চাকরির আবেদন করতে সব ‘কোয়ালিফিকেশন’ থাকতেই হবে এমন নয়
হয়তো আপনি স্নাতক সম্পন্ন করেছেন সদ্যই, শিক্ষা জীবন আপনাকে প্রথম চাকরির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করেছে এমন আশায় হয়তো বুক বেধেছেন। কিন্তু, কর্মমুখী শিক্ষার অভাব আছে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয়। তাছাড়া, নির্দিষ্ট বিষয়ে শিক্ষা আপনাকে কর্মক্ষেত্রের সীমিত ধারণা দেয় মাত্র, কার্যক্ষেত্রে যেসব দক্ষতা বা যোগ্যতার প্রয়োজন তা কিন্তু কোনো ক্লাসের মাধ্যমেই পুরোপুরি শেখা হয়ে ওঠে না। চাকরির আবেদন প্রক্রিয়াকে যা আরো জটিল করে তোলে প্রায়শই।
এন্ট্রি লেভেল বা প্রাথমিক পদগুলোয় চাকরির ক্ষেত্রে আবেদনকারীদের কাছে এমন কিছু যোগ্যতা বা 'কোয়ালিফিকেশন' চাওয়া হয়- যা হয়তো আপনি আগে প্রত্যাশা করেননি।
আপনি ক্লাসে যা শিখেছেন– চাকরির ওই সার্কুলারে যদি তেমন যোগ্যতাগুলোরও উল্লেখ থাকে, তারপরও হয়তো দেখা যায় আপনার সম্ভাব্য কর্মদাতা সংস্থা এমন কিছু পদ্ধতিতে কাজ করে– যা আপনার পূর্বপরিচিত নয়। অর্থাৎ, শিক্ষার বাইরের অনেক কিছু আমাদের কর্মক্ষেত্রে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
আর এখানেই রয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ: কোনো চাকরির বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা সব যোগ্যতা না থাকলেও আপনার সেখানে আবেদন করা উচিত।
চাকুরি প্রত্যাশীর যোগ্যতা নিয়ে হার্ভার্ড বিজনেস রিভ্যিউয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি অ্যান্ড মার্কেটিং বিষয়ের অধ্যাপক আর্ট মার্কম্যান।
সেখানে তিনি একটি উদাহরণ টেনে লিখেছেন, আমার বড় ছেলে সদ্যই কলেজের শিক্ষাজীবন শেষে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করে বসে। সে যে পদের জন্য আবেদন করে, সেটি সাধারণত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের দেওয়া হয়। তার আগে সে আমার কাছে করণীয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল। আমি বললাম, যদি চাকরিটির জন্য তুমি নিজেকে উপযুক্ত মনে কর, তাহলে চিন্তার কিছু নেই। শেষপর্যন্ত চাকরিটি পেয়েছিল সে, কর্মক্ষেত্রে তাঁকে প্রচুর নতুন নতুন জিনিস শিখতেও হয়েছে। শেখার এই গুণ দিয়ে চাকরিতে উন্নতিও করেছে।
আসলে কর্মদাতা প্রতিষ্ঠান প্রত্যাশা করে, নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা চটপট কাজগুলো শিখে নিবে, এবং মন দিয়ে দায়িত্বপালনের চেষ্টা করবে। এজন্য কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে পুরোপুরি জানতে, নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা প্রচুর প্রশ্ন করবে বা সিনিয়রদের দিকনির্দেশনা চাইবে– এটা তারা চায়। নতুন চাকরিতে খাপ খাইয়ে নেবার সময় কিছু ভুলভ্রান্তিও যে হবে– সেটিও প্রত্যাশিত।
অর্থাৎ, আপনাকে এমন চাকরির আবেদন করা উচিত– যেখানে দায়িত্বভার আপনাকে কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতা দেবে। করে তুলবে আরো তৎপর ও কর্মব্যস্ত। বরং যে পদের জন্য উল্লেখিত সব যোগ্যতার ঘরে 'টিক' দিতে পারছেন, সেটি এড়িয়ে যেতে পারেন এই ভেবে, যে তাতে কর্মক্ষেত্রে নতুন কিছু শেখার সুযোগ কম থাকবে। ফলে সেখানে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ক্যারিয়ারে বেশিদূর উন্নতির আশাও নেই একজন সদ্য গ্রাজুয়েটের।
তবু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বেশিরভাগ মানুষই এমন চাকরির পেছনে ছোটেন, যেখানে কোম্পানির প্রত্যাশিত যোগ্যতার চেয়ে তাঁরা 'ওভার-কোয়ালিফায়েড'। এর সুবিধেজনক দিকটি হলো: দ্রুত চাকুরির নিশ্চয়তা। এতে কর্মদাতাও খুশি হয়, আবার চাকরিপ্রার্থীর নিজের আত্মবিশ্বাসও বাড়ে।
কিন্তু, এই চাকরিতে আপনার উন্নতি সেভাবে হবে না। এক জায়গায় দীর্ঘদিন আটকে থাকলে, পদোন্নতির সম্ভাবনাও মলিন হয়ে পড়ে।
এইজন্যই মানসম্পন্ন চাকুরিতে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন বিষয় শেখার থাকে। সেখানে কাজ করার চ্যালেঞ্জ নিলে, নানান রকম দক্ষতা আপনার তৈরি হতে থাকবে, যা পরবর্তী পদে কাজ করার জন্য আপনাকে তৈরি করবে।
আর যে পদের জন্য আপনি এরমধ্যেই অধিক-যোগ্যতাসম্পন্ন সেখানে চাকরির সময় শেখার সুযোগ বেশি পাবেন না। শিখতে চাইলে তা করতে হবে, আপনার ডিউটি টাইম শেষে। ফলে একইসঙ্গে দায়িত্বপালন ও শেখাটা হয়ে উঠবে না আপনার।
চাকুরিপ্রত্যাশীদের আরেকটি মানসিক বাধা হচ্ছে ইমপোস্টার সিনড্রোম। এটা হচ্ছে এমন ধরনের অনুভূতি যার কারণে কেউ কেউ মনে করে, সে এমন পদে চাকরি করতে চলেছে যার যোগ্যতা তাঁর নেই। এই সিনড্রোমে তাড়িতরা ভাবে, তাঁদের অযোগ্যতা সম্পর্কে অন্যরা জানতে পারলে, তাঁদের চাকরি আর থাকবে না। এজন্যই তাঁরা নতুন কিছু শিখতে হবে এমন চাকুরি এড়িয়ে চলে।
কিন্তু, ইমপোস্টার সিনড্রোমের যুক্তি ভীষণ দুর্বল। প্রধান কারণ, আমরা অন্যের মনের কথা পড়তে পারি না। ফলে আপনার চেয়ে অন্যদের বেশি যোগ্যতা বা আত্মবিশ্বাস আছে নিজের কর্মদক্ষতা বা পদ সম্পর্কে এটা ধরে নেওয়া সমীচীন নয়। তবু এই মনোবৈকল্যের কারণে আমরা বুঝতে পারি না যে, আজ যাকে দক্ষ বা আত্মবিশ্বাসী বলে ভাবছি, তিনিও প্রথম চাকুরিতে বহু বিষয় শিখেছেন। সময়ের সাথে সাথে বাড়িয়েছেন নিজের দক্ষতা। এই অপারগতা থেকেই যে চাকরির জন্য নিজেকে উপযুক্ত বলে মনে করি না আমরা, সেটি এড়িয়ে চলি।
কিন্তু, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন কিছু শেখার চ্যালেঞ্জ নেওয়াই শ্রেয়। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির মনোভাব বিষয়ে একটি গবেষণা করেছেন ক্যারোল ডিউক ও তাঁর সহকর্মীরা। গবেষণার ভিত্তিতে তাঁরা বলেছেন, শেখার মনোভাব বজায় রাখতে হলে, জটিল কাজকে দেখতে হবে ওই বিষয়ে নিজের দক্ষতা নেই এমনভাবে। অর্থাৎ, আপনাকে সেটা শিখতে হবে। অর্থাৎ, কাজটি জটিল হওয়ার অর্থ এই নয় যে, আপনার সেটি করার মতো মেধা নেই। সাংগঠনিক মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, উন্নতির এই মনোভাব কাজের সাথে কর্মীর সম্পৃক্ততাকেও বাড়ায়।
বাস্তবতা এটাই সবারই উচিত পদে চাকুরিকে এমনভাবে বিবেচনা করা, যেখানে ওই ওই দায়িত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু গাইডলাইন থাকবে। এটিকে ওই চাকরির শর্ত হিসেবে দেখা উচিত না যা চাকুরির আবেদনকারীর থাকতেই হবে। চাকুরির প্রাথমিক কিছু যোগ্যতা তো অবশ্যই আগে থেকে থাকা উচিত। কিন্তু, যেসব পদের জন্য আমরা এরমধ্যেই অতি-যোগ্যতাসম্পন্ন, শুধু সেসব চাকরির জন্য আবেদন করব আর অন্য সম্ভাবনা থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখব– এমন করাটা হবে অনুচিত ও নির্বুদ্ধিতার শামিল।
ভাবানূবাদ: নূর মাজিদ