি তিনি তার চিঠিতে সই করেছেন এভাবে,'আনা জার্ভিস, মা দিবসের প্রতিষ্ঠাতা।'
এই ঐতিহাসিক বলেছেন, 'এটি তার পরিচয়ের একটি অংশ হয়ে উঠেছিল।'
তবে অনেক চেষ্টার পরও জার্ভিসের লড়াই ব্যর্থ হয়েছিল এবং এই লড়াই করতে গিয়ে সমাজ ও পরিবার থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছিলেন। অবশেষে ১৯৪৮ সালে ৮৪ বছর বয়সে একা, অন্ধ ও নিঃস্ব অবস্থায় তিনি একটি স্যানিটরিয়ামে মারা যান।
আন্তোলিনি বলেন, আজ যদি জার্ভিস বেঁচে থাকতেন, মা দিবস এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দেখে তিনি হয়ত রোমাঞ্চিত হতেন। 'তবে এ কথা ভেবেও ক্রুদ্ধ হতেন যে মানুষ তাকে আর মনে রাখে নি।'
বর্তমানে মা দিবস উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন, কার্ড ও ফুল বিক্রি প্রভৃতির মাধ্যমে ছুটির দিনটি উদ্যাপন করা হয়, তা জেনেও তিনি হয়ত কষ্ট পেতেন।
ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ওয়েসলিয়ান কলেজের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান আন্তোলিনি বলেন, ১৯৯০-এর দশকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গ্রাফটনে অবস্থিত আন্তর্জাতিক মা দিবসের স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শনের পর থেকে জার্ভিস এবং মা দিবসের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। এটি একটি গির্জার জাদুঘর, যেখানে প্রথম মা দিবসের প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
আন্তোলিনি জানান, গির্জার রান্নাঘরে তিনি জার্ভিসের বেশ কয়েক বাক্স নথি পেয়েছিলেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে সেগুলো সংরক্ষণ করেছেন এবং রেকর্ডগুলো উদ্ধারে পেছনে কয়েক মাস সময় ব্যয় করেছিলেন।
ক্রমেই তিনি নিঃসন্তান এই নারীর সম্পর্কে জানতে পারেন, যিনি মায়েদের জন্য ছুটি প্রবর্তনের উদ্দেশে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
আন্তোলিনি বলেন, 'তার সারফেস ইমেজ হচ্ছে তিনি ছিলেন একজন পাগলাটে চিরকুমারী, যিনি এই আন্দোলনের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এবং যারা তার কাছ থেকে তার দিনটি কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল তাদের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন।'
তিনি বলেন, এই ছুটির দিনটি প্রবর্তন করা, এটিকে স্থায়ী করা এবং সারাদেশে এটি ছড়িয়ে দেওয়াই ছিল তার জীবনের উদ্দেশ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েবস্টারে জন্মগ্রহণকারী জার্ভিস তার মা অ্যান রিভস জার্ভিসের কাছ থেকে মা দিবস প্রবর্তনের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তার মা ছিলেন একজন সানডে স্কুল শিক্ষক। তিনি মাদার্স ডে ওয়ার্ক ক্লাব শুরু করতে সহায়তা করেছিলেন, যাতে কীভাবে নিজেদের বাচ্চাদের যত্ন নিতে হয় নারীদের তা শেখানো যায়।
আন্তোলিনি বলেন, ১৮৭৬ সালে এক বক্তৃতার পর অ্যান রিভস জার্ভিস প্রার্থনা করেছিলেন যে কেউ যেন মানবসেবার উদ্দেশ্যে মায়েদের স্মরণে একটি দিন তৈরি করে। কথাটি ১২ বছর বয়সী আনা জার্ভিসের মনে দাগ কেটেছিল। ১৯০৫ সালে তার মা মারা যান এবং ৪০ বছর বয়সী জার্ভিস তার কবরস্থানে গিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনিই তার মায়ের ইচ্ছা পূরণ করবেন।
পরের কয়েক বছর জার্ভিস প্রতিটি রাজ্যের গভর্নরকে মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে বা তার মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীর নিকটতম রবিবারকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করতে অনুরোধ করে বার বার চিঠি লিখতে শুরু করেছিলেন।
আন্তোলিনি বলেন, তিনি মার্ক টোয়েন, প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট এবং অন্য বিভিন্ন ক্ষমতাধর ব্যক্তিকেও চিঠি লিখেছিলেন। তিনি ফিলাডেলফিয়ার ব্যবসায়ী ওয়ানামেকার এবং তার বন্ধুর সহায়তাও চেয়েছিলেন।
১৯০৮ সালের এক সকালে গ্রাফটনের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ মেথোডিস্ট এপিসকোপাল চার্চে প্রথম মা দিবসের প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়।
সেই প্রার্থনার জন্য তার মায়ের প্রিয় ফুল, শত শত কার্নেশন কিনেছিলেন তিনি। পেনসিলভানিয়ার ওয়ানামেকার মিলনায়তনে সেদিন বিকেলে আরও বড় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে জার্ভিস বক্তব্য রেখেছিলেন।
সেখান থেকে মা দিবসের কথা এত দ্রুত ছড়িয়ে যায় যে, পরের বছর ওয়াশিংটন রাজ্যের স্পোকানে নামক স্থানের বাসিন্দা সোনোরা স্মার্ট ডড নামের একজন (তার মা তাকে প্রসবকালে মারা যান এবং তার বাবা তাকে লালনপালন করেন) বাবা দিবস চালু করেছিলেন।
১৯১০ সালে পশ্চিম ভার্জিনিয়া মা দিবসকে ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করে একটি আইন পাস করে এবং অন্যান্য রাজ্যও তা অনুসরণ করে। কিন্তু জার্ভিস তবুও থামেননি। মা দিবসকে জাতীয় ছুটির দিন ঘোষণা করার জন্য তিনি চিঠি লিখতেন এবং এই সম্পর্কে বক্তব্য দিতে দূরদূরান্তে যেতেন।
তার চিঠিপত্রের পরিমাণ এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে সেগুলো সংরক্ষণের জন্য তার আরেকটি বাড়ি কিনতে হয়েছিল।
১৯১৪ সালের ৮ মে মার্কিন কংগ্রেস মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারকে মা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। পরের দিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন যুদ্ধে মারা যাওয়া সন্তানদের মায়েদের সম্মান জানানোর উদ্দেশে প্রথম জাতীয় মা দিবসের ঘোষণা দেন।
ক্রমে মা দিবস একটি জাতীয় দিবস হয়ে ওঠে, কিন্তু জার্ভিসের কথা আর কেউই মনে রাখেনি।
পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি ছুটির দিনটি থেকে ব্যবসা করে মুনাফা অর্জন করা ফুলের দোকানের মালিক, কার্ড প্রস্তুতকারক এবং ক্যান্ডি ব্যবসায়ীদের গালাগালি করেন।
১৯৮৬ সালে ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা এক চিঠিতে তিনি অভিযোগ করেন, 'তারা আমার মা দিবসকে বাণিজ্যিকীকরণ করছে। আমার উদ্দেশ্য এটা ছিল না।'
১৯৯৪ সালের পোস্টের একটি নিবন্ধ অনুসারে তিনি একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন: 'আপনারা প্রতারক, ডাকাত, লুণ্ঠনকারী, অপহরণকারী এবং অন্যান্য কীটদের লাভবান করার জন্য আর কী কী করবেন? যারা লোভের কারণে এমন মহৎ ও আন্তরিক অনুষ্ঠানকেও ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহার করতে পিছপা হয়না।'
১৯৪৮ সালে প্রকাশিত একটি পোস্ট শোকবার্তা অনুসারে, ১৯২৩ সালে মা দিবসের সভার পরিকল্পনার করায় তিনি নিউইয়র্কের গভর্নর এআই স্মিথের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছিলেন।
১৯৩১ সালে তিনি নিউইয়র্কের ফার্স্ট লেডি এলিনর রুজভেল্টের সঙ্গে মা দিবস বিরোধী কমিটি নিয়ে লড়াই করেছিলেন।
এমনকি বিভিন্ন দাতব্য সংস্থাগুলোকেও তিনি অবজ্ঞা করতেন। কারণ ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার সময়, দাতব্য সংস্থাগুলো অভাবী মায়েদের সহায়তার জন্য মা দিবসে তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। এতে বিরক্ত হন জার্ভিস।
আন্তোলিনি বলেন, 'তিনি চাননি দিনটি ভিখারি দিবস হোক। তিনি চাননি যে দিনটি কেবল একটি দাতব্য অনুষ্ঠানে পরিণত হোক। তিনি চাইতেন আপনারা মায়েদের করুণা নয়, আপনারা তাদের সম্মান করুন।'
জার্ভিসকে নিয়ে গবেষণা করার সময় আন্তোলিনি দৃঢ়চেতা এবং প্রচণ্ডভাবে স্বাধীন এই নারীর প্রতি সহানুভূতি বোধ করেন।
এই ঐতিহাসিক জানান, জার্ভিস এমন এক সময়ে অবিবাহিত ও নিঃসন্তান ছিলেন, যখন স্বামী-সংসারের বাইরে নারীদের অন্য কোনো জগৎ ছিলনা। আপনি যখন বুঝতে পারবেন এসব কাজের পেছনের অনুপ্রেরণা কি ছিল, তিনি কেন এগুলো করেছিলেন, তখন আর আপনার তাকে পাগলাটে মনে হবে না।
আন্তোলিনি বলেন, তার যুক্তি ছিল যথার্থ। তার কথাগুলো শুনলে আপনারাও বুঝতে পারবেন, বিষয়টি নিয়ে তার রাগ ছিল ন্যায়সংগত।
তবে আন্তোলিনি স্বীকার করেছেন, মাতৃত্ব সম্পর্কে জার্ভিসের একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একটি শিশুর দৃষ্টিভঙ্গি, একটি বালিকার মতো করেই তিনি ভাবতেন, যে তার মাকে গভীরভাবে ভালোবাসত।
আন্তোলিনি বলেন, 'মাতৃত্ব সম্পর্কে শিশুদের মতোই খুব সরল দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তার।'
১৯৪০ এর দশকের গোড়ার দিকে জার্ভিসের দেহ ভেঙে পরে এবং তার দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। তার বন্ধু এবং সহযোগীরা তাকে ওয়েস্ট চেস্টারের একটি স্যানিটারিয়ামে রেখেছিলেন। ১৯৪৮ সালের ২৪ নভেম্বর সেখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বর্তমানে মা দিবস যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম লাভজনক ছুটির দিনে পরিণত হয়ে উঠেছে। ২০০৬ সাল থেকে দিবসটির বার্ষিক ব্যয় ক্রমাগত বাড়ছে।
ন্যাশনাল রিটেইল ফেডারেশনের তথ্যমতে, এই বছর ভোক্তারা প্রায় রেকর্ড ৩৩.৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমরা নিশ্চয়ই কল্পনা করতে পারছি, এসব জানলে জার্ভিসের কী অনুভূতি হতো!
ভাবানুবাদ: তাবাসসুম সুইটি